ভাষা শহীদদের রক্তে ভেজা পবিত্র মাটিতে আজ ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বীভৎস উল্লাস৷ ভুলিয়ে দিতে চাইছে বাঙালীর গর্বের ইতিহাস৷ পেঁচা যেমন সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না, তেমনি মানব সমাজেও আছে কিছু দ্বিপদ জীব শোষক রূপে, ধর্মান্ধের বেশে যাদের কালো হাত আজ সমাজের সর্বস্তরে বিস্তৃত৷ সেই কালো হাতের স্পর্শ বিষে জর্জরিত বাঙলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি৷
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট মধ্যরাতে স্বাধীনতার যে পতাকা উড়িয়ে ছিলেন সেদিনের দেশ নেতারা, তাতে ক্ষমতা আস্বাদনের সুযোগ পেল দেশনেতারা, ধন-সম্পদ লুন্ঠনের অবাধ স্বাধীনতা পেল দেশীয় ধনকুবেররা, হতভাগ্য বাঙালী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিদ্ধস্ত বিভক্ত হয়ে নতুন করে শোষনের শিকার হলো৷ ওপারে আক্রান্ত হলো বাঙালী উর্দু সাম্রাজ্যবাদের বিষাক্ত দংশনে, এপার বাঙলার ধন-মান-সম্পদ চলে গেল হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী রাহুর গ্রাসে৷
ভুল ভাঙতে দেরী হলো না ওপারের বাঙালীর৷ সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালীর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জোরপূর্বক উর্দু-চাপাতে চাইলো পশ্চিম পাকিস্তানি শোষক শাসকেরা৷ গর্জে উঠলো পূর্বপাকিস্তানের বাঙালী ভাই-বোনেরা৷ সদ্য সাম্প্রদায়ীকতার আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে৷ ৪৬-এর কলঙ্কিত অধ্যায় মুছে দিয়ে তৈরী হলো নতুন ইতিহাস ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারী৷ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে, অধিকার আদায় করতে রাজপথে নেমে এলো লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রা৷ পশ্চিমি উর্দু সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়লেন---রফিক শফিউর,জববার, সালাম বরকত৷
শাসকের বুলেট শুধুমাত্র কয়েকটা প্রাণ নিতে পারে, দমন করতে পারে না৷ মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের উদ্বেল করা আবেগ৷ সেই আবেগ পরিণত হলো স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে৷ ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারীর পথ ধরে তৈরী হলো ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতেই পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিল নতুন রাষ্ট্র স্বাধীন বাঙলাদেশ৷
বাঙালীর সেই গর্বের ইতিহাসকে মুছে দিতে চাইছে আজ আবার একদল ধর্মান্ধ মৌলবাদী৷ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে এক প্রতিহিংসা পরায়ন শান্তির পূজারী৷ আবার অস্থির বাংলাদেশ৷
২১শে ফেব্রুয়ারী শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় ১টা তারিখ নয়, ২১ একটা ইতিহাস, যে ইতিহাস প্রমান করেছে ধর্মীয় মতবাদের উস্কানি দিয়ে মানুষের ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি কেড়ে নেওয়া যায় না৷ তাই ২১শে ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না৷ তবু একদল ধর্মান্ধ মৌলবাদী দ্বিপর জীব মুছে ফেলতে চাইছে ২১শে অমর ইতিহাস৷ পঙ্গু তদারকী সরকার হয় নীরব দর্শক, নতুবা মৌলবাদকেই প্রচ্ছন্ন মদত দিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছে৷
স্বাধীনতার পর মুহূর্ত্ত থেকেই এপারেও আক্রান্ত বাংলাভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি, লুন্ঠিত বাঙলার খনিজ, বনজ, কৃষিজ জলজ সম্পদ৷ বাঙালী সাম্প্রদায়ীক কোন্দল, রাজনৈতিক দলাদলি, ক্রিকেট জুয়া আর চটুল রসের অশ্লীল হিন্দি চলচিত্র গানে মত্ত৷ তবু বাঙালী জাগবে, ২১শে পথ ধরেই জাগবে, মিরজাফর, নরেন গোঁসাইরা এই বাঙলায় জন্মালেও এ বাঙলা তাদের নয়৷ তাই তো ২১শে ফেব্রুয়ারী পথ ধরেই বরাক বঙ্গে হলো ১৯শে মে’র ইতিহাস, তাই তো স্বাধীন বাঙলাদেশের জন্ম৷
এবারের ২১শে ফেব্রুয়ারী শুধু স্মরণ দিবস নয়৷ এপার ওপার দুপারেই আজ আবার ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা আক্রান্ত৷ এপারেও শিলচরের ভাষা আন্দোলনে নিহত ১১ শহীদদের ১৯শে মের ইতিহাস মুছে দিতে চাইছে মৌলবাদী সরকার৷ আজ আর কোন প্রতিবাদে কাজ হবে না৷ চাই প্রতিরোধ৷ বিশ্ব কবির ভাষা---‘প্রচণ্ড মার খেয়েও বাঙালী মাথা তুলে দাঁড়াবে৷’ মার বাঙালী খাচ্ছেই৷ প্রচণ্ড মার খাচ্ছে৷ এপার ওপার দুপারেই৷ মাথা তুলে দাঁড়াবার এটাই উপযুক্ত সময়৷ তাই এবারের ২১শে ফেব্রুয়ারী শুধু স্মরণ দিবস নয়, ২১শে ফেব্রুয়ারী হোক বাঙালীর জাগরণে মন্ত্র৷
- Log in to post comments