প্রভাতী

শেষ মেষ হয় শেষ

লেখক
শিবরাম চক্রবর্তী

বঙ্গ সন্তান

          (রাজা) রামমোহন রায়

          নতুন ইতিহাস গড়তে,

সতীদাহ প্রথা রোধে

          আগেই গেলেন লড়তে৷

একসময় স্বামী মরলে

          সতীদাহ প্রথায়,

হিন্দু নারীর চিতায় তুলতো

          বলপ্রয়োগের দ্বারা৷

বীভৎস সেই দৃশ্য দেখে

          রামমোহনের মনে,

ভীষণভাবে পীড়া দিতেই

          ভাবতেন সর্বক্ষণে৷

হিন্দু শাস্ত্র ঘেঁটেঘুটে

          এমন প্রমাণ কিছু

যুক্তির তেমন না পেয়ে সার

           দেখেন অন্য কিছু৷

স্বামী মরলে তাঁর ভাগের

          অংশ স্ত্রীও পায়

সেই পথ রুখতে,

          শ্বশুর বাড়ীর লোক

(সতীদাহ প্রথায়)

          মারার পথ বেছে নেয়৷

ভাল কথা বুঝালেও

          এ পথ কেউ না ছাড়ে,

মানবতার খাতিরে তাই

(রামমোহন) এবার

                   তাঁর জেদ বাড়ে

শক্ত হাতে আইনের পথে

          রাজা রামমোহন রায়,

সতীদাহ প্রথা বিলোপ

          করে’ মহান হয়৷

মানুষের দায়

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

জঙ্গল কেটে সাফ করে শুরু

 নগরের পত্তন,

অজ্ঞাতসারে আহ্বান জানাই

 মরুভূমির জাগরণ৷

অনাবৃষ্টির করাল গাসে

মাটি ফেটে যায় ক্ষরায়,

তরুলতা বন শুকাইয়া যায়

 সবুজ ক্ষেত্র হারায়৷

বায়ু দূষণের প্রাদুর্ভাবে

 কমে যায় প্রাণবায়ু,

জীব নরকুল অকালে তাদের

 হারায় পরমায়ু৷

 একটি গাছ একটি প্রাণ,

সে গাছ লাগিয়ে হও সুমহান৷

যে গাছ মোদের দেয় ফুল, ফল,

 পক্ষী নীড় ও ছায়া সুশীতল,

সেই তরুতলে ভরে দিও জলে

 সেতো বাঁচিবার সম্বল৷

 

কু–ৰুদ্ধির খপ্পরে সুৰুদ্ধি রায়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

 

ব্যঞ্জনের বর্গীয় বর্ণমালার আদিতে ‘ক’ বর্গের প্রথম বর্ণ ‘ক’, অন্তে ‘প’ বর্গের শেষ অক্ষর ‘ম’৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, কেন আগে ‘ক’, আর শেষে ‘ম’ এই জগৎ সৃষ্টি–স্থিতি–লয়াত্মক্৷ সৃষ্টির ৰীজ ‘অ’৷ তাই স্বরবর্ণে যত অক্ষর আছে তাদের সৰার আগে ‘অ’৷ আগে সৃষ্টি, তবে তো অন্য কিছু৷ তারপরে পালনের ৰীজ ‘উ’ আর প্রণাশের ৰীজ ‘ম’৷ তাই সৃষ্ট জগৎ এই অ–উ–ম তিন ধ্বনিতে বিধৃত৷ এই তিন ধ্বনির মিলিত নাম ‘ওম্’ (ূউূমঞ্চওম্)৷

‘ক’ হ’ল কার্যব্রহ্মের ৰীজ অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের একটি অংশ কারণ রূপে রয়ে গেছেন, অন্য অংশটি কার্যরূপ পরিগ্রহ করেছে৷ একটি অংশ ড্র্ত্রব্ভব্দ্ত্রপ্ত, অপর অংশ তাই এই ‘ক’ কে ৰৌদ্ধদর্শনে বলা হয়ে থাকে ‘সংবৃত্তিৰোধিচিত্ত’৷ তাই যেহেতু কার্যকলাপের বীজ ‘ক’, তাই ‘ক’–ই প্রথম ব্যঞ্জন আর ‘ম’ যেহেতু প্রণাশের ৰীজ তাই ‘ম’ শেষ বর্ণ৷

হ্যাঁ বলছিলুম ওঙ্কারের কথা৷ এই অ–উ–ম নিয়ে ‘ওম্’৷ এই ‘ওম্’ কিন্তু অভিব্যক্ত জগতের জন্যে৷ অভিব্যক্ত ও অনভিব্যক্ত এতদুভয়ের জন্যে যদি কোন ধ্বন্যাত্মক ৰীজ ব্যবহার করতেই হয় তাহলে ‘ওম্’ লিখলে চলৰে না – লিখতে হবে ‘ওঁম্’৷ এক্ষেত্রে ‘ও’ এর মাথায় যে ৰিন্দু চিহ্ণটি রয়েছে সেটি নির্গুণ ব্রহ্মের দ্যোতক৷ নির্গুণ ব্রহ্মকে মুখেও বলা যায় না৷ তাই অক্ষরে লিখতে গেলে যে সর্বাল্প স্থান লাগে সেটি বিন্দু দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করা হয় (বিন্দুর অবস্থান আছে কিন্তু পরিমাণ নেই৷ ট্ট হ্মপ্সনুব্ধ ড়্ত্রব্দ ন্ধপ্সব্ধ হ্মপ্সব্দন্ব্ধন্প্সু, ত্ব্ব্ভব্ধ প্স প্প্ত্রন্ধুন্ব্ধব্ভস্তুন্দ্) আর ৰিন্দুর নীচে কতকটা চন্দ্রকলার মত যে দীর্ঘায়ত চিহ্ণ, সেটা নির্গুণ থেকে সগুণে রূপান্তরণের দ্যোতক৷ একে সংস্কৃত ভাষায় নাদ ৰলা হয় অর্থাৎ নির্গুণা সংস্থিতি নাদ বা ধ্বনির সাহায্যে সগুণ ব্রহ্মে রূপান্তরিত হচ্ছে৷ একথা মনে রেখো, এটা ঠিক চন্দ্রবিন্দু বলতে যা ৰোঝায় তা নয়৷ এটা কতকটা ৰাংলায় ঈশ্বর চিহ্ণের  ( ) মত৷ প্রাচীন প্রথানুযায়ী আজও মৃত মানুষের নামের পূর্বে এই নাদ ৰিন্দু–চিহ্ণটি (চন্দ্রৰিন্দু ৰলা ঠিক হৰে না) ব্যবহার করা হয়৷ পড়বার সময় এই নাদৰিন্দুকে পড়ি ‘ঈশ্বর’ ৰলে৷ জীবিত অবস্থায় যে মানুষটির নাম শ্রীকুমুদ চন্দ্র মাইতি, মৃত্যুর পরে তার নামের পূর্বে আর ‘শ্রী’ ব্যবহার করা যাৰে না৷ নাদৰিন্দুর ঠিক পরেই লিখতে হবে কুমুদ চন্দ্র মাইতি, ( কুমুদ চন্দ্র মাইতি) আর পড়বার সময় পড়তে হবে ‘ঈশ্বর কুমুদ চন্দ্র মাইতি’৷

এই ওঙ্কারের অপর নাম প্রণব যার ভাবরূঢ়ার্থ হচ্ছে– যে সত্তা লক্ষ্যের দিকে প্রেষিত করে৷ তোমরা হয়তো জানো, প্রাচীন কালে সেই কুসংস্কারের যুগে এই ‘ওঙ্কার’ উচ্চারণ করার অধিকার সবাইকার ছিল না৷ অন্ত্যজ জাতি ও নারীরা ওঁম্ উচ্চারণ তো করতে পারতেনই না, তাঁদের শোণার অধিকারও খর্ব করে দেওয়া হয়েছিল৷ কেউ ওঙ্কার ধ্বনি কাণে শুণলে, শোণা যায়, – তার কাণে সীসে গলিয়ে ঢ়েলে দেওয়া হত যাতে চিরদিনের জন্যে তার শ্রুতিশক্তি শেষ হয়ে যায়৷ কী কুসংস্কারের যুগই না ছিল! জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এই কুসংস্কার পরিব্যাপ্ত ছিল৷ কেবল যে নারীদের ওপরই এই নির্যাতন চলত তাই নয়, পুরুষদেরও এজন্যে কম ভোগান্তি হয় নি৷ হঠাৎ সামাজিক কুসংস্কারের একটা গল্প মনে পড়ে গেল৷ গল্পটা পাঠান যুগের সুৰুদ্ধি রায়কে নিয়ে৷ সুৰুদ্ধি রায় ছিলেন পাঠান যুগের ৰাঙলার প্রধান মন্ত্রী৷ তাঁর সামাজিক সম্মানও (আমি ইচ্ছে করেই সামাজিক ‘মর্যাদা’ শব্দটা ব্যবহার করলুম না৷ ‘মর্যাদা’ শব্দটার যথার্থ মানে হচ্ছে সীমারেখা বা গণ্ডী৷ ৰাংলায় ভুল করে সম্মান অর্থে ‘মর্যাদা’ শব্দের ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা না করাই বাঞ্ছনীয়) ছিল যথেষ্ট৷ কিন্তু কোন এক ঘটনায় তাঁর মুখে বদনার পানী লেগে যায়৷ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সভা ৰসল৷ তাঁরা ৰললেন – এক একটা গুরুতর পাপ........ গুরুতর অপরাধ৷ এজন্যে সুৰুদ্ধি রায়কে প্রায়শ্চিত্ত করতে হৰে৷ হ্যাঁ, ৰলতে ভুলে গেছলুম, সুৰুদ্ধি রায় ছিলেন সে কালের ব্রাহ্মণদের গোষ্ঠীপতি ....... ব্রাহ্মণদের প্রতিভূ৷

সেই সুৰুদ্ধি রায়ের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ সমাজ খড়গহস্ত হয়ে উঠল৷ সুৰুদ্ধি রায়ের মুখ ভয়ে ভাবনায় আমশি৷ (আম্রপেশী ঞ্ছ আম্বত্রশী ঞ্ছ আমোশি ঞ্ছ আমশি৷) প্রায়শ্চিত্তের বিধান নেৰার জন্যে তাঁকে নবদ্বীপের পণ্ডিতদের শরণাপন্ন হতে হল৷ নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন তূষানল প্রায়শ্চিত্তের৷ তূষানল প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে ধানের তূষকে আগুনে গনগনে লাল করে দিয়ে অপরাধীর সামনে ঢ়েলে রেখে দেওয়া হত অপরাধীর দৈহিক উচ্চতার ৬৪ গুণ পরিমিত ভূমিতে৷ অপরাধীকে তার ওপর দিয়ে নগ্ণ পায়ে হঁেঁটে যেতে হৰে৷ তার পরেও যদি সে ৰেঁচে থাকে, তাহলে ৰুঝতে হৰে তার প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে৷ আর যদি মরেই যায় তো ফুরিয়ে গেল৷

এই তূষানল প্রায়শ্চিত্তের ভয়ে সুৰুদ্ধি রায় গেলেন কাশীতে৷ রাজা সুৰুদ্ধি রায় ভাবলেন কাশীর পণ্ডিতরা তো আরও ৰড়.......... আরও তাগড়া তাগড়া৷ তাঁরা অন্য কোন বিধান দিলেও দিতে পারেন৷ সেখানে গিয়ে তিনি পণ্ডিতদের কাছে সৰ কথা খুলে ৰললেনঃ           ‘‘প্রায়শ্চিত্ত পুছিল তেঁ পণ্ডিতের স্থানে

          তারা কয় তপ্ত ঘৃত খাইয়া ছাড় প্রাণে৷’’

কাশীর পণ্ডিতেরা ৰললেন – নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা কিস্সু জানেনা৷ এজন্যে বিধান হচ্ছে তপ্ত ঘৃত৷ ঘি খুৰ গরম করে গলিয়ে তরল করে সেই ঘি পান করতে হৰে৷ আর ততক্ষণ ধরে পান করতে হৰে, যতক্ষণ না মৃত্যু হচ্ছে৷ একেই ৰলে ‘তপ্তঘৃত প্রায়শ্চিত্ত’৷ রাজা সুৰুদ্ধি রায় দেখলেন, রামে মারলেও অপঘাত মৃত্যু, রাবণে মারলেও অপঘাত মৃত্যু৷ তার চেয়ে ভাল বরং গঙ্গায় ডুৰে মরা৷

রাজা সুৰুদ্ধি রায় গঙ্গার ঘাটের দিকে চললেন৷ এদিকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব তখন নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবনের পথে কাশীতে অল্পকাল থেকে যাচ্ছেন বৃন্দাবনের দিকে৷ সুৰুদ্ধি রায়কে সেই অবস্থায় দেখে তিনি ভাবলেন – লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষিত, সম্মানিত অথচ মুখে বিষাদের ছায়া, কপালে চিন্তার ৰলিরেখা! এই অসময়ে গঙ্গার দিকে যাচ্ছে – জিনিসটা সন্দেহজনক৷ চোখ–মুখ দেখে মনে হয় লোকটি ৰাঙলারই মানুষ৷ তিনি তাঁকে শুধোলেন –

কী হয়েছে আপনি কে কোথায় চলেছেন

সুৰুদ্ধি রায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সৰ কথা জানালেন৷ মহাপ্রভু চৈতন্যদেব পণ্ডিতদের অমানুষিক কার্যকলাপ দেখে তো অবাক! তিনি তাঁদের তীব্র ভাষায় ধিক্কার দিয়ে

ৰললেন ঃ

‘‘প্রভু কয় ইহা হৈতে যাও বৃন্দাবন

নিরন্তর কৃষ্ণনাম কর সংকীর্ত্তন৷

এক নামাবেশে তোমার পাপ দূরে যাৰে

আর নাম লইতে কৃষ্ণ শরণ পাইৰে’’৷

মহাপ্রভু ৰললেন, ‘‘ওসৰ ধাপ্পাৰাজীর ৰশে থেকোনা৷ চল বৃন্দাবন৷ কৃষ্ণের নাম নাও৷ ওই ৰদনার পানীর পাপ একবার ‘কৃষ্ণ’ ৰললেই দূর হয়ে যাৰে৷ আর দ্বিতীয়ৰার কৃষ্ণ ৰললে ৰুঝবে তুমি কৃষ্ণের শরণেই এসেছো৷ সুৰুদ্ধি প্রাণে ৰাঁচলেন৷ সামাজিক অত্যাচারের যূপকাষ্ঠ থেকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব তাঁর মাথাটা উদ্ধার করে দিলেন৷

বাচ্চারা আনন্দ পায় না বলে স্কুলে আসে না৷

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

এক বৃদ্ধ শিক্ষক সেদিন এলেন পড়াবার জন্য৷

---আচ্ছা লেখো তো, এক অক্ষরে ‘ডাকাত’৷

কেউ লিখতে পারলো না৷

তিনি ‘ডা’ কাত করে লিখে বললেন- এই হলো ‘ডাকাত’৷

সবাই হেসে হেসে কূটিকূটি৷

আচ্ছা এবার বলো তো কীভাবে এক অক্ষরে ‘কাতলা’ লিখবে৷

সবাই আবার অবাক৷

শিক্ষক ‘লা’ কাত করে লিখে বললেন--- এই হলো কাতলা৷

শিশুরা হাসছে তো হাসছে৷

তারপর তিনি ‘কা’ লিখে মুছে দিয়ে বললেন--- বলো এবার কী লিখলাম৷

সবাই আবারো অবাক৷

তিনি বললেন--- এবার লিখলাম কানাই৷

শিশুদের হাসির রোল উঠলো৷

এবার তিনি ছাত্রদের বললেন-- বলো তো আমি কেমন পড়ালাম৷

ছোট একটা শিশু দাঁড়িয়ে বললো--- আপনি আমাদের আজ কিছুই পড়ান-নি৷

কিছুই পড়াইনি! কি বলো!

এবার শিশুটি বোর্ডে গিয়ে একটা সূর‌্য আঁকলো৷ সূর‌্যের চারপাশে কিরণ এঁকে বললে--- আজকে রবি শুধু তার আলো ছড়িয়েছে৷

এই স্কুলটি হলো শান্তিনিকেতন

শিক্ষক টি কে জানেন?

’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’

আর বোর্ডে যে ছাত্রটি এঁকেছিলেন, তিনি ছোট্ট ‘‘সত্যজিৎ রায়’’৷   (সংগৃহীত)

ঝরা ফুল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

ও ঝরা ফুল, হায় ঝরা ফুল,

স্তব্ধ তোমার দোদুল দুল৷

বৃন্ত হতে তোমার ধূলায় পতন

আকাশ হতে তারা খসার মতন৷

প্রখর রৌদ্র ঝড়-বৃষ্টি

শীতল শিশির পাত---

তবুও রঙিন পাপড়ি মেলে

দুলেছো দিনরাত৷

নয়ন শোভনরূপে তোমার

হালকা মিঠে গন্ধে৷

মন মেতেছে বন হেসেছে

পুলকে আনন্দে৷

মধুপায়ী মৌমাছিরা

তোমায় ঘিরে রোজ হাজিরা,

বুক ভরা সুধা মিটিয়েছো ক্ষুধা

অকৃপণ মধু দানে

মউমাছিদের করেছ তৃপ্ত

বাৎসল্যের টানে৷

স্তন্যদাত্রী নারীর মতন

দেখেছি মাতৃরূপে

হায় ঝরা ফুল, আজ যে তুমি

আবর্জনার স্তূপে৷

প্রশ্ণ

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

বলতে পারো সূর্যিমামা

 ভোরে কেন ওঠে,

কুঁড়ি কেন সকাল বেলা

 ফুল হয়ে ফোটে?

ঝর্ণা কেন নৃত্য করে

 একই ছন্দ ধারায়,

নদী কেন কলতানে

 সাগর মাঝে হারায়?

মহাকাশের তারার মালা

 কেন অনিদ্রাতে,

ধ্রুবতারা কেন সাথে

 নিশিথে পথ দেখাতে?

 সাগর পরে ঊর্মি কেন

 নাচে উচ্ছ্বল ছন্দে,

ভ্রমর, অলি কেন জোটে

 কুসুমের সুগন্ধে?

জোনাকি কেন আলো জ্বেলে

 সন্ধ্যা আরতি করে,

ঝিঁঝিঁ কেন খেয়াল গায়

 বনে ঝোপে-ঝাড়ে?

ময়ূর কেন পেখম তুলে

 আকাশে মেঘ হলে,

চাতক কেন তৃষ্ণা মেটায়

 কেবল বৃষ্টি জলে?

 কুহু সুরে কোকিল ডাকে

 কি কথা সে বলে,

মধুপ কেন ফুল বাগানে

 আসে দলে দলে ?

পাখিরা কেন এত স্বাধীন

 যখন খুশি ওড়ে,

দখিনা পবন শিষ দিয়ে বলে,

 পরমপিতার বরে৷

খ্যাটনভোঁদড় ভট্টাচার্য

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘খেট্’ একটি প্রাচীন ধাতু৷ ধাতুটি পরস্মৈপদী’৷ এর ক্রিয়ারূপ দু’ধরণের৷ ‘লট্তি’–তে যদি বলি ‘খেটতি’ তার মানে হবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা বা পা’ টেনে টেনে চলা৷ যদি ক্রিয়ারূপে বলি ‘খোটয়তি’ তাহলে তার একটি মানে হবে ঔদরিকের মত অতিভোজন করা৷

সেই যে তোমাদের একবার গল্প বলেছিলুম না–কে একজন ছিলেন খ্যাটনভোঁদড় ভট্টাচার্য৷ তিনি আগে থেকে উপযুক্ত প্ল্যানিং বা পরিকল্পনা না করেই খেতে বসেছিলেন, যার ফলে প্রায় আশিটি লুচি, পটোলভাজা, বাঁধাকপির ডালনা আর আলুর দম দিয়ে খাবার পরে খেয়াল হল আরও বাকী রয়েছে ক্ষীরের দই, বাকী রয়েছে রাবড়ি, রয়েছে রসমালাই আর রসমাধুরী৷ নিজের পরিকল্পনা না থাকায় আত্মগ্লানিতে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন৷ বললেন–আমার মত বোকা ভূ–ভারতে আর কেউ আছে গা৷ হায় হায়! একী করলুম৷ প্রাচীনকালের মুনি–ঋষিরা বলে গেছেন ‘‘পরের পয়সায় পাই তো টিংচার আয়োডিন খাই৷ আমি কিন্তু সে সুযোগ হেলায় হারালুম৷ আচ্ছা দেকা যাক, ছাঁদায় পুষিয়ে নেওয়া যাবে৷ তারপরে ক্ষীরের দই এলে সেকালে ক্ষীরের দইকে উত্তর বাংলায় চন্দনচুর বলা হত৷ পাবনার চন্দনচুর ছিল ডাকসাইটে৷ তখন তিনি জোর করে কয়েকটা ঢ়োক গিলে খাওয়া জিনিসটা নাভির অনেকটা নীচের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন–আপাততঃ চার হাতা ঢ়ালো পরে দেখা যাবে৷ এর পরে দিয়ে গেল রসমালাই৷ তখন তার আলজিব প্রায় ডুবুডুবু৷ বারবার ঢ়োক গিলে রসমালাইকে নীচের দিকে ঠেলে দেবার আপ্রাণ প্রয়াসের পর তিনি বললেন –আরেকটু পরে আবার শুধিয়ো৷ তারপর যখন রসমাধুরী এল তখন তার ঠোঁট ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যাবার জোগাড়৷ আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনি খাবারগুলোকে ঠেলে ভিতরে পাঠানোর কাজটা চালিয়ে যেতে লাগলেন৷ লোকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল৷ ডাক্তার এসে বললেন –আপনাকে ওষুধ দিচ্ছি৷

খ্যাটনভোঁদড় ভট্টাচার্য বললেন–ওষুধের পরিমার কতটা

ডাক্তার বললেন–আন্দাজ দশ ফোঁটা, বড় জোর৷

খ্যাটনভোঁদড় বললেন –মুখে যদি (পেট, গলা তখন ভরে গেছে) দশ ফোঁটা ওষুধ যাবার জায়গা থাকত তাহলে ওষুধ খেতে যাব কার অভিশাপে৷ খাব তো খাব দশফোঁটা রসমালাইয়ের রস খাব৷

এই যে খ্যাটনভোঁদড় ভট্টাচার্য, ইনি কী করছিলেন, –না ইনি ‘খোটয়তি’ করছিলেন, বুঝলে তো৷ তোমরা মনে মনে একটা ব্রতই নাও যে কিছুতেই খ্যাটনভোঁদড় ভট্টাচার্যের মত ‘খোটয়তি’ করবে না৷

(শব্দ চয়নিকা, ১৫শ খণ্ড)

ষষ্ঠীর দিন তুষ্টি

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

মূলত জামাইদের নিয়ে জামাইষষ্ঠী৷ ঐ দিন জামাইকে নিমন্ত্রণ করে শ্বশুড়বাড়ি আনা হয়৷ শ্বাশুড়ি জামাইকে বাঁটা দেন৷ জামাইরা এই দিন বিশেষভাবে আপ্যায়িত হন৷ জামাইষষ্ঠী একটি ব্রত৷ অন্যান্য ব্রতের মত এরও ‘কথা’ আছে৷ ব্রতের সমস্ত অনুষ্ঠান মেয়েরাই করে৷ পুরোহিতের কোন ভূমিকা নেই৷

বটের ডাল মাটিতে পুঁতে ঘট্‌ সাজিয়ে ষষ্ঠী পুজো করা হয়৷ বরকে বাঁশের পাতা, আম কাঁঠাল ও নানাবিধ ফল বাঁটায় সাজিয়ে খেতে দেওয়া হয়৷ পূর্ববঙ্গে ষষ্ঠীর দিন শুধু জামাইদের নয়, ছেলেমেয়েদেরও তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করা হয়৷ অঞ্চল বিশেষে বাঁটায় ছোট ছোট তালপাতার পাখা ও তালপাতার কাটি দিয়ে তীর ধনুক বানিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়৷ কোন কোন জায়গায় জামাইষষ্ঠীতে দই নিলাম হয়৷ পরিবারের সবাই একে একে নিলামে দর তুলতে থাকে৷ জামাইকেও দর দিতে হয়৷ ডাক দিতে দিতে জামাই যদি নিলামে হেরে যায় তাহলে তাকে কাদা মাখিয়ে শালা শালীরা নানারকম রঙ্গ রসিকতা করে৷ আর সবচেয়ে বেশি দর দিয়ে দইয়ের নিলামে যদি জামাই জিতে যায় তাহলে জামাইয়ের গায়ে দই মাখিয়ে আমোদ করা হয়৷

প্রাউট প্রবক্তার শুভ আবির্ভাবে

লেখক
প্রভাত খাঁ

মনে রেখো সবে ধরনীর

সবকিছু স্থাবর জঙ্গম

একই সাথে একই তালে

নেচে চলে সেই অনন্তের পাণে৷

 

সবাই আপন জেনো সুদৃঢ় বিশ্বাসে

একই সূত্রে বাঁধা আত্মীয় স্বজন,

একই বোধ জাগরণে

পরমারাধ্য পি.আর সরকার

এসেছিলেন আমাদের মাঝে

মনোময় প্রাণময়, প্রিয়তম

হয়ে শতবর্ষ অধিক আগে৷

 

সেই ২১শে মে এর আনন্দপূর্ণিমা তিথিতে

শতবর্ষ অধিক পূর্ত্তি হয়ে যায়

তাঁর শুভ আবির্ভাবে৷

তাঁর প্রভাত সঙ্গীত বিশ্বময় জাগায়েছে

নব জাগরণ সুমধুর তাল ও লয়ে৷

তাঁর প্রদত্ত অধ্যাত্ম অষ্টাঙ্গিক সাধনা

মনো জগতে এনেছে মুক্তি মোক্ষের স্বাদ

যা নিয়ে আসে সাধকের আত্মিক সাধনে৷

পূর্ণতা পায় এ জীবনে একই জনমে৷

 

হিংসা, দ্বেষ, জাত,পাত, সংকীর্ণতা

সব কিছু সরে যায় মন থেকে,

বিরাটের পদতলে লীন হয় সকল চিন্তন,

ধন্য হয়, মানব জীবন তাঁরই করুণায়৷

তাঁর বিশল্যকরনী স্বরূপ প্রাউট

দর্শন নিয়ে আসে ধরনীর বুকে

এক নব্যমানবতাবাদী চেতনা

যা সকলের মেটাবে ত্রি এষনা৷

 

যার বাস্তবায়নে তাপদগ্দ

বসুন্ধরা নিষ্ঠুর শোষণমুক্ত এক

বিরাট পরিবারে পরিণত হবে

অদূর ভবিষ্যতে৷

যার নাম হবে এক শোষণহীন মানব সমাজ৷

তাই এই পুন্যতিথিতে এসো সকল ভাইবোন

এক হই ভেদাভেদ ভুলে একই পতাকাতলে

প্রার্থনা জানাই তাঁর শ্রীচরণ কমলে

লক্ষ্য ভ্রষ্ট না হই যেন আদর্শের বাস্তবায়নে৷

দানও নিলেন, দক্ষিণাও নিলেন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

একটি প্রাচীন ৰাংলা গানে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি কোদাল অর্থে ব্যবহূত হয়েছিল৷ গানটি রচনা করেছিলেন সুবিখ্যাত পাঁচালী গায়ক দাশরথি রায়–সংক্ষেপে দাশু রায়৷ ৰাংলার এই জন্মসিদ্ধ প্রতিভা দাশু রায় কবিতায় কথা বলতে পারতেন......পারতেন গানেও কথা বলতে৷ সংস্কৃত শাস্ত্রেও ছিল তাঁর প্রচণ্ড দখল......আর প্রচণ্ড দখল ছিল যেমন ৰাংলায় তেমনি সংস্কৃতেও৷ তার সঙ্গে তিনি ছিলেন মজলিশী মেজাজের মানুষ৷ লোককে হাসাতে পারতেন দারুণ৷

সেই যে গল্প আছে না! দাশু রায় একবার ৰর্দ্ধমান জেলার একটা প্রকাণ্ড মাঠ পার হচ্ছিলেন৷ সেকালে ৰর্দ্ধমান জেলার গ্রামগুলি ছিল খুব ৰড় ৰড় আর দূরে দূরে অবস্থিত৷ এখনও দেখবে, ৰাংলার ৰড় ৰড় গ্রামগুলির বেশীর ভাগই ৰর্দ্ধমান জেলায়৷ সেকালের সেই মাঠে রাত্তিরে তো বটেই, এমনকি দিনে দুপুরেও লেঠেলরা ওৎ পেতে বসে থাকত রাহাজানির উদ্দেশ্যে৷ একবার দাশু রায় ওই ধরনের একটা ৰড় মাঠ পার হচ্ছিলেন৷ সন্ধে তখন হৰ–হৰ৷ দাশু রায় যাচ্ছিলেন একটা ৰড় ৰট গাছের পাশ দিয়ে৷ হঠাৎ গাছের ওপর থেকে লাফিয়ে নেৰে পড়ল কয়েকজন লেঠেল৷ তারা দাশু রায়কে ৰললে–তোমার কাছে যা কিছু আছে সৰ দিয়ে দাও৷

দাশু রায় ৰললেন–আমি গরীব ব্রাহ্মণ......আমি দান–টান ৰুঝি না......আমি পরিগ্রহ ৰুঝি৷ তোমাদের সঙ্গে যা কিছু আছে তোমরাই সে সৰ আমাকে দাও৷

ডাকাতরা পড়ল মহা ফ্যাসাদে৷ ৰামুণ দান চাইছেন৷ না দিয়েই বা থাকে কি করে! আবার এদিকে না কাড়লে ডাকাত হিসেবেই বা মান বাঁচে কী করে৷ তারা তখন দাশু রায়কে ৰললে–তোমাকে চিনেছি ঠাকুরমশায়, তুমি তো দাশু রায়৷ তা’ তুমি আমাদের একটা মজার কথা শোনাও৷ আমরা তাতে সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে ছেড়ে দোব৷

দাশু রায় ৰললেন–এ অবস্থায় কার ঠোঁটেই বা মজার কথা আসে ৰল! তা গাছের নীচে তো দেখছি তোমরা তিনটি মূর্ত্তিমান দাঁড়িয়ে আছ৷ তোমাদের আত্মীয়–স্বজন জ্ঞাতি–কুটুম্ব আর ক’জন ওই গাছের ওপরে হুপ্ হুপ্ করছে ৰল তো!

ডাকাতরা ৰুঝলে, দাশু রায় তাদের ৰাঁদর ৰলে গালি দিলেন৷ কিন্তু ৰলবার কিছুই ছিল না৷

দাশু রায় ৰললেন–কথা বেচে খাওয়াই আমার জীবিকা৷ আমার যে প্রাপ্য পূরণ তা দিয়ে দাও৷ ডাকাতরা তাদের যথাসর্বস্ব দাশু রায়কে পেণ্ণামী হিসেৰে দিয়ে দিলে৷

*      *      *

সেই দাশু রায় একৰার চুঁচড়োয় এসেছেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সভায় পাঁচালী গাইতে৷ চুঁচড়ো তখন সংস্কৃত পণ্ডিতদের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল (আর যে সকল স্থান সেকালের রাঢ়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল তারা হ’ল ভাণ্ডারহাটি, ত্রিবেণী, দশঘরা, বাঁশৰেড়ে, জনাই, পেঁড়ো–বসন্তপুর, মাকড়দা, বালী, তমলুক, কাঁথি, মেদিনীপুর, সবঙ্গ, চন্দ্রকোণা, বিষ্ণুপুর, ইন্দাশ (বাঁকুড়া), সিমলাপাল, সোণামুখী, ৰর্দ্ধমান, কালনা, পূর্বস্থলী, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, ইন্দাশ (বীরভূম), শিউরী, মলুটী, সর্পলেহনা, কঙ্কালীতলা, কুন্তলা, করীধ্যা (বীরভূম) প্রভৃতি স্থান৷ সেখানে রাঢ়ের বিভিন্ন স্থান থেকে ৰড় ৰড় পণ্ডিতরা এসেছেন....হচ্ছে দাশু রায়ের পাঁচালী গান৷ তিনি তাঁর গানের এক জায়গায় কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করলেন (গানের প্রথম লাইনটি ছিল ‘দোষ কারোর নয় গো মা’)৷ পণ্ডিতেরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন৷

তাঁরা ৰললেন–এ কী কথা! দাশু রায়ের মত পণ্ডিত মানুষ ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ভুল অর্থে ব্যবহার করলেন! পাঁচালী গান হওয়ার পরে পণ্ডিতদের সভা বসল৷

তাঁরা বললেন–যদিও ‘কোদণ্ড’ শব্দটি কোদাল অর্থে চলে না কিন্তু দাশু রায়ের মত প্রখ্যাত পণ্ডিত ও প্রতিভাধর মানুষের সম্মান রক্ষার জন্যে আমাদের উচিত কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটিকে মেনে নেওয়া৷ সংস্কৃতে এমন আর্ষ প্রয়োগের ঘটনা অজস্র রয়েছে৷ সুতরাং আরেকটি আর্ষ প্রয়োগ ৰাড়লই বা! তাই তখন থেকে ‘কোদাল’ অর্থেও ‘কোদণ্ড’ শব্দটি চলে আসছে৷

এই লব্ধপ্রতিষ্ঠ দাশু রায় ছিলেন বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর নিকটবর্ত্তী চুপী গ্রামের সন্তান৷ কবি সত্যেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরাও এই চুপী গ্রামের অধিবাসী ছিলেন৷ এখন তোমরাই বিচার বিবেচনা করে আমাকে জানাও তোমরা চুঁচড়োর পণ্ডিত সমাজের এই বার্ত্তিক মানতে রাজী আছো কি না অর্থাৎ কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করবে কি না৷ কোদালের নিজস্ব সংস্কৃত হচ্ছে ‘কুদ্দালিক’৷