উদ্ভিদ জগৎ,জীব জগৎ ও মানব জগৎ---তিনটেতেই কতকগুলো সাধারণ গুণ রয়েছে, সাধারণ ধর্ম রয়েছে৷ এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম অনুযায়ী তাদের আপন আপন অস্তিত্ব বজায় রাখে৷ তাহলেও উদ্ভিদ জগৎ আর জীব জগৎ সম্পূর্ণ এক নয়৷ জীব জগতের জন্যে কতকগুলো বিশেষ কর্তব্য নির্দিষ্ট রয়েছে, কতকগুলো বিশেষ বৈশিষ্টেও তারা বৈশিষ্ট্যবান৷ এই কারণে উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্যও রয়েছে৷ জীব জগতের যদি ওই বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য না থাকতো তা হলে তা’ দিকে আমরা জীব না ৰলে উদ্ভিদ ৰলতাম৷ উদ্ভিদ ও জীব-জন্তুর মধ্যে যে সমস্ত সাধারণ গুণ বা ধর্ম বর্তমান, মানুষের মধ্যেও সেই গুণ বা ধর্ম বর্তমান৷ মানুষের মধ্যে এর অতিরিক্ত গুণও রয়েছে৷ যদি এই গুণগুলো না থাকতো তাহলে মানুষকে গাছ-পালা, পশু-পক্ষী থেকে বিশেষিত করা যেতো না৷ মানুষের মধ্যে এই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাকে উন্মেষিত তথা পুষ্ট করা প্রত্যেক মানুষেরই অবশ্য করণীয়৷ এই সমস্ত গুণের পরিপুষ্টির ওপরেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করছে৷ আবার এই বৈশিষ্ট্যের অভাব ঘটলে মানুষকে মানুষ না ৰলে বলবো মনুষ্যদেহধারী অন্য কিছু৷
কোনো মানুষই অধোগতি চায় ন৷ জীবনে উন্নত হওয়া, ধাপে ধাপে উন্নতির পথে এগিয়ে চলা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক৷ সমাজে যাদের শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান দেওয়া হয় তাদের কর্তব্য হ’ল সমাজের আর পাঁচ জন লোককে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলা৷ কেউ এগিয়ে গেলো আবার কেউ অনেকটা পেছিয়ে পড়লো---এমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়৷ এমনটা হলে যে মানুষটা এগিয়ে পড়লো তার পক্ষে এটা মোটেই গৌরবজনক নয়৷
আমরা ইতিহাস পড়াশুনা করি৷ অতীতে ইতিহাস রচনা হয়েছে, ভবিষ্যতেও রচনা হবে৷ তবে ইতিহাস রচনায় এক আমূল পরিবর্তন হওয়া দরকার৷ আজ পর্যন্ত যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তা হ’ল রাজা মহারাজাদের ইতিহাস৷ কিন্তু আজ ইতিহাসের খোল নল্চে বদলানো দরকার৷ নোতুন করে ইতিহাস রচনা করতে হৰে৷ আর তা হৰে মানবতার স্বার্থে, মানব জাতির হিতার্থে, সার্বজনীন কল্যাণের জন্যে৷ তা’ না হয়ে কেবল কে কখন রাজা হ’ল, কে কবে কোনদেশটা আক্রমণ করলো বা কে কবে মন্ত্রী হ’ল--এসব জেনে জনসাধারণের বিন্দুমাত্র লাভ হয় না৷ এতে সাধারণ মানুষের ভালোও লাগে না৷ ইতিহাস পাঠ করে যদি মানুষকে উপকার পেতে হয় তাহলে ইতিহাসে জনসাধারণের সুখ-দুঃখ, আশা -আকাঙ্খার কথা লিখতে হৰে৷ পৃথিবীর কোনপ্রান্তে মানব গোষ্ঠী কোনবিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কতদূর পর্যন্ত প্রগতি বা উন্নতি ঘটিয়েছিলো---এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসেরই ইতিহাসে স্থান পাওয়া উচিত৷ প্রগতির পথে মানুষকে কী ধরণের বিপদ-আপদের কোনদিক থেকে বাধা এসেছিলো- এইসব দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস রচিত হওয়া দরকার৷ একমাত্র এই ধরণের ইতিহাসকে আমি মানুষের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বা সাংস্কৃতিক ইতিহাস ৰলৰো৷ মানুষের স্বভাবধর্ম, তার বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোকে সামনে রেখে মানব জাতির ইতিহাস লিখিত হওয়া উচিত৷ কেবল এভাবেই আমরা জানতে পারবো যে মানুষ কতখানি তার অন্তর্নিহিত সদগুণের উৎকর্ষ সাধন করতে পেরেছিলো, আর আজকের মানুষই বা কতদূর এগিয়েছে৷ লাখ লাখ লোকেদের মধ্যে দুই এক জন মানুষ যে ৰড় কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা হাজার হাজার মানুষকে প্রেরণা যোগায় ঠিকই কিন্তু মানুষ তাকে আপনার ৰলে গ্রহণ করৰে না৷ মানুষের যে ধর্ম অর্থাৎ বিশিষ্ট মানবধর্ম, সেই ধর্মের পরিপুষ্টির জন্যে আজ থেকে আমাদের সবাইকে বিশেষ ভাবে যত্নশীল হতে হৰে৷ হতে পারে, এই ধরণের ইতিহাস রচনায় লোক অসন্তুষ্ট হৰে কিন্তু তা থেকে জনসাধারণ শুধু যে প্রেরণা পাৰেন তা নয় সাথে সাথে তাদের এগিয়ে চলার শক্তি ৰেড়ে যাবে৷
কেউ কেউ হয়তো ৰলৰে যে সমাজের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্যে কি কিছু সন্ন্যাসী থাকবে, কিছু গৃহী থাকবে? এখন প্রশ্ণ---এদের উভয়ের ধর্ম কি সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক? এই উভয় সম্প্রদায়ের জন্যে কি ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস হবে? আমি তো অবশ্যই না ৰলৰো৷ কারণ মানবধর্ম তো একটাই৷ বিস্তার, রস, সেবা ও মোক্ষ---এই হ’ল চতুষ্পাদ ভাগবত ধর্ম৷ এই ভাগবত ধর্মের পালন গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়ের পক্ষে সমানভাৰে প্রযোজ্য৷ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে গৃহীর রয়েছে দু’টো পরিবার আর সন্ন্যাসীর একটাই৷ গৃহীর দু’টো পরিবার- একটা হ’ল তার আপনার ছোট্ট পরিবার যেখানে রয়েছে মা, ৰাৰা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ইত্যাদি৷ আর দ্বিতীয়টা হ’ল বৃহৎ মানব পরিবার বা সারা বিশ্বটা৷ গৃহীকে এই উভয় পরিবারের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হয়৷ তাকে যেমন তার ছোট্ট পরিবারটাকে দেখাশোনা করতে হয় তেমনি বৃহৎ মানব পরিবারকেও দেখা শোনা করার দায়িত্ব নিতে হয়৷ অবশ্য শেষোক্ত কাজটা গৃহীরা সন্ন্যাসীর দ্বারা করিয়ে নেবেন৷ সন্ন্যাসীর নিজস্ব কোনো পরিবার নেই৷ গোটা বিশ্ব সংসারই হ’’ল সন্ন্যাসীর একমাত্র পরিবার৷ সেই বৃহৎ পরিবারের দেখা শোণার ব্যাপারে সন্ন্যাসীরাও গৃহস্থের সাহায্য নেৰেন৷ কাজেই মানবধর্ম গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়ের জন্যে একই৷ আমরা যখন মানব সমাজে যথার্থ মানবিক অগ্রগতির ইতিহাস লিখৰো তাতে গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়েরই ভূমিকা অত্যুজ্জ্বল স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকৰে৷ সেই ধরণের ইতিহাস সৃষ্টির দ্বারাই মানুষ একদিন, কেবল এই পৃথিবীতে নয়, সমগ্র বিশ্বে সর্বত্র পরমাত্মার সামনে এটা প্রমাণিত করৰে যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করে ঠিক কাজই করেছিলেন৷ (২৯শে জানুয়ারী, ১৯৮০, পটনা)