নেতাজীর চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আমাদের ছেলেবেলায় নেতাজীর কয়েকটি বাণী মহত্তর জীবনাদর্শের পথে এগিয়ে চলবার ক্ষেত্রে অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করত৷ নেতাজী জয়ন্তীর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি৷ বর্তমানেও নেতাজী জয়ন্তী পালন করা হয়, এমনি বিভিন্ন মহাপুরুষের  জন্মজয়ন্তী ঘটা করে’ পালন করা হয়, নাচ-গান-বত্তৃণতা-মিছিলের  আয়োজন করা হয়, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় তাঁদের জীবন ও বাণীকে অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করা হয় না৷ কে বা কারা কত বড় করে’ কত জাঁকজমক করে অনুষ্ঠান করল, তারই প্রতিযোগিতাটাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কাদের মিছিল কত বড় হয়েছে এখন সেটা নিয়েই সবাই মাথা ঘামায়৷ তোতাপাখির মত বত্তৃণতা দিয়ে বক্তারা শেষে একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করে কেউ কেউ মনের কথাটা চেপে রাখতে না পেরে মুগ্দ ভক্তমণ্ডলীর  মধ্যে বলে ফেলেন---কী! কেমন বললাম! ভক্তরাও তখন বলেন, দারুণ হয়েছে দাদা! ...তারপর অনুষ্ঠান যখন ফুরিয়ে যায়, ---‘‘দেওয়ালের  ছবি ফেরে সে দেওয়ালে,/মোরা খাই দাই  আপন খেয়ালে,/ শুকনো ফুলের মালা খুলে নিতে যাই ভুলে৷’’

কে কত নেতাজীপ্রেমী, নেতাজীকে কে কত সম্মান দিয়েছেন, এটা প্রমাণ করার জন্যে রীতিমত পাঞ্জা লড়াই৷ নেতাজীর ধ্যান, ধারণা, আদর্শ-লক্ষ্য আপোষহীন সংগ্রাম দেশের জন্যে অতুলনীয় আত্মত্যাগ, ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে জার্র্মনীতে পৌঁছে যাওয়া, সেখান থেকে আবার চারিদিকে শত্রুপক্ষের যুদ্ধ বিমানের ঘেরাটোপ পেরিয়ে ডুবোজাহাজে করে প্রাণ হাতে নিয়ে জাপানে এসে পৌঁছে যাওয়া, তারপর বিদেশের মাটিতে আজাদ-হিন্দ-সরকার ও আজাদ-হিন্দ-ফৌজ গড়ে তুলে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের  জন্যে জীবনপণ সংগ্রাম নেতাজীর এই অমরকীর্ত্তিকে অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করার মতো এতটা সময় এখনকার নেতাজীপ্রেমীদের হাতে নেই! অথচ তা-ই যদি না করা হ’ল,তাহলে নেতাজী-জয়ন্তীর সার্থকতা কোথায়?

আজকের যুবসমাজের মধ্যে যে অবক্ষয় ও দিশাহীনতা দেখা দিয়েছে এর সমাধান রয়েছে কিন্তু নেতাজীর জীবনাদর্শের মধ্যে৷

লেখার প্রথমেই যা বলতে যাচ্ছিলুম--- নেতাজীর যে কয়েকটি বাণী আমাদের উজ্জীবিত করত, তার একটি হ’ল---‘‘আমরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি---একটা উদ্দেশ্য সাধনের নিমত্ত-একটা বাণী প্রচারের জন্য৷ আলোকে জগৎ উদ্ভাসিত করিবার জন্য গগনে যদি সূর্য উদিত হয়, গন্ধ বিতরণের  উদ্দেশ্যে বনমধ্যে কুসুমরাজি যদি বিকশিত হয়, অমৃতময় -বারিদান করিতে তটিনী যদি সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়-যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ লইয়া আমরাও মর্ত্যলোরে নামিয়াছি একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য৷ যে অজ্ঞাত গূঢ় উদ্দেশ্যে আমাদের  ব্যর্থ জীবনকে সার্থক করিয়া তোলে তাহা আবিষ্কার করিতে হইবে-ধ্যানের দ্বারা কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার  দ্বারা৷’’

ধ্যানের দ্বারা আমাদের আত্মশক্তির জাগরণ ঘটাতে হবে, এই হ’ল আত্মগত সাধনা৷ আর আমার বাইরে যে সমাজ-সংসার রয়েছে, সেই সমাজের সেবাকে জীবনের মহান্‌ ব্রত করে এগিয়ে চলতে হবে৷ জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাই আমরা পাই নেতাজী সহ মহামানবদের জীবন ও বাণী থেকে৷ তাঁদের মহাবাণীকেই প্রেরণার চিরন্তন প্রবাহ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷ শুধু ব্যষ্টিগত আদর্শ-চেতনা নয়, আজকের সামাজিক-অর্থনৈতিক  ক্ষেত্রেও যে  অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, যে জড়তা ও গতিহীনতা দেখা দিয়েছে-তারও সমাধানের ইঙ্গিত আমরা পাই নেতাজীর চিন্তাধারার মধ্যে৷

বিংশ শতাব্দীর  শুরু থেকে গোটা পৃথিবীর সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক  ক্ষেত্রে আলোড়ন উঠেছে৷ পরাধীনতার  নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্যে সর্বত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে৷ একদিকে যেমন  সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছে দেশে দেশে সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র অর্থনৈতিক স্তরেই পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনও পুঞ্জীভূত হচ্ছে৷ কোথাও কোথাও বিষ্ফোরণের রূপ নিচ্ছে৷ কোথাও বা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে  প্রতিবাদ আন্দোলন রূপে দেখা দিচ্ছে৷ রাশিয়া ও পূর্ব ইয়ূরোপের দেশগুলিতে পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে যে মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র  কায়েম হয়, তাতে কিন্তু নেতাজী আশান্বিত হতে পারেন নি৷ এর কারণ ছিল, রাশিয়া ও তার অনুগামী নবসৃষ্ট তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রকৃতপক্ষে মানবতার সার্বিক মুক্তি ঘটেনি৷ তা নোতুন করে  একনায়কতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটিয়েছে ও মানুষের ব্যষ্টি স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে অবদমন করছে৷ তা মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছে৷ মানব মণীষা সেখানে কারারুদ্ধ৷তাই নেতাজী সুস্পষ্ট ভাষায় জানালেন, পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটিয়ে আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে হবে ঠিকই কিন্তু সেই সমাজতন্ত্র মার্ক্সীয় জড়বাদী সমাজতন্ত্র নয়, নেতাজীর দ্ব্যর্থহীন কথা, তিনি যে সমাজতন্ত্র চান, তার জন্ম কালমার্কসের পুঁথির পাতা থেকে নয়, ভারতবর্ষের আপন চিন্তা ও সংস্কৃতির মধ্যে৷ তিনি চেয়েছিলেন, ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবনবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সুষম সমন্বয়৷

নেতাজীর এই চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা এখন গভীরভাবে উপলদ্ধি করার উপযুক্ত সময়৷ আজ পুঁজিবাদ গ্লোবালাইজেশনের ভেক করে সারা পৃথিবীকে গ্রাস করছে, ভারত তার ব্যতিক্রম নয়৷ কম্যুনিজমের তো অনেক আগেই অকাল মৃত্যু ঘটে গেছে৷ আমরা দেখতে পাচ্ছি নেতাজীর যে স্বপ্ণ আধ্যাত্মিকতা ও সমাজতান্ত্রিকতা---তাই মহান্‌ দার্শনিক ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রাউট দর্শন পূর্ণাঙ্গ সামাজিক অর্থনৈতিক আদর্শরূপে মূর্ত্ত হয়ে উঠেছে

আজ, তাই নেতাজীর শুভ জন্মতিথি উৎসবে আমরা আহ্বান করব, আসুন, নেতাজীর স্বপ্ণ ও প্রাউট দর্শনের  অধ্যাত্মভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের আদর্শ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত হোন৷

বিশেষ করে আজকের যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলব, আর শুয়ে বসে সময় নষ্ট না করে, এসো,  নিপীড়িত মানবাত্মার শোষণমুক্তির জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়৷ প্রভাত সঙ্গীতের ভাষাতেই বলি---

‘‘ডাক দিয়ে যাই যাই যাই, আমি ডাক দিয়ে যাই যাই যাই৷

আলোকের পথ ধরে যারা যেকে চায় তাহাদের চিনে নিতে চাই৷’’