অনেকে মনে করে থাকেন যে, ‘গ্রৎস’ শব্দটি থেকে ‘গাছ’ কথাটি এসেছে আর ‘গ্রৎস’ মানে হচ্ছে, চলা যার স্বভাব৷ কিন্তু এ ধরনের মানে নেওয়া চলে না, কারণ গাছ কি কখনও চলাফেরা করে? এটি এক ধরনের বিপরীত অলঙ্কার হয়ে গেল৷ এ যেন সেই হাতে মল, পায়ে চুড়ি, কাণে নাকছাবি৷ এ প্রসঙ্গে কবীরের একটি উক্তির কথা মনে পড়ছে৷ সেখানে উল্টো কথা বলা হয়েছে৷ তবে তা’ আসলে উল্টো নয়–
‘‘চলতী কো সব গাড়ী কহে, জ্বলতী দুষকো খোয়া,
রঙ্গীকো নারঙ্গী কহে, যহ্ কবীর কা দোঁহা৷৷’’
গাড়ী মানে যা’ গাড়া রয়েছে বা পোঁতা হয়েছে৷ যে জিনিসটা চাকায় চলে চলেছে তাকে গাড়ী কী করে বলি, আর জ্বাল দেওয়া সঘন দুধ যা’ যে–কোন রসনার পক্ষেই লোভনীয় তাকে ‘খোয়া’ অর্থাৎ নষ্ট হয়ে গেছে কী করে বলবে? অথচ আমরা খোয়াক্ষীর তো বলে থাকি৷ আর যে ফলটির অমন সুন্দর টুকটুকে রঙ তাকে তো ‘রঙী’ বলা উচিত৷ তা’ না বলে তাকে ‘না–রঙী’ বলছি (উর্দুতে কমলা নেবুকে ‘নারাঙ্গী’ বলা হয়)৷
কমলার সাবেকী সংস্কৃত হচ্ছে ‘নাগরঙ্গ’৷ তাই থেকে ‘নারাঙ্গী’ শব্দটা এসেছে যদিও কমলা হচ্ছে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার ফল অর্থাৎ ইয়ূরোপের পক্ষে একটিস্বাভাবিক দেশজ ফল৷ তবু ইংরেজী ‘অরেঞ্জ’ (orange) শব্দটি মূলতঃ ইয়ূরোপীয় বা ইংরেজী নয়৷ তার উৎস হচ্ছে এই উর্দু ‘নারাঙ্গী’ শব্দটি৷ একটি নারাঙ্গী–ইংরেজীতে হবে A narangi কালক্রমে ‘a’ অক্ষরটির স্থানচূ্যতি ঘটায় A nrangi, আরও বিবর্তিত হয়ে An orangi হয়ে গেল An orange৷ অনুরূপ ভাবেই An apkin–এর ‘n’ অক্ষরটির স্থানচ্যুতিতে হয়ে দাঁড়াল A napkin৷ প্রাচীন ইংরেজীতে গামছাকে napkin বলা হত না, বলা হত apkin৷ তারই সমগোত্রীয় apron শব্দটি আজও বহাল তবিয়েতে আছে, napron হয়ে যায় নি৷
শব্দের এই ধরনের পরিবর্তন পৃথিবীতে অনেক হয়েছে৷ শুধু শব্দের বানানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তন নয়, এমনকি কোন বক্তব্য–বিষয়ের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে রচনাটির বাইরে যে অর্থ সেটির ভেতরের অর্থ অন্য রকম৷ যেমন ১২০০ বছর আগেকার সন্ধ্যাভাষায় লিখিত কবিতাগুলি৷ তখন ধর্মের গুঢ় তত্ত্ব সোজাসুজি বলা হত না৷ যা’ বলা হত তার বাইরে এক মানে, ভেতরে অন্য মানে থাকত৷ যেমন কবিরজী এক জায়গায় বলেছেন ‘‘কম্বল বর্ষে ভিঙ্গে পাণি’’৷ এ ‘কম্বল’ মানে পশমজাত কম্বল নয়৷ জলের যে অনেকগুলি নাম আছে তার অন্যতম হচ্ছে ‘কম্বলম্’৷ তাই এখানে ‘কম্বল পাণি’–এখানে ‘পাণি’ মানে ‘জল’ নয়, পাণি মানে করতল, ইংরেজীতে যাকে বলে ‘পাম্’ (palm)৷ সাধক যথারীতি আসনে বসে ঈশ্বরের ধ্যান করছেন আর তাঁর চোখ থেকে নেমে আসা জলস্রোতে হাতের তালু ভিজে যাচ্ছে৷ বারশ’ বছর আগেকার পুরোনো ৰাংলায় কবিতাগুলি সন্ধ্যাভাষায় লিখিত হয়েছিল–
‘‘টালত ঘর মোর নাহি পড়িবেশী
হাঁড়িত ভাত নাই নিতি অবেশী৷
এবেঙ সংসার বড় হিল জা
দুহিল দুধু কি বোটে সামা৷৷’’
এর বাইরের মানে হচ্ছে, টিলাতে আমার ঘর, আমার কোন প্রতিবেশী নেই৷ হাঁড়িতে ভাত নেই, তাই রোজ রোজ উপোস করতে হচ্ছে৷ ব্যাঙের মত সংসার বেড়ে যাচ্ছে৷ গোরুর দোহানো দুধ কি পুনরায় বাঁটে ফিরে যায়? এর আসল মানে অন্য ধরনের৷ এরূপ সন্ধ্যাভাষায় লিখিত আর একটি কবিতা হচ্ছে–
‘‘দুলী দুহি পিঠা ধরন না জাএ
রুখের তেন্তুলী কুম্ভীরে খাএ৷’’
এর বাইরের মানে হচ্ছে, কচ্ছপী দোহন করে এত দুধ পাওয়া গেল যে পিঠে বহন করা যাচ্ছে না৷ আর গাছের তেঁতুল কুমীরে খেয়ে নিচ্ছে৷ বলাই বাহূল্য, এর ভেতরকার মানে অন্য৷ এখানে ‘রুখ’ কথাটি সংস্কৃত ‘বৃক্ষ’ থেকে এসেছে৷ সংস্কৃত বৃক্ষ > বিক্ষ > রুক্ষ > রুখ্৷ সংস্কৃতে ধরা হয় যেন ‘ঋ’ নেই৷ যেমন নৃত্য হয়ে যায় ‘নচ্চ’, বুদ্ধ হয়ে যায় বঢ্ঢ় > বুড্ঢ় > বুড়া > বুড়ো৷ শুধু ‘ঋ’ থাকলে যজুর্বেদীয় রীতিতে ‘ই’ হয়ে যায়৷ অথর্ববেদীয় রীতিতে ‘উ’ হয়ে যায়৷ যেমন ‘ঋষি’ হয়ে যায় ‘ইসি’, আবার ‘ঋজু’ হয়ে যায় ‘উজু’৷ উল্লিখিত শ্লোকটিতে ‘বৃক্ষ’ পরিবর্তিত হয়ে ‘বক্ষ’ হওয়া অধিকতর সঙ্গত ছিল৷ কিন্তু যেহেতু অন্তঃস্থ ‘ব’–এর উচ্চারণ বর–ঘেঁষা, তাই ‘বৃক্ষ’ অথর্ববেদী হিসেবে হয়েছে ‘রুক্ষ’ ভাব আর তার থেকে প্রাচীন বাংলায় ‘রুখ’৷ অবশ্য এর ব্যতিক্রম আছে৷ যেমন সংস্কৃতে ‘বৃক্ষ’ ঞ্ছ প্রাকৃতে হয়ে যায় ঞ্ছ ‘বুক্ক’ ঞ্ছ এর থেকে বর্তমান বাংলার ‘ৰুক’৷ ৰুদ্ধদেব যেখানে তাঁর প্রথম পাঁচজন শিষ্যকে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই স্থানের নাম ছিল সারঙ্গনাথ, আজকাল যা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে সারনাথ৷ এই সারঙ্গনাথের ঋষিরা একটা হরিণ–উদ্যান (Dear prk) তৈরী করেছিলেন, তাই জায়গাটার সংস্কৃতে নূতনতর নাম হয়েছিল ‘ঋষিপত্তন মৃগদাব’, যা প্রাকৃতে হয়ে দাঁড়াল ‘ইসিপত্তন মিগদাব’৷
যাইহোক, ৰাংলায় গাছ, গাছা, গাছিয়া, গেছে, গাছি প্রভৃতি নামগুলি নিয়ে কথা হচ্ছিল৷ যেখানে একের বেশী গাছ রয়েছে সেই স্থানটির নাম প্রাকৃতে ‘গ্রৎসী’ > অর্ধপ্রাকৃতে ‘গচ্ছি’ > পুরোনো বাংলায় ‘গাছি’ বা ‘গাছিয়া > বর্তমান বাংলায় ‘গাছি’ বা ‘গেছে’৷ যেমন বেলগাছিয়া (কলকাতা), কলাগাছিয়া (ঢ়াকা), বামুনগাছি (হাওড়া), কাঁকুরগাছি (২৪ পরগণা, সাঁতরাগাছি প্রভৃতি৷ একাধিককে বোঝাবার জন্যে, আবার একটি বিশেষকে বোঝাবার জনেও ‘গাছি’, ‘গাছা’, ‘ছড়া’ শব্দ বাংলায় চলে৷ যেমন ‘‘হারগাছিটা ওর হাতে তুলে দাও’’৷ এখানে ‘হারগাছা’ও চলবে, আবার ‘হারছড়া’ ও চলবে৷ অনুরূপভাবে ‘গাছা’ ‘ছড়া’ শব্দ বাংলায় চলে৷ যেমন ‘‘হারগাছিটা ওর হাতে তুলে দাও’’৷ এখানে ‘হারগাছা’ও চলবে, আবার ‘হারছড়া’ও চলবে৷ অনুরূপভাবে ‘গাছা’ গ্রামের নামেতেও থেকে গেছে৷ যেমন মুড়াগাছা (নদীয়া), মুক্তাগাছা (মৈমনসিং) যেখানে মুক্তাতুল্য বরণীয় বা মুক্তাতুল্য মূল্যবান জিনিসের সমবায় ঘটেছে বা নির্দিষ্ট করে বলবার অবকাশ রয়েছে৷ বিহারের নাগপুরী, অঙ্গিকা, মৈথিলী প্রভৃতি ভাষাতেও স্থানের নামের সঙ্গে ‘গাছি’ কথাটা যুক্ত আছে৷ অর্থাৎ সেখানেও গাছের সমূহ অর্থে ‘গাছি’ শব্দ ব্যবহূত হয়৷ যেমন–রাণীগাছি (রাতু, রাঁচী), মণিগাছি (মিথিলা) ইত্যাদি৷ বড় রাজার অধীনে ছোট রাজাকে বলে সামন্তরাজা৷ সংস্কৃতে ‘সামন্তরাজা’ > প্রাকৃতে, ‘সাঁওত্ত রাআ’ > ‘সাঁতরায়া’ > বর্তমান বাংলায় ‘সাঁতরা’৷ দক্ষিণ ৰাঙলায়এই ‘সাঁতরা’ পদবীটা ব্যবহার করে চলেছেন৷ সামন্তরাজার লাগানো বাগানকে (অর্থাৎ সেখানে অনেক গাছ আছে) কেন্দ্র করে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল তার নাম ‘সাঁতরাগাছি’৷ সামন্তাজ গ্রৎসী > সাঁওত্তরা গচ্ছি > সাঁতরাগাছি (তাই বানানে হবে সাঁতরাগাছি....‘সাত্রাগাছি’ বানান ভুল৷ বস্তুত ফার্সী জাত ‘বাগ’, ‘বানান’, ‘বাগিচা’ প্রভৃতি শব্দগুলি এদেশে আমদানী হবার আগে বাগান অর্থে গাছি’, ‘গাছা’ ‘গাছিয়া’ শব্দেরই প্রচলন ছিল, অর্থাৎ যেখানে ছিল ৰেলের বাগান লোকে সে জায়গাটাকে বলত ‘ৰেলগাছিয়া’৷