রানী ফুলটুসি বর্মণীর বিদ্রোহ

লেখক
সুকুমার সরকার

বাঙালীর বিদ্রোহের ইতিহাসে তৃতীয় বিদ্রোহ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে রানী ফুলটুসি বর্মণীর বিদ্রোহের নাম৷ এই বিদ্রোহের সময়কাল একাদশ শতাব্দী৷ এই বিদ্রোহটিও ঘটেছিল উত্তরবঙ্গে৷ সমগ্র উত্তরবঙ্গ তখন বরেন্দ্র  বঙ্গ নামে অভিহিত ছিল৷ বরেন্দ্র বঙ্গের কামতাপুর ভুক্তিতে কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠার পূর্বে ছিল বর্মন রাজবংশ৷ বরেন্দ্র বঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে তখন রাজবংশের রাজত্ব চলছিল৷ এই বিদ্রোহ যখন সংঘটিত হয় তখন বঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের রাজা ছিলেন শ্যামল বর্মন৷

প্রাচীনকাল থেকেই কামতাপুর ভুক্তির বিভিন্ন রাজাদেরকে নেপাল, ভুটান, অহম রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহে লেগে থাকতে হতো৷ রাজা শ্যামল বর্মনকে এমনি এক বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়েছিল৷ বিরুদ্ধ পক্ষ ছিল ভুটান রাজ৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজা যথেষ্টই বিব্রত হয়েছিলেন৷ এগিয়ে এলেন তাঁর স্ত্রী রাণী ফুলটুসি বর্ম্মণী৷ শ্যামল বর্ম্মনের পক্ষে যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন রাণী ফুলটুসি বর্ম্মণী৷ তিনি সমগ্র উত্তরবঙ্গের কামতাপুর ও পৌণ্ড্রবর্দ্ধন দুই ভুক্তির বিভিন্ন পদবীধারী কৈবর্ত কোচ থেকে বিবর্তিত সকল বাঙালী প্রজাদেরকে বাঙলার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানলেন৷ সেদিন উত্তরবঙ্গের বীর বাঙালীরা রাণী ফুলটুসি বর্ম্মনীর পক্ষে প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিলেন৷ যুদ্ধের যে ময়দানে বীর বাঙালীরা ভুটানের সৈন্যদের ফালাফালা করে কেটেছিলেন, সেই স্থানটি আজও ফালাকাটা নামে পরিচিতি হয়ে আছে৷ পরাজিত ভুটান-রাজ রাজা শ্যামল বর্মনের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ যে স্থানটিতে বসে বাঙলার রাজার সঙ্গে ভুটান রাজার সন্ধি হয়েছিল সেই স্থানটির নাম আজও লোকে বলে ‘রাজাভাত খাওয়া’৷

সন্ধি শেষে রাণী ফুলটুসি বর্মনী তাঁর বিজয়ী সৈনিকদের বিজয় তিলক পরালেন৷ আর বিভিন্ন পদবীধারী তাঁর সমস্ত প্রজাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা সন্তান তুল্য৷ আজ থেকে তোমরা রাজার বংশজাত তথা ‘রাজবংশী’ বলে পরিচিত হবে৷ সেই থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পদবিধারী মানুষেরা ‘রাজবংশী’ বলে খ্যাত হতে থাকলেন৷ এই হলো বিদ্রোহী বাঙালির ‘রাজবংশী’ শব্দ নামের প্রকৃত ইতিহাস৷ এই ইতিহাস কেন কোথাও লেখা হয়নি৷ কিন্তু এই সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন এই সময়ের নারীমুক্তির মহান উদগাতা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি তাঁর ‘বাংলার মণিপ্রদীপ---বরেন্দ্রভূমি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘রাণী ফুলটুসি ছিলেন বরেন্দ্রভূমির রাজা শ্যামল বর্মনের স্ত্রী ও সেনাপতি৷ বহিরাক্রমণকে প্রতিহত করে তিনি বরেন্দ্রভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন৷ যে স্থানটিতে শত্রু সৈন্যকে বিধবস্ত করেছিলেন সেটি এখন ফালাকাটা নামে পরিচিত৷ এই মাতৃসমা উদারস্বভাবা মহিলা রাজায় প্রজায় ভেদ মুছে ফেলার চেষ্টা করছিলেন ও প্রজাদের সস্নেহে কাছে টেনে এনেছিলেন৷ তিনি ঘোষণা করেছিলেন প্রজারা আমার সন্তান৷ তাই তারা সবাই রাজবংশ জাত (রাজবংশী)৷ মানুষে মানুষে সম্বোধনে যে সুমধুর ‘ৰাৰা হে’ শব্দটি এখনও প্রচলিত সেটির প্রবর্তনও তিনিই করেছিলেন৷ তিনি ছিলেন কঙ্কনা সামন্ত রাজ্যের (বর্তমানে রংপুর জেলার কাকিনা) রাজা কর্ণেশ্বর রায়ের কন্যা৷’’ সেই থেকে উত্তরবঙ্গের মানুষ দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে নিজেদের পরিচয়ে রাণী ফুলটুসি বর্মনীর দেওয়া এই ‘রাজবংশী’ পরিচয়কে গর্বের সঙ্গে ব্যবহার করে চলেছেন৷ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পদবিধারী বাঙালীদের জন্য এই ‘রাজবংশী’ পরিচয় গর্বের পরিচয়৷ ইংরেজ আমলে স্যার জর্জ গিয়ারসন থেকে শুরু করে হান্টার প্রমুখ যাঁরাই উত্তরবঙ্গে ভাষা ও জাতির জরিপ কাজ করতে এসেছেন তাঁরা সকলেই এই রাজবংশীদের কথাই বলেছেন৷ স্যার জর্জ গিয়ারসন ‘রাজবংশী জাতি’ ও ‘রাজবংশী ভাষার’ কথা আলাদাভাবে লিখতে গিয়ে স্পষ্টতই লিখলেন, ‘The Rajbanshi is cach origins’’৷ হ্যাঁ, ‘রাজবংশীরা কোচ অরিজিন৷ আর কোচরা কৈবর্ত অরিজিন৷ আর কৈবর্তরা অস্ট্রিকো- নিগ্রোয়েড মিশ্রণজাত দ্রাবিড়৷ উত্তরবঙ্গে রাজবংশীদের ‘রাজবংশী’ পরিচয় যে একক নৃতাত্ত্বিক নয়, রাজমহিমাম্বিত তার আভাসের কথা অনেকেই উল্লেখ করেছেন৷ হান্টারের উল্লেখ করে ‘উত্তরবঙ্গের রাজবংশী’ গ্রন্থে চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছেন,‘‘রঙপুর, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে কৃষক ও সম্মানিত ব্যক্তিরা রাজবংশী নাম গ্রহণ করেছেন যার অর্থ ‘রাজমহিমান্বিত জাতি’৷ প্রসঙ্গক্রমে বলি রাখি, রাজবংশী নামের পিছনে রাণী ফুলটুসি বর্মনীর এই ইতিহাস লিখিত না থাকলেও উত্তরবঙ্গের সাধারণ রাজবংশীদের প্রচলিত একটি ধারণার মধ্যে এই ইতিহাসের সূত্র লুকিয়ে আছে৷ সেটি হলো, রাজবংশীরা নিজেদের যে দুটি প্রধান ভাগে বিভাজিত বলে মনে করেন, তার একটি  দেশীয়া, অন্যটি পোলিয়া৷ তাঁদের  প্রচলিত ধারণা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যাঁরা পালিয়ে এসেছিলেন তাঁরা পোলিয়া৷ আর যাঁরা দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন তাঁরা দেশীয়া৷ তবে এই যুদ্ধ কোন যুদ্ধ, সেটা তাঁরা বলতে পারেন না৷ অনেকে বলেন সিপাহী বিদ্রোহের সময়ের বহু আগে থেকে দেশীয়া এবং পোলিয়া শব্দ দুটির উদ্ভব৷ আসলে সত্য ইতিহাসটি লিখিত না থাকায় এমন বিভ্রান্তি৷ যাই হোক, বিদ্রোহী বাঙালীর এই বিদ্রোহও একটি গর্বিত ইতিহাস৷