সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে বিতর্ক চলেছেই৷ তবে এই শাসনতন্ত্রের বিশেষত্ব হ’ল এই যে, যে দেশের ভোট দাতাদের মধ্যে বিচারশীল মানুষদের সংখ্যাধিক্য বেশী সেখানেই এটি কৃতকার্য হতে পেরেছে৷ অন্যথায় প্রাগৈতিহাসিক মনোভাবাপন্ন বা মেকী সভ্য সমাজে এই শাসনতন্ত্র সুশাসনের প্রতীক হতে পারছে না৷ কারণ এই তন্ত্রকে ফলপ্রসূ করতে গেলে জনশিক্ষার দরকার হয়৷ এর অর্থ দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ অভিজ্ঞান প্রাপ্ত শিক্ষিত হলেই চলবে না, এই শিক্ষিতদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতে হবে৷ সঙ্গে একটা বিচারশীল মানসিকতাও চাই৷
এই বিশ্বে দুই শতের মতো ছোট বড় মিলিয়ে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র চালু আছে৷ এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্রেই তা ফলপ্রসূ হতে পেরেছে৷ প্রশ্ণ আসছে দেশে দেশে এই ব্যর্থতার কারণ কী বলা চলে এই তন্ত্রে ভোটদাতাদের এক দায়বদ্ধতা আগাগোড়াই থাকতে হয়৷ এই শর্তের ঘাটতি যে সকল দেশে যথেষ্ট পরিমাণে থাকে সেদেশেই এই সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য হয়৷ উদাহরণ হিসাবে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ভারত উপমহাদেশের অনেকগুলি রাষ্ট্রের নাম করা যেতে পারে৷ অপরপক্ষে যে দেশগুলিতে এই শাসনতন্ত্র মোটামুটি ভাবে ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়, তার জন্যে জনসাধারণের কৃতিত্বই সর্বাধিক৷ কারণ তাদের শিক্ষিত মননের মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের জন্যে বর্ণচোরা মাণিকরা নেতৃত্বে আসতে পারছে না৷ তাই ওই দেশগুলির সংসদীয় গণতন্ত্রের একটা কল্যাণমুখী রূপ বিশ্ববাসী দেখতে পাচ্ছেন৷
সংসদীয় গণতন্ত্রের দর্শন হ’ল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন৷ কিন্তু এই লড়াই চলবে প্রতিটি দলের ঘোষিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনাকে সামনে রেখে৷ আর দেশের ভোটাররা প্রতিটি দলের এজেন্ডাকে তুলনামূলক ভাবে মূল্যায়ন করে যাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে তাকেই সমর্থন জানাবে৷ এটাই এই শাসনতন্ত্রের প্রথা৷ সুতরাং কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যদি দেখা যায় জনসমর্থন আদায়ের জন্যে দলগুলি সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী পুষছে আর প্রতিটি দলবিরোধী মতাবলম্বী গোষ্ঠীর ওপর সশস্ত্র হামলা, খুন–জখম করে বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ভোট আদায় করছে, কিম্বা রিগিং, ছাপ্পা ভোট দেওয়ার মতো অসংসদীয় আক্রমণ হেনে নেতৃত্ব ও দলকে ক্ষমতাসীন করতে চাইছে, তাহলে বিষয়টা আর সংসদীয় গণতন্ত্র থাকল না৷ কেন না দলীয় প্রভুদের উৎপীড়ন ও নির্যাতনের ভয়ে জনসাধারণ তার স্বাধীন মতামত পোষণ করার সাহস হারিয়ে ফেলে৷ তখন দলীয় প্রভুদের হুইপ অস্বীকার করার ক্ষমতাও ভোটদাতাদের থাকে না৷ এই অবস্থায় জনসাধারণ তথা ভোটদাতাদের বুথে বুথে হাজিরা দিয়ে দলের নির্দেশ মেনে নিজের ভোটটি দিয়ে আসতে হয়৷ এ ছাড়া অন্য কোন পথ ভোটারদের সামনে থাকে না৷ এই পরিস্থিতি সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে চলতে থাকলে জানতে হবে দেশে গণতন্ত্রের অন্তর্জলী যাত্রা ঘটে গেছে ও পরিবর্তে ‘‘দানবতন্ত্র’’ তার পূর্ণশক্তি নিয়ে রাজত্ব কায়েম করে ফেলেছে৷ এই অবস্থায় দেশের কোন নাগরিকই তার স্বাধীন চিন্তা নিয়ে বাঁচতে পারে না৷ তেমনই ঘটনা হলে কোনও দল বা গোষ্ঠীর আশ্রয় ছাড়া কোন পরিবার দেশের কোথাও বসবাস করার স্বাধীনতা পায় না৷ সামাজিক এই পরিস্থিতির পরও যেদেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না দানবতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পার্থক্য কোথায় এই না বোঝার কারণটি হচ্ছে এই দানবতন্ত্র যে সংসদীয় গণতন্ত্রেরই গর্ভজাত সন্তান তাই এ দুয়ের যথার্থ মূল্যায়ন করতে যে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও শিক্ষার দরকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা ভোটদাতাদের না থাকলেই প্রকৃত সংসদীয় গণতন্ত্র আর থাকে না৷ সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা এখানেই শুরু৷
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল জনসাধারণের অজ্ঞতাই দেশে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সফল হতে দিচ্ছে না৷ অথচ এই অজ্ঞতাকে হটিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র যাতে প্রতিষ্ঠা পায় তার একটা দায়বদ্ধতা থাকে দেশের শিক্ষিত সমাজের৷ কারণ শিক্ষিতরা জানেন, যেসকল দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের গর্ভে ‘‘দানবতন্ত্র’’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার মূলে আছে জনশিক্ষার অভাব৷ কিন্তু জনসাধারণের এই দুর্বলতাকে হটানোর জন্যে দেশে দেশে শিক্ষিত সমাজের কোনও সদর্থক পদক্ষেপ প্রায় দেখাই যায় না৷ পরিবর্তে কোন কোন দেশের শিক্ষিত শ্রেণীর একটা অংশকে প্রশাসনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে সমাজের ওই ত্রুটিকে দীর্ঘস্থায়ী করার সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়৷ উদাহরণ হিসাবে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে ধরা যায়৷ এই রাজ্যটি স্বাধীন ভারতে শিক্ষায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল৷ কিন্তু বাম আমলে এই রাজ্যটি শিক্ষার মানচিত্রে দেশে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে শেষ সারিতে নেমে আসে৷ এই অধঃপতনের জন্যে রাজ্যের বৃহত্তম শিক্ষক সংঘটন এ বি টি এ’র ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না৷ হয়তো এই শিক্ষক সংঘটন রাজ্যের শিক্ষার এই অধঃপতনের দায় কোনদিনই স্বীকার করবে না৷ তারপরও প্রশ্ণ থাকে এ বি টি এ–র মতো প্রচণ্ড শক্তিধর শিক্ষক সংঘটন থাকা অবস্থায়ও রাজ্যের শিক্ষার মান ও উৎকর্ষ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে কেন এই জায়গায় কি তাদের কোনরূপ দায়বদ্ধতা ছিল না
বস্তুত এ রাজ্যের যে সকল বুদ্ধিজীবী এখনো মাথা বিকিয়ে দেননি, তাঁরা সকলেই জানেন, একটা রাজ্যের শিক্ষার মান ও উৎকর্ষকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়ার অর্থ সাধারণ কোন অপরাধ নয়৷ বলা চলে বিশ্বের বিরলতম অপরাধের মধ্যে এটি অন্যতম সংঘটিত অপরাধ৷ কারণ তত্ত্ব বলছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে রাখতে হলে দেশ বা রাজ্যের অভ্যন্তরে যত পঙ্গু শিক্ষিতের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটানো যাবে ততই তা শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর রাজত্বকে পাকাপোক্ত করবে৷ কেননা পঙ্গু শিক্ষিতদের সমস্যা সমাধানের স্বপ্ণ দেখার সাহস থাকে না৷ তাই তাদের সমস্যা বা সমাজের সমস্যার কথা যতই বোঝানো হোক না কেন এদের মনে এসবের কোনই প্রভাব পড়ে না৷ পরিবর্তে সরকার, দল ও শাসক গোষ্ঠীর মোসোহেব বণে সমাজের বুকে অন্ধকার যাতে আরও তীব্রতর হয় তার চেষ্টায় ব্রতী হয়৷ আর এই অন্ধকার অবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এ বি টি এ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাকে হাতিয়ার করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থাসিদ্ধির জন্যে বাজি ধরেছে বললে অত্যুক্তি হয় না৷ কেননা শিক্ষার অধোগতির সামগ্রিক ফলশ্রুতি রাজ্যের ওপর যে এক দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়কারী প্রভাব ফেলেছে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীরা ভাল করেই অনুভব করতে পারছেন৷ তাই দেখা যাচ্ছে পঙ্গু শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালীরা গণতন্ত্র ও দানবতন্ত্রের পার্থক্য কোথায় আজ সেটা বুঝতে পারছেন না৷
এক্ষণে আলোচ্য বিষয় ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে, জনগণের শাসন’ খুবই উৎসাহ ব্যঞ্জক শব্দ, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ কিন্তু এই জনগণের সরকার যারা তৈরী করে তাদের প্রত্যেকে কি দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির গতি, প্রকৃতি ও বৈবহারিক দিকটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল উত্তর হচ্ছে, না৷ কারণ গণতান্ত্রিক দেশেই একশ শতাংশ ভোটার উপর্যুক্ত মূল্যায়নে দক্ষ হতে পারে না৷ উক্ত মূল্যায়নে একান্ন শতাংশের কম ভোটদাতা হলে গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র থাকে না৷ এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে যারা নির্বাচনে ভোট দিয়ে সরকার গড়ল তাদের অধিকাংশই গণতন্ত্রের বিন্দু বিসর্গ জানে না৷ অথচ ভোটদাতাদের যথেষ্ট জ্ঞান ও বোধ শক্তি না থাকলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও জাগ্রত হতে পারে না৷
সুতরাং যে গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচক মণ্ডলীর ৭০ শতাংশ আক্ষরিক অর্থে নির্বোধ তাদের কাছে গণতন্ত্রের মূল্যই কতটুকু ভারতীয় গণতন্ত্রের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই রাজনীতি অর্থনীতি ধর্মনীতি শিক্ষানীতি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের সর্বক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের মুখোশে দানবতন্ত্রের কালো হাত থাবা বসিয়েছে৷ পেছন থেকে মদন দিয়ে যাচ্ছে দেশীয় পুঁজিপতিদের একটা শ্রেণী৷ যাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন ভারতে সব থেকে লাভজনক উপনিবেশ৷
- Log in to post comments