কল্যাণ চেতনার হীরে মানিক

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

প্রতিটি প্রাণীন সত্তাকে স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্য বিকশিত হয়ে উঠতে দেওয়াটা যেমন স্বাভাবিক---তেমনি আপন স্বভাব ধর্ম অনুযায়ী হয়ে ওঠাটাও স্বাভাবিক৷ আর এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম (ল অব্‌ দ্য নেচার), স্রষ্টা প্রদত্ত জন্মগত অধিকারও বটে৷ সমাজে এই নিয়ম যেখানেই ভাঙা হয়েছে সেখানেই শোষণ-বঞ্চনা, দমন - অবদমন - প্রদমন, অত্যাচার অবিচার, নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু হয়েছে৷ ঘুরিয়ে বললে ব্যাপারটা দাঁড়ায়---শোষকরা, সাম্রাজ্যবাদীরা, পরস্ব অপহরণকারী, আধিপত্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে যুগে যুগে দেশে দেশে এখানেই চরম আঘাত করে থাকে, অন্যথায় তাদের স্বার্থসিদ্ধি অসম্ভব৷ এখন দেখা যাক---মানুষের ক্ষেত্রে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বেড়ে ওঠার প্রাকৃতিক শর্ত তথা সূত্রগুলো কী৷ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বেড়ে ওঠার প্রাকৃতিক শর্তই হচ্ছে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর আপন আপন প্রাণধর্মে আত্মস্থ হওয়া ও তাকে রক্ষা করাও পুষ্টি ঘটানো৷ দ্বিতীয় কথা হচ্ছে---কোন জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব-ক্রমবকাশ ও নির্নায়ক স্তর অবধি আধার-ভূখণ্ডের বা ভৌগোলিক অঞ্চলের বন্ধনকে অটুট রাখা৷ কেননা এই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়েই সৃষ্টি হয় প্রকৃতিদত্ত অর্থনৈতিক বুনিয়াদ, ভাষা-সংস্কৃতি, সামাজিক ঐতিহ্য,আর আত্মরক্ষার শক্তিসামর্থ তথা প্রতিবাদী চরিত্র বা বিচারশীলতা৷ তৃতীয় শর্ত হচ্ছে---জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষার (ন্যাচারাল্‌ ল্যাঙ্গুয়েজ) ব্যবহার ও তার সুরক্ষা, পুষ্টি ও বিকাশ৷ ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্দ সম৷ বিনা স্বদেশী ভাষায় মিটে কী আশা৷ ভাষা তো সংস্কৃতির ধারক ও বাহক৷ আবার ভাষাকে ভর করেই গতি পায় ভাষা-রাজনীতি, ভাষা-অর্থনীতি ও ক্ষত্রায়ন- যা বাদ গেলে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা সম্ভব হয় না৷ চতুর্থ শর্ত হচ্ছে---প্রতিটি জনগোষ্ঠীর বাসভূমি বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ঘটন বৈশিষ্ট্য যেন একটা স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চলের হয়৷ কেননা স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চলেই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার বা বেঁচে থাকার নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির রসদ (অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা---পাঁচটি মৌলিক চাহিদা) সহজলভ্য হয়৷ স্বয়ম্ভরতা না থাকলে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়---যা মানুষকে বা কোন জাতিকে বা কোন দেশকে শোষণ অবদমন-বঞ্চনার শিকার হতে হয়৷ পঞ্চমতঃ স্বাভাবিক বিকাশের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে সব বিষয়ে বিশেষ করে আঞ্চলিক অর্থনীতিতে শতকরা একশত ভাগ স্থানীয়ত্বকেই অগ্রাধিকার দেয়া, গুরুত্ব দেয়া বা মাত্রা দেয়া৷ কেননা অর্থনীতিতে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ, কর্মক্ষেত্রে শতকরা ১০০ভাগই স্থানীয় মানুষকে নিয়োগের নিশ্চিততা ও বাধ্যবাধকতা না থাকাটা, অন্য অঞ্চলের ভাষা-সংস্কৃতির আধিপত্য-আগ্রাসন, আপতকালীন পরিস্থিতি ছাড়া অহেতুক বিদেশী দ্রব্যের ওপর নির্ভরতা, ভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত যে কোন ভৌগোলিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই বিকাশ-উদ্বর্তনা তো দূরের কথা---অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে৷ ---বলাবাহুল্য, এগুলোর সামবায়িক রসায়নে কোন গোষ্ঠীবদ্ধ মনুষ্যকুল স্বাতন্ত্র্য চিহ্ণিত হয়ে ওঠে ‘জাতিসত্তা’ (এথনিসিটি) পরিচয়ে৷ প্রকৃতিও তার কোলের  সন্তানদের সস্নেহে বিশেষ চেহারার আদল দান করে---যা বহুর মধ্যে থেকেও আলাদা করে চেনা যায় তাদের চেনা যায় ভাষায়, আদব কায়দায়, জীবনচর্যায়, খাদ্যাভাসে, সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশে ও ভিন্ন ধরণের বিশেষ রীতিনীতিতে৷ জাতিসত্তার পরিচয়ে এগুলো মোটামুটি স্থায়ী ব্যাপার---যা পাল্টানো যায় না, অন্যের ছাঁচে ঢেলে নোতুন করে গড়াও যায় না৷ এগুলোই একটা জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখে, বিনে সুতোর মালার মত সঙ্গবদ্ধ করে রাখে৷ সমুদ্রে পড়ে নদীর হারিয়ে যাওয়ার মতই ভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে আসা মানুষও স্থায়ী বাসিন্দা হলে বহু কালের ব্যবধানে অমুক  দেশীয় বংশোদ্ভূত বললেও সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়৷ এই সংকরায়নে অভিনবত্ব-নোতুনত্ব বিশেষত্বর প্রকাশ ঘটে, কিন্তু আলাদা করে  মেলানো যায় না৷ আর এই ভাবেই বিশেষ বিশেষ ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে কালের ব্যবধানে প্রকৃতিগতভাবে ও সামাজিক অনুঘটকে রেস থেকে এল এথনিসিটি---চেহারায় ও স্বভাবে স্বাতন্ত্র্য চিহ্ণিত এথ্‌নিক্‌ আইডেনটিটি৷ আর একেই ভর করেই ঘটে মানুষের স্বাভাবিক বিকাশ৷ কথাটা যেমন বাঙলা ও বাঙালীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর, প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ অবশ্য এর নেপথ্যে আছে একটা অনুভব৷ অর্থাৎ কেউ পৃথিবীর যে প্রান্তের মানুষই হোন না কেন, যে জনগোষ্ঠীরই পরিচয় বহন করুণ না কেন স্পেসিস্‌ হিসেবে অখণ্ড মানব জাতির সাধারণ গুণ বা স্বভাব-বৈশিষ্ট্য এরই মাঝে বর্তমান৷ কেননা  স্পেসিস্‌ হিসেবে প্রতিটি একক মানুষেরই উৎস এক --- অম্‌নিশিয়্যাণ্ট - অমনিপ্রেজেন্ট -অম্‌নিপটেন্স্‌ এক অনন্ত শক্তি থেকে৷ প্রতিটি একক মানুষেরই লক্ষ্য এক--- বাইরের জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে সেই অনন্তেই সমাহিত হওয়া---অর্থাৎ পূর্ণ হয়ে ওঠা৷ প্রতিটি একক মানুষেরই আঁতের কথা হল সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা - সহমর্মিতা -সহভাবিতায় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে চলা-কেউ আগে এগিয়ে যাবে না---কেউ পিছনেও পড়ে থাকবে না, রেস্‌-এথ্‌নিসিটি গোত্র - জাতি - বর্ণ-ধর্ম- গরীব, বড়লোক নির্বিশেষে এ জগতে প্রত্যেকের সমান মর্যাদা-সমান গুরুত্ব- সমান অধিকার বৈচিত্র্য প্রাকৃত ধর্ম---তাই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করা ও শ্রদ্ধা করা৷ এই অনুচিন্তন বা আদর্শই অর্থাৎ বিশ্বৈকতাবাদের অনুশীলন ও অনুসরণ মানুষকে তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে বেড়ে ওঠার পথ সুগম করবে৷