ইন্দ্র

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ইন্দ্র’ মানে শ্রেষ্ঠ৷ বৈদিক ও পৌরাণিক কথানিকা অনুযায়ী দেবতাদের যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁকে ‘ইন্দ্র’ বলা হত৷ ‘ইন্দ্র’ ঠিক কোন ব্যষ্টিবিশেষের নাম নয়, এটি একটি পদবিশেষ  ইন্দ্রের স্ত্রীর নাম শচী৷ সেটা ব্যষ্টিবিশেষের নাম৷ পদাধিকারে ইন্দ্রের স্ত্রীলিঙ্গে ‘ইন্দ্রাণী’, বা ‘ইন্দ্রা’ (‘ইন্দিরা’ শব্দটি বৈয়াকরণিক বিচারে অশুদ্ধ)৷ ‘ইন্দ্র’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ তাই ৰড় কূপকে  সংস্কৃতে ৰলা হয় ইন্দ্রকূপ ইন্দ্রকূপ> ইন্দ্রউ> ইন্দরু> ইন্দার> ইনারা (বিহারের কোন কোন জায়গায় কথ্য ভাষায় ‘ইনারা’ ৰলা হয়৷) অরণ্যানী-শোভা শালবৃক্ষ৷ সে সুন্দর তার ঋজুতায়, দীর্ঘতায়, গাম্ভীর্যে৷ তাই শালেরও সংস্কৃত নাম ইন্দ্রবৃক্ষ৷ ‘ইন্দ্রবৃক্ষের জঙ্গল থাকায় ৰাঙলার একটি স্থানের নাম সংস্কৃত ভাষায় ‘ইন্দ্রপুর> ইন্দ্‌পুর (বাঁকুড়া জেলায়)৷ জৈনযুগে অন্যতম দেবতারূপে পরিচিত ছিল ‘ইন্দ্রহাস’৷ ইন্দ্রহাস> ইন্দ্‌হাস> ইন্দাস> (বাঁকুড়া ও ৰীরভূম জেলার দুইটি বিশিষ্ট জৈন কেন্দ্রের নাম)৷ অনেকে ভুল করে ৰানানটিকে ‘ইন্দাশ’ লেখেন, তা হৰে না৷

লক্ষণীয় এই যে রাঢ়ের যেখানেই ৰড় ধরণের জৈন কেন্দ্র ছিল তারই আশে পাশে ‘গড়াই’ পদৰীধারী মানুষদের বাস রয়েছে৷ ‘গড়াই’ শব্দটি এসেছে ‘গড়কীর্ত্তি’ থেকে (গড়কীর্ত্তি> গড়কীত্তি> গড়ঈই> গড়াই)৷ প্রাচীন ভারতের মানুষ কেন্দ্র বা সংগ্রহ ৰোঝাতে ‘গড়’ শব্দ ব্যবহার করতেন৷ যেগুলি ৰৌদ্ধ ও জৈনযুগে কেন্দ্ররূপে পরিচিত ছিল সেগুলিকেও তাঁরা ‘গড়’ ৰলতেন৷ সেনা-কেন্দ্রকেও ‘গড়’ ৰলা হ’ত ও হয়ে থাকে৷ এই গড়কীর্ত্তি বা গড়াইরা জৈন যুগের বিশেষ সম্মানিত মানুষ ছিলেন ও জৈন কেন্দ্রগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এঁদের ওপর ন্যস্ত ছিল৷ পরবর্ত্তীকালে এঁরা দিগম্বর জৈন মতবাদ ত্যাগ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন৷ এখনও এঁদের অনেকেই বৈষ্ণবাচারের অনুগামী ও অনেকের গলায় কন্ঠী রয়েছে৷ যেহেতু তাঁরা জৈন যুগে সম্মানিত মানুষ ছিলেন সেহেতু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের (বর্ণাশ্রম ধর্মের) যুগে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার নানান ধরণের অপচেষ্টা করা হয়েছিল৷

রাঢ়ের ওই সকল জৈন কেন্দ্রগুলি অনেক জায়গাতেই আজও বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর অথবা গৃহীত জৈন দেব-দেবীর (যারা এককালে জৈন দেব-দেবী ছিল ও এখনও স্বনামে বা ভিন্ন নামে গ্রামবাসীদের পূজো পেয়ে আসছে) সম্মুখে হাঁস ৰলি দেবার প্রথা রয়ে গেছে৷ আরও লক্ষণীয় এই যে ৰাঙলার যে সমস্ত স্থানে জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল না সেখানে ‘গড়াই’ পদবীধারী মানুষের বাস ৰড় একটা দেখা যায় না৷ এই ধরণের কথা কতকটা খাটে সারক/সরাক (সারোগী?) জনগোষ্ঠী সম্বন্ধেও৷ এঁরাও এককালে দিগম্বর জৈন মতাবলম্বী ছিলেন৷ পরবর্ত্তীকালে গৌড়ীয় ধর্মের অনুসরণ করেন৷ এখনও এঁদের মধ্যে দু’একটি জৈনপ্রথা প্রচলিত রয়েছে৷ এই সরাক/সারক সম্প্রদায় পশ্চিম রাঢ়ের অধিবাসী৷ পশ্চিম রাঢ়ের সন্নিহিত বিহার ও ওড়িষ্যার যে সকল স্থানে এঁদের দেখা যায় সেখানেও এঁরা ৰাড়ীতে ৰাংলায় কথা বলেন ও সর্বক্ষেত্রে দায়ভাগ বিধি মেনে চলেন৷ এঁদের মধ্যে একাধিক পদবী প্রচলিত থাকলেও ‘মাঝি’ পদবীটি ৰেশী প্রচলিত৷ প্রসঙ্গতঃ ৰলে রাখা ভাল যে ‘মাঝি’ ও ‘মাজি’ এক জিনিস নয়৷ ‘মাঝি’ পদবীটি সাধারণতঃ সাঁওতালদের জন্যেই ব্যবহৃত হয়৷ সাঁওতালদের মধ্যে হেম্ব্রাম, সোরেন, মুর্মু,কিস্কু, হাঁসদা, টুডু, মারাণ্ডী, ৰাস্কে, ৰেসরা প্রভৃতি বিভিন্ন  গোত্র-পদবী প্রচলিত থাকলেও সাধারণ সম্বোধনাত্মক শব্দ হিসেবে ‘মাঝি’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়৷ আর সাঁওতাল মেয়েদের জন্যে ‘মেঝেন’ শব্দটি প্রচলিত রয়েছে৷

যা সাধারণ ধনুর চেয়ে অনেক ৰড় ও অনেক সুন্দর তা ‘ইন্দ্রধনু’ (রামধনু)৷ মাথার স্থান মানবদেহের সর্র্বোচ্চে৷ তাই টাক পড়লে সংস্কৃতে তাকে ‘ইন্দ্রপতন’ বা ইন্দ্রলুপ্তি ৰলা হয়ে থাকে৷

                                       (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের লঘুনিরক্ত থেকে সংগৃহীত)