ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের মূলতঃ সূত্রপাত হয়েছিল সিপাই বিদ্রোহ থেকে৷ এছাড়াও ছোটোখাটো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তার আগে হলেও সাংঘাতিকভাবে জনমানসে তা দানা বাঁধেনি৷ তাই তাকে স্বাধীনতার আন্দোলন বলে ধরা হোতো না, যেমন চুয়ার বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, রানী রাসমণির নদীর মাছ ধরা নিয়ে জল কর বিদ্রোহ ইত্যাদি৷ ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিলো কলকাতার ব্যারাকপুর সেনা ছাউনি থেকে লাহোর সেনা ছাউনি পর্যন্ত প্রায় শতাধিক সেনা ছাউনিতে৷ ভারতীয় ব্রিটিশ বিরোধী সেনাদল ব্রিটিশ সেনাদের উপর একই সময়ে গুলি বর্ষনের মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করে৷ এর ফল স্বরূপ পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর সেনা হতাহত হয়৷ এর মূল প্রেরণা ছিলেন একজন অর্দ্ধ শিক্ষিত কিন্তু স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী মঙ্গল পাণ্ডে৷
ভারতের স্বাধীনতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেক স্বদেশী ও বিদেশি সাংবাদিক ও ঐতিহাসিকরা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন সিপাই বিদ্রোহ আন্দোলন সংঘটিত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হলেও ব্রিটেনের অধীশ্বরের গদীকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো বাঙলার দামাল ছেলে ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকির আত্মত্যাগ৷ এরপরের ইতিহাস বাঙলার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন৷ তখনো ভারতের অন্যরাজ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন মাতৃগর্ভে হলেও বাঙলার ঘরে ঘরে মায়েরা হয়ে উঠেছিল রত্নগর্র্ভ৷ বাঙলার মায়েরা অকাতরে তাদের ছেলে মেয়েদের ব্রিটিশের অস্ত্রের ও ফাঁসি দড়ির সামনে উৎসর্গ করেছিলেন৷ ঠিক সেই মুহূর্তে মহানায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের আহ্বানে কতো বঙ্গ সন্তান স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই ব্রিটিশের হৃদকম্পণ উঠেছিলো৷ আগে পরে তৈরী হয়েছিলো চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ছোট্ট টেগরা, মাষ্টারদা সূর্য সেনের সেনানী প্রীতিলতা, বিনয় বাদল দিনেশ থেকে উড়িষ্যার বুড়িবালামের তীরে বাঘা যতীন সহ আরো কয়েক হাজার দামাল ছেলে মেয়েরা বাঙলার আনাচে কানাচে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে ও গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন৷ যাদের আত্মত্যাগে ভারত আজ আংশিকভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাধিকার লাভ করলেও এখনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সাত দশক পরেও লাভ করতে পারেনি৷
তার অন্যতম কারণ স্বাধীনতার ব’কলমে রাজনৈতিক দলের কাঁধে বন্দুক রেখে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষমতার দখল নেয় দেশীয় পুঁজিপতিরা বেনিয়া ব্রিটিশের যোগ্য উত্তরসূরিরূপে৷ বলা যায় কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ব্রিটিশ বেনিয়ারা দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যায়৷
১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পর লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সামনে বলেছিলেন--- ভারতে দেশীয় পুঁজিপতিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে শক্তি যোগাচ্ছে৷ আমাদের ওদের বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ মানুষকে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে৷
স্বাধীনতার আগে থেকেই ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি যে দেশীয় পুঁজিপতিদের পৃষ্ঠপোষক ছিল, পরবর্তীতে সুভাষচন্দ্রের পরিণতিই তার প্রমাণ৷ এমনকি সেদিন কম্যুনিষ্টরাও সুভাষচন্দ্রের চরম বিরোধীতা করেছিল৷
আজ স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরে আর্থিক শোষণ চরমরূপ গ্রহণ করেছে৷ আর্থিক দুর্নীতি, সামাজিক ভেদ-বিদ্বেষ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সবের পিছনেই আছে দেশীয় পুঁজিপতিদের কালো হাতের স্পর্শবিষ৷ এর থেকে মুক্তির একটাই পথ সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউটের বাস্তবায়ন৷ প্রাউটের আর্থিক পরিকল্পনাতেই সর্ব অস্তিত্বের সার্বিক বিকাশ সম্ভব৷
মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বর্তমান সামাজিক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে মানব ও সমাজের সার্বিক বিকাশ করতে দিলেন সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন---যার নাম ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’ বা ‘‘প্রাউট’’৷ এই প্রসঙ্গে প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন---‘‘অর্থনীতি হবে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ও প্রয়োগভৌমিক বিজ্ঞান, আর একে বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষের, সর্বজীবের তথা সর্বস্তিত্বের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে বিকশিত করতে হবে৷’’
সর্ব অস্তিত্বের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থেই তিনি পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীত অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টে দিলেন এক বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা৷ তিনি ভারতবর্ষে ভাষা কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, খাদ্যাভ্যাস, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, অর্থনৈতিক সমস্যা ও সম্ভাবনার বিচার করে ৪৪টি সমাজ ঘটন করে দিলেন বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যার মূল কথা হল আর্থিক ক্ষমতা থাকবে প্রতিটি সমাজের স্থানীয় মানুষের হাতে৷
প্রাউটে বলা হয়েছে গ্রাম শহরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুসন্তুলন না থাকলে গ্রাম্য অর্থনীতি যেমন ভেঙ্গে পড়বে তেমনি শহরে জনগণের চাপ বৃদ্ধি পেলে শহরের অর্থনীতিও ভেঙ্গে পড়বে৷ এর থেকে মুক্তি পেতে হলে শ্রীসরকার তার দর্শনের চিন্তাধারায় বলেছেন কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে কৃষি সম্পদকে কুটির শিল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সাবলম্বী করলে বিশ্বের অর্থনীতি ভয়ানক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে৷ তাই তিনি সমগ্র বিশ্বকে শোষণমুক্ত ও ক্ষেত্রে স্বয়ংম্ভর করে গড়ে তুলতে ভারতবর্ষকে ৪৪টি ও বিশ্বকে প্রায় ২৫০টি সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভাগ করেছেন৷ লক্ষ্য আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা তথা এক সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত অবিভক্ত ও আদর্শ মানব সমাজ ঘটন৷
- Log in to post comments