সাফল্যের গুপ্ত রহস্য

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

অতীতে কয়েকবারই আমি তোমাদের একটা গল্প শুণিয়েছিলুম হর–পার্বতী সংবাদ থেকে৷ গল্প আছে, একবার পার্বতী শিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সাফল্য লাভের রহস্য কী”? উত্তরে শিব বলেছিলেন, সাফল্য লাভের সাতটি গোপন রহস্য আছে৷

‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ

               সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷

দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং

               তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷

চতুর্থো সমতাভাবো

               পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷

ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহারো

               সপ্তমং নৈব বিদ্যতে৷৷  

(শিবসংহিতা)

সাফল্যের প্রথম রহস্যটা হ’ল ঃ ‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ’৷ ‘আমি যে ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছি তাতে জয়যুক্ত হবই হব’–এই যে সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয় এটাই সাফল্যের প্রথম চাবিকাঠি৷ যারা আধ্যাত্মিক সাধক তাদের এই সুদৃঢ় প্রত্যয় থাকতেই হবে৷ আমি যে ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছি সেই ব্রতে সফল হবই হব, এই যে অবিচল আত্মবিশ্বাস এটা থাকে তাদেরই যাদের পরমপুরুষের প্রতি চরম ও পরম ভালবাসা আছে৷ ঈশ্বরের প্রতি আস্থা–ভালবাসা যখন কোন মতে টোল খায় না, ঘোলাটে হয়ে যায় না, তখনই এই বজ্রকঠোর সংকল্প জেগে যায়৷ ‘আমি লক্ষ্যে পৌঁছুতে সফলকাম হবই হব’–এটাই হ’ল সাফল্যের প্রথম গুপ্ত রহস্য৷

দ্বিতীয় গোপন রহস্য হ’ল ঃ ‘দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তম্*৷ মানুষ যাকে উপাস্য বা লক্ষ্য হিসেবে একবার মেনে নিয়েছে তার প্রতি তাকে অবিচল আস্থাশীল, শ্রদ্ধাশীল থাকতেই হবে৷ শ্রদ্ধা জিনিসটা কী রকম? পৃথিবীর কোন উন্নত ভাষাতেই এই সংস্কৃত ‘শ্রদ্ধা’ শব্দটির ঠিক সমার্থক শব্দ নেই৷ তাই এই শব্দটির ভেতরকার তাৎপর্য ভেঙ্গে বলতে হবে৷ ‘শ্রৎ’ শব্দ থেকে ‘শ্রদ্ধা’ শব্দ নিষ্পন্ন৷ ‘শ্রৎ’ মানে সত্যম্৷ ধা  কি প্রত্যয় করে আসছে ‘ধা’ শব্দ৷ মানুষ যখন তার সব কিছু তার লক্ষ্য বা উপাস্য দেবতাকে দিয়ে দেয় (এখানে উপাস্য দেবতা মানে পরমপুরুষ), সেই মানস প্রবণতাটাকে বলা হয় শ্রদ্ধা৷ প্রথমতঃ লক্ষ্যকে পরম সত্য বলে মনে করা (এখানে পরমেশ্বরই পরম লক্ষ্য) ও তারপর মনের সমস্ত প্রবণতাকে সেই লক্ষ্যের দিকে চালিয়ে দেওয়ার নাম শ্রদ্ধা৷ পরমপুরুষের প্রতি আত্যন্তিকী ভালবাসা, ঐকান্তিক অনুরাগ থাকলে তবেই মানুষের মনে শ্রদ্ধা জাগতে পারে৷ তাই সাফল্যের দ্বিতীয় যে রহস্য তাও ঈশ্বরনিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে৷

‘তৃতীয়ং গুরুপূজনম্’৷ ‘গুরু’ মানে কী? প্রাচীন সংস্কৃতে ‘গু’ মানে অন্ধকার, ‘রু’ মানে যে দূর করে....বিদূরক৷ তাই গুরু মানে যে সত্তা জীবের অন্ধকার–বিশেষ করে আধ্যাত্মিক অন্ধকার দূর করে দেন৷ ‘গুরুপূজনম্’ মানে গুরুর মনঃপূত কর্ম করা৷ যখন গুরুকে অধ্যাত্ম–নির্দেশনার মূর্ত্ত প্রতিভূ হিসেবে গণ্য করা হয়, যখন ব্রহ্মকে অধ্যাত্মবিদ্যার প্রবক্তা গুরু হিসেবে গণ্য করা হয়, তখনই এই তৃতীয় সর্ত্ত পূরণ করা হচ্ছে ধরা হয়৷

‘চতুর্থো সমতাভাবো’৷ যেহেতু বিশ্বের সব কিছুই পরমপুরুষের সৃষ্টি, পরম স্রষ্টার সন্তান, তাই সকলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা হচ্ছে সৌভ্রাত্রের সম্পর্ক৷ কেউ বড়ও নয়, কেউ ছোটও নয়৷ কারো মধ্যে কোন প্রকার হীনন্মন্যতা বা মহামান্যতা থাকবে না৷ অর্থাৎ সাধকের মধ্যে থাকবে সমতাভাব, পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য৷ যখন এই ভারসাম্য, এই মানসিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত থাকে আমরা সেই অবস্থাটাকে বলি ‘সমতাভাবো’৷

‘পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ’৷ মানুষের জীবনে বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ এ দু’য়ের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করে মানুষের কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়৷ যদি এই কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোকে ভালভাবে বশে আনা যায় তাহলে মন ভালভাবে কাজ করতে পারে, পরম চৈতন্যের দিকে এগিয়ে চলতে পারে৷ তাই পঞ্চম রহস্য হচ্ছে, সাধককে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোকে সুনিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে৷

‘ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহারো’৷ আ  – হৃ + ঘঞ = আহার৷ বাইরের জগৎ থেকে মানুষ যা সংগ্রহ করে, আহরণ করে তাই আহার৷ এটা হ’ল জাগতিক আহার৷ মানসিক আহার সংগ্রহ করা যেতে পারে বাইরের এই বস্তুজগৎ থেকেও, আবার মানস জগৎ থেকেও৷ তুমি একটা সত্যিকারের রসগোল্লা খেতে পার, খেয়ে আনন্দ পেতে পার, আবার মনের মধ্যেও একটা রসগোল্লা তৈরী করে মনে মনে তা খেয়েও তৃপ্তি পেতে পার৷

এখানে ‘পরিমিতাহার নয়, ‘প্রমিতাহার’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে৷ ‘পরিমিত’ মানে নিয়মিত (controlled), পরিমাণে বেশীও নয়, কমও নয়৷ এই শ্লোকে ‘প্রমিতাহার’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে৷ প্রমিতাহার মানে হ’ল আহারের পরিমাণটা যেমন নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার তেমনি পুষ্টিকরও হওয়া দরকার৷ এমন অনেক লোক আছে যারা এমনিতে মানুষ হিসেবে ভাল কিন্তু আহারের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষ যা খাবে তা নিশ্চয়ই ভেবে–চিন্তে খাবে৷ হাতের কাছে যা পেলুম তাই খেয়ে ফেললুম, এটা ঠিক নয়৷ বরং বলব খাদ্যাখাদ্যের ব্যাপারে মানুষের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, সেই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে, আহার যেন পুষ্টিকর হয়৷

সাফল্যের এই ছ’টি মোক্ষম উপায় ব্যাখ্যা করার পর শিব বলছেন, দেখ পার্বতী, এই ছটা উপায়ই যথেষ্ট, আর সপ্তম উপায়ের কথা নাই বা জানলে, তার আর দরকার পড়বে না৷

(পটনা, ৩রা অক্টোবর, ১৯৭৮)