ঝাড়খন্ডের অধিবাসীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ বাঙালী৷ বাড়ীতে এখনও তারা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে৷ পরস্পর ভাব বিনিময়ও বাংলা ভাষাতেই হয়৷ আগে স্কুলগুলিতে বাংলা পড়া হ’ত৷ ব্রিটিশ আমলে তো হ’তই, স্বাধীনতা লাভের পরেও সেই রেওয়াজ ছিল৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পরবর্তীকালে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে বর্তমান ঝাড়খন্ডের অধিকাংশ এলাকা যেমন পূর্ব সিংভূম জেলা, পশ্চিম সিংভূম জেলা, সোরাইকেলা–খরসোঁওয়া জেলা, বোকারো জেলা, ধানবাদ জেলা, দুমকা, দেওঘর, জামতারা, গড্ডা, সাহেবগঞ্জ ও পাকুড় জেলা, তাছাড়া বঁাচী, হাজারীবাগ ও গিরিডি জেলার অংশ বিশেষ– এই সমস্ত এলাকা বাংলা থেকে ছিনিয়ে আগের বিহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ পরে এই এলাকাগুলি নবগঠিত ঝাড়খন্ড জেলার মধ্যে এসে গেছে৷ এই সমস্ত এলাকাই মূলতঃ বাংলাভাষী এলাকা৷ এই সব এলাকার পুরোনো দলিল–দস্তাবেজ সমস্ত বাংলায় লেখা, এই এলাকার শিক্ষার মাধ্যমও ছিল বাংলা৷ পরবর্তীকালে স্কুল–কলেজে বাংলা পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ আর তার স্থান দখল করে হিন্দী৷ এখানে সরকারী কাজও মূলতঃ হিন্দীতে হয়৷ যদিও হিন্দী ঝাড়খন্ডের কারুর মাতৃভাষা নয়৷ বলা বাহুল্য, বিহার ও উত্তর প্রদেশের অঙ্গিকা, ভোজপুরী, মগহী, অবধি প্রভৃতি ভাষাভাষী মানুষের ওপরেও এই ভাবে হিন্দী চাপিয়ে তাদের মাতৃভাষার কন্ঠরুদ্ধ করা হয়েছে৷
ঝাড়খন্ডের উপরিউক্ত এলাকাগুলিতে ঘোরার সময় এই এলাকার মানুষের ক্ষোভের কথা শুণেছি ‘‘আমরা বাড়ীতে বাংলা ভাষায় কথা বললেও স্কুল–কলেজে বাংলা পড়ানো হয় না৷ হিন্দীতেই পড়াশুণা চলে৷ আমাদের ছেলে–মেয়েরা বাংলা অক্ষরও জানে না৷ পশ্চিম বাংলায় আমাদের যে সব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা চিঠি পত্রে যোগাযোগ করতে পারে না৷ বাংলার মনীষীদের লেখা বই পড়তে পারে না৷ মাতৃভাষাকে কন্ঠরুদ্ধ করা আমাদের কাছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক৷’’
এমনিভাবে ঝাড়খন্ডের মোট অধিবাসীর ৬৫ শতাংশই বাঙালী৷ মাহাত জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাও পুরোপুরি বাংলা৷ বাংলার বিভিন্ন কথ্যভাষা – যেমন কাঁথির বাংলা, নদীয়ার বাংলা, মালদহের কথ্য বাংলা, পুরুলিয়া বা ঝাড়খন্ড জেলার মানুষের কথ্য বাংলার মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত অঞ্চলের লেখার ভাষা একই বাংলা ভাষা৷ মনীষীরা বলেছেন, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মত৷ অথচ এখানকার বাঙালীদের তাদের মাতৃভাষার ওপর প্রচন্ড অবদমন চলছে৷ এই ভাবে বাঙালীদের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর চরম অন্যায় ও অত্যাচার করা হচ্ছে৷ বাঙালীদের মাতৃভাষার ওপর এই অবদমনের বিরুদ্ধে একমাত্র ‘আমরা বাঙালী’ দল দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে চলেছে৷ তাদের দাবী মাতৃভাষাকে প্রথম রাজভাষা (সরকারী ভাষা) করতে হবে৷ নামমাত্র দ্বিতীয় রাজভাষার স্বীকৃতি দেওয়া অর্থহীন৷ কারণ, স্কুল–কলেজে বাঙালীরা মাতৃভাষা শিক্ষারই সুযোগ পাচ্ছে না, অফিসে–আদালতে বাংলা ভাষাতে কাজকর্ম হয় না৷ তাই ঝাড়খন্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলাকে ন্যায়তঃ প্রথম রাজভাষা করা উচিত৷ তাহলে স্কুল–কলেজে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হবে, সরকারী অফিস–আদালতের কাজও বাংলাতে হবে৷ আমরা বাঙালীর এই দাবী সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত দাবী৷ অধিকার ভিক্ষার দান হিসেবে পাওয়া যায় না৷ অধিকার অর্জনের জন্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাবী তুলতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে৷ তাই এব্যাপারে ঝাড়খন্ডের সমস্ত বাঙালীরই উচিত ‘আমরা বাঙালী’র হাত শক্ত করা৷
তাছাড়া আমরা বাঙালী এলাকার দরিদ্র মানুষের উপকারের জন্যে, দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধানের জন্যে প্রাউটের সুসন্তুলিত অর্থনীতি তথা ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার রূপায়ণের দাবী রাখছে৷ কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে কর্ষক–সমাজকে বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মুক্ত করার দাবী রাখছে৷ এমনিভাবে এলাকার সমস্ত অধিবাসীকেই শোষণমুক্ত করার, সকলের আশা–আকাঙক্ষা পূর্ণ করার কর্মসূচী নিয়ে আমরা বাঙালী সুপরিকল্পিত ভাবে এগিয়ে চলেছে৷ তাই সর্বাত্মক শোষণমুক্তির জন্যে যাঁরা এই ভাবে সর্বাত্মক শোষণমুক্তির আন্দোলন করে চলেছে তাদের পাশে দাঁড়ানো সবার কর্তব্য মনে করি৷
- Log in to post comments