এক শিরদাঁড়া যুক্ত বাঙালী, মৃত্যুর পর যাঁর দেহ দাঁড় করিয়ে দাহ করা হয়েছিল

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

 এক স্বনামধন্য কবি একদা লিখেছিলেন- ‘‘তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়’’৷ তার এই বাণী (!) গত দেড় দশক যাবৎ এখনও পর্যন্ত অনেকেরই কথায় কথায় উঠে আসে৷ যদিও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি নিজেই তা বিশ্বাস করেননি অথবা আস্থা রাখেননি৷

তবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কবির এই উক্তির অন্তত একশ বছর আগে এক বাঙালি যা বলেছিলেন, জীবনের শেষ দিনে তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন সহযোদ্ধারা৷

‘‘জীবিতাবস্থায় আমি যে শির কাহারও নিকট অবনত করি নাই, মৃত্যুর পরও যেন আমার সেই শির অবনমিত না করা হয়’’ কথাগুলো জানিয়ে উইল করে গিয়েছিলেন তিনি, তাঁকে যেন দণ্ডায়মান অবস্থায় সৎকার করা হয়৷

তাই মৃত্যুর পর তাঁকে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে দাঁড় করিয়ে দাহ করা হয়! এ এক অনন্য নজির৷ মানুষের সঙ্কল্প কতটা দৃঢ় হলে এই বাসনা পোষণ করা যায়! ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে যান৷ তিনি দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল৷

বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য৷

অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম চণ্ডীভেটিতে তাঁর জন্ম ১৮৮১ এর ২৪ নভেম্বর৷

ইংরেজদের সঙ্গে লড়তে ঠিকঠাক আইন জানতে হবে ভেবে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন আইন পড়ার জন্য৷ দেশে ফিরে বাংলার বিপ্লবীদের আইনি সহায়তা দেন৷ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় বিনা পারিশ্রমিকে বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়াতে চট্টগ্রামে দৌড়ে যান৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুর তথা বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন৷

তখন কয়েক বছর অন্তরই কেলেঘাই, কংসাবতী, সুবর্ণরেখার বন্যায় সমুদ্রতীরবর্তী মেদিনীপুরের মানুষ কষ্ট পেতেন৷ দুর্যোগের সময় খালি পায়ে হেঁটে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছতেন এই নেতা, সঙ্গে থাকত খাবার৷ বন্যাবিধবস্ত মানুষদের উদ্ধার, ঘর তৈরির ব্যবস্থা করতেন৷ কোনও সরকারি উপাধি নয়, মানুষকে সাহায্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর লড়াই দেখে মানুষই তাঁকে ‘দেশপ্রাণ’ নাম দেন৷

আচার‌্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁকে ‘মেদিনীপুরের মুকুটহীন সম্রাট’ বলে অভিহিত করেন৷ তাঁর স্বাধীন মনোভাব, অকাট্য যুক্তিতে চমৎকৃত বহু ইংরেজ তাঁকে ‘ইন্ডিয়ান ব্ল্যাক বুল’ বা ভারতীয় কালো ষাঁড় বলেও অভিহিত করেছিলেন৷

অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াইটা কত জরুরি, জানতেন তিনি৷ জেলে বসে নিজের লেখা ‘‘স্রোতের তৃণ’’ বইতে লিখেছেন, ‘‘গত বৎসর একদিন আমি কাঁথির মেথরানিগণকে একটা সভায় ‘মা-বোন’ বলে সম্বোধন করতে পেরেছিলাম বলে আমি হৃদয়ে যে গভীর আনন্দ উপভোগ করেছিলাম তা বলে বুঝাতে পারবো না৷’’

১৯১৯ সালে ইংরেজ সরকার জেলাবাসীর ওপর জুলুম বাজির মাধ্যমে বর্ধিত ট্যাক্স আদায় করার জন্য মেদিনীপুর জেলায় ২৩৫ টি ইউনিয়ন বোর্ড তৈরি করে৷ বীরেন্দ্রনাথে’র নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিরোধ আন্দোলন৷ বীরেন্দ্রনাথ দেশবাসীর কাছে সেই সময় প্রতিজ্ঞা করে জানালেন, যতদিন পর্যন্ত না তিনি ইউনিয়ন বোর্ড গুলিক তুলতে পারবেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি জুতো পায়ে দেবেন না, খালি পায়ে ঘুরে বেড়াবেন৷

জমিদার বাড়ির ছেলে, বিলেত ফেরত প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার খালি পায়ে জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে বোঝান ইংরেজ সরকারকে যেভাবে হোক ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে৷ ট্যাক্স বন্ধ হওয়ায়, সরকারের নির্দেশে পুলিশ একের পর এক ঘর বাড়ি লুটপাট থেকে শুরু করে সমস্ত জিনিসপত্র ক্রোক করে থানায় নিয়ে যাওয়া শুরু করল৷ ক্রোক করা মাল গুলিকে নিলামের ব্যবস্থা করল ইংরেজ পুলিশ৷ ৫০০ টাকার মাল ৫ টাকা তেও কেউ কিনতে চাইলো না৷

বহু মানুষকে ইংরেজরা গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দিল জেলে বন্দির সংখ্যা আর থানা এবং সরকারি দপ্তরগুলি ক্রোক করা জিনিসপত্র গুলিতে ভর্তি হতে লাগলো৷ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সরকার ইউনিয়ন বোর্ড গুলি তুলে নেয় এবং সমস্ত বন্দী মানুষগুলিকে বিনা বিচারে ছেড়ে দিয়েছিল৷

এরপর, কাঁথির ময়দানে বহু মানুষ সমবেত হয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের পায়ে জুতো পরিয়ে দেন৷

চিত্তরঞ্জন দাস যখন কলকাতা কর্র্পেরেশনের মেয়র, তখন দুই বাঙালি ছিলেন কর্র্পেরেশনে তাঁর প্রধান দুই সহযোগী, একজন সুভাষ চন্দ্র বসু এবং অপরজন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল৷

জীবনে কারো কাছে মাথা নত করেননি৷ শিরদাঁড়া বিক্রি করেননি৷

বাংলার ছোটলাট লিটন সাহেব মেদিনীপুর সফরে আসবেন৷ ছোট লাটের সম্বর্ধনা যাতে মেদিনীপুরে যথোপযুক্ত ভাবে হয়, সেই কারণে তৎকালীন জেলা শাসক মিস্টার গ্রাহাম তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য চিঠি লিখে ডেকে পাঠালেন সেইসময়কার মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান বীরেন্দ্রনাথ শাসমল’কে৷ জেলাশাসকের চিঠির উত্তরে দেশপ্রাণ জানিয়ে দিলেন, তিনি ছোটলাটের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না, কারণ ইংরেজ সরকার তাঁকে বিনা দোষে এবং বিনা প্রমাণে জেলে পাঠিয়েছিল৷ অতএব এ ব্যাপারে কোনরকম আলোচনারও অবকাশ নেই৷

এর কিছুদিন পরে জেলাশাসক দেশপ্রাণ’কে কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ফের তাঁর বাংলোতে ডেকে পাঠান৷ দেশপ্রাণ চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, জেলাশাসক প্রয়োজন মনে করলে তাঁর জেলা বোর্ডের দপ্তরে এসে দেখা করতে পারেন, তিনি জেলাশাসকের বাংলোতে যাবেন না৷ কতখানি মানসিক জোর এবং দেশাত্মবোধ থাকলে পরাধীন ভারতের একজন মানুষ, ব্রিটিশ জেলাশাসক কে এই ভাবে উপেক্ষা করতে পারেন, চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন ক্ষমতাসীনকে!

মৃত্যুর পর দেহ দাঁড় করিয়ে রেখে দাহ করা দ্বিতীয় কোন ভারতীয়ের হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে আজ যারা চতুর্দিকে শিরদাঁড়া বিক্রি করে চলছেন, তারা একবার নতুন করে বীরেন্দ্র নাথ শাসমলকে জানার চেষ্টা করতে পারেন৷                                                           (সংগৃহীত)