মোদীর বাজেটের লক্ষ্য কর্র্পেরেট উন্নয়ন

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

গত বুধবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন সংসদে যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে আখেরে  লাভ হবে কর্র্পেরেট জগতের লোকেদের৷ অর্থাৎ বড় লোকেদের৷ তাদের মুনাফার পরিমান লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে মোদী জমানায়৷ এই বাজেটে আমজনতা তথা গরীব মধ্যবিত্তদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য কিছুই নেই৷ শিল্পক্ষেত্রেও  আশা যোগাতে ব্যর্থ এই বাজেট৷ সরকারী কোষাগারের ঋণ কমিয়ে সরকারের নিজের আয় বাড়ানোর ও ঘাটতি কমানোর কোন বাস্তবসম্মত দিশা নেই বাজেটে৷  মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মূল্যবৃদ্ধি কমানোও আর্থিক মন্দা থেকে উত্তরন ও বেকারত্ব দূরীকরণে বাজেটে কোন উচ্চবাচ্য নেই৷ অর্থমন্ত্রীর মুখ থেকে কোন আশাব্যঞ্জক কথাও শোণা যায়নি৷ সরকারী সম্পত্তি না বিক্রি করে সরকারের আয় বাড়বে তার কোন নির্দেশনা নেই৷ কর্মসংস্থান বাড়ার, দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রভৃতি  কোনক্ষেত্রেই এই বাজেট পাশ মার্ক পায়নি৷ অর্থনীতিবিদদের মতে এই মুহুর্তে দেশে সবচেয়ে বেশী জরুরী ছিল বাজারের চাহিদা বাড়ানো৷ কিন্তু সে পথে না হেঁটে মোদী সরকারের বাজেট উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী ও কর্র্পেরেট জগতের স্বার্থপূরণ করবে৷ বাড়বে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা৷

বর্তমানে গোটা দেশেই মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমজনতা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে৷ মূল্যবৃদ্ধি রুখতে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এই বাজেটে৷ গরীব মানুষের হাতে কিছু টাকা আসত যে প্রকল্পে সেই সময় ১০০ দিনের কাজে টাকার বরাদ্দ অনেক আগেই ছাঁটাই করা হয়েছে৷ এবারের বাজেটে টাকার অঙ্ক আরও কমিয়ে দেওয়া হল৷ এই প্রকল্পে ৮৯ হাজার ৪০০ কোটি থেকে বরাদ্দ কমিয়ে এবারের বাজেটে ৬০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে৷ অথচ কাজের মাধ্যমে গরীব মানুষের হাতে টাকা পৌঁছলে সেই টাকাটা বাজারে ঘুরত৷ বাজারে আরও সচল হয়ে চাহিদা বাড়াত৷ ভারতের শিল্পক্ষেত্রে ৯০ শতাংশই অসংঘটিত ক্ষেত্রে কাজ করেন৷ কিন্তু তাদের আর্থিক সুবিধা বা সামাজিক সুরক্ষা কোনটাই নেই৷ অথচ এদের হাত ধরেই দেশের জিডিপির অর্দ্ধেকটা আসে৷ তবুও তাদের জন্য বাজেটে কোন ঘোষণা নেই৷

এবারের বাজেটে পরিকাঠামো খাতে ৩৩ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু এতে আমজনতার কোন লাভ  নেই৷ কারণ পরিকাঠামো তৈরীর দায়িত্ব পাবে বেসরকারী ক্ষেত্রগুলো আর পরিকাঠামো তৈরীর পরে তা তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্র্পেরেট গোষ্ঠীর হাতে৷ ফলে সব লাভের গুড় তারাই খাবে৷ অথচ এগুলি যদি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকত তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মুনাফার পরিমান অবশ্যই বাড়ত৷ তার সুফল পেত সাধারণ মানুষও৷ বাজেট ৫০টি নতুন বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, শহর, গ্রীণএনার্জি, হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরীর প্রকল্পের বরাত পাবে সেই কর্র্পেরেটক্ষেত্র৷ লাভের মুনাফা তাই তাদের ঘরেই জমবে৷ ধনী আর ও হবে ধনী৷ গরীব আরও গরীব৷ মোদী সরকারের লক্ষ্য দেশে আরও অনেক উদ্যোগপতি গড়ে তোলা৷ সেই লক্ষ্যে নতুন স্কিল ডেভেলপমেন্টও স্টার্ট আপ গড়ে তোলার জন্য বরাদ্দ বেড়েছে৷ এসব কিছুরই সুবিধা ভোগ করবে সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের লোকেরা৷ ফলে পেটে খিদের জ্বালা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া গরীবের সংখ্যা আরও বাড়বে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ অর্থমন্ত্রী বাজেটে যে উন্নয়নের কথা বলেছেন তা আসলে কর্র্পেরেট উন্নয়ন৷

বর্তমানে ইয়ূক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের মাশুল গুণছে গোটা বিশ্ব৷ মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে বাড়তে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বসেছে৷ যুদ্ধ চলতে থাকলে বিশ্ববাণিজ্যে চাহিদার ঘাটতি হলে তার প্রভাব ভারতের রপ্তানী বাণিজ্যে পড়তে বাধ্য৷ এই কঠিন পরিস্থিতিতে ভারতের আর্থিক সমীক্ষার রিপোর্টে আর্থিক মন্দায় স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে৷ আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতে মরিয়া মোদী৷ লোকসভা বোটের দিকে তাকিয়ে বাজেটে চাকুরীজীবীসহ মধ্যবিত্ত ও প্রবীণদের মন রাখার  চেষ্টা বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে৷ ধনবৈষম্য দূর না করে শুধু জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে সাধারণ মানুষের সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে মানুষের অভিমুখকে  ঘুরিয়ে দেবার অপচেষ্টা লোকসভা নির্বাচনে শাসকদলের কাছে বুমেরাং হতে পারে৷

মোদীর বাজেটে নাকি আসবে অমৃতকাল! সেই অমৃতকালে মুনাফার অমৃত ভাণ্ডার পুষ্ট হবে আদানি, আম্বানী সহ সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর৷ সাধারণ মানুসের জন্য ভিখারীর ভিক্ষাপাত্রে ছুঁড়ে দেওয়া কয়েনের মতো বরাদ্দ ছিটেফোঁটা৷ মোদীযুগের অমৃতকালে! এখন উচ্চবিত্তকেন্দ্রিক অর্থনীতি তৈরীই মূল লক্ষ্য৷ তাই  বাজেটে নেই প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার জনস্বাস্থ্যর পরিকাঠামো উন্নয়ন৷ গরীব কর্ষক, শ্রমিক কল্যাণে কোন বরাদ্দ নেই এই বাজেটে৷ গ্রামে গ্রামে আবাস যোজনা বৃদ্ধি ছাড়া গ্রাম ও সাধারণ মানুষের জন্য এই বাজেটে রইল শুধুই উপেক্ষা৷

আসলে পুঁজিবাদভিত্তিক কেন্দ্রীত অর্থনীতির করালগ্রাসে ভারতের আমজনতার আজ নাভিশ্বাস উঠছে৷ এই অর্থনীতি গরিবের পেটে কিল মেরে পুঁজিপতিদের পেট  ভরায়৷ তাই আজ এমনই এক বিকেন্দ্রীত অর্থনীতির  প্রয়োজন যা হবে সর্বজন হিতায় সর্বজন সুখায়৷ প্রাউট দর্শন সমস্ত জাগতিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে সবার সব প্রয়োজনের পূর্ত্তি ঘটিয়ে মানুষকে মানসাধ্যাত্মিক অনুশীলনে অনুপ্রেরণা দেবে যাতে মানুষ অমৃততত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ একমাত্র তখনই মানব সমাজে আসবে প্রকৃত অমৃতকাল৷ সবার সব প্রয়োজনের পূর্ত্তি ঘটাবে৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রণীত সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব ‘প্রাউটই হল সেই বিকেন্দ্রীত অর্থনীতি৷ তাই জনগণের সমস্ত চাহিদাপূরণ একমাত্র প্রাউটের বাস্তবায়নেই সম্ভব৷