শারদীয়া উৎসব সম্পর্কে দু’চার কথা

লেখক
প্রভাত খাঁ

শারদীয় উৎসব বা দুর্গোাৎসব হলো বাঙালী জনগোষ্ঠীর জাতীয় উৎসব৷ এই উৎসবে ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে এমন কি সকল সম্প্রদায়ের লোকজন মিলিত ভাবেই এই উৎসবে অংশ গ্রহণ করে থাকে৷ তাই এই চারদিনের জন্য সকলেই ব্যাকুল ভাবে অপেক্ষা করে থাকে৷ সমাজের কেউই এই উৎসব থেকে অবহেলিত হয় না৷ এই যে শরৎকালীন উৎসব এটার মধ্যে রয়ে গেছে বাঙালী জনগোষ্ঠীর এক মিলনের সুর৷ যে যেখানেই থাকুক না কেন বাঙালী ঘরমুখো হয়ে বাড়িতে এসে আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে আনন্দে মাতে৷ একই চালচিত্রে আমরা দেখি জগৎজননী স্বরূপিনী মাদূর্গার সঙ্গে আছেন লক্ষ্মী সম্পদের দেবী, সরস্বতী বিদ্যাও জ্ঞানের দেবী আর গণপতি গণেশ ও দেবসেনাপতি কার্ত্তিক৷ আর আছেন মহিষাসুর, এবং দেবাত্মন হিমালয়ের প্রদত্ত সিংহ৷ যে সিংহে উপবিষ্টা হয়ে দশ হাতে দশ প্রহরণ ধারণ করে মা দূর্গা অসুর দলন করছেন আর দশদিক রক্ষা করে চলেছেন কল্যাণময়ী রূপে৷ এই প্রতীকি পূজা এর বিশেষ তাৎপর্য রয়ে গেছে৷ মানুষের সমাজে ধনসম্পদ, জ্ঞান (বিদ্যা), ব্যবসাবাণিজ্য আর পাপ, অন্যায় দলনকারিণী মহামায়ার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও কর্মোদ্যোগ না ঘটলে সমাজে কল্যাণ নেই৷ সেই কারণে এই শারদীয়া পূজা বাঙালীর সমাজে জাতীয় পূজা বা উৎসব হিসাবে বহু বছর ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে৷ তবে মহাপ্রকৃতির অর্থাৎ সেই মহাশক্তির প্রতিভূ স্বরূপ–দেবী দূর্গার প্রতিমার আরাধনা করা হয়৷ এই পূজার বিশেষ তাৎপর্য্য হলো নবপত্রিকার বোধন৷ নবপত্রিকা যেন কদলী, ধান, মান কচু, দাড়িম্ব, বেল, জয়ন্তী, অশোক, হলুদ গাছের ডাল সমেত পাতা দিয়ে তৈরী কলাবউ! ৭মীতে কলাবউকে বরণ করে সিদ্ধিদাতাগণেশের পাশে রেখে পূজা করা হয়৷ এটি অভিনব কারণ ওই নয়টি গাছ সুস্বাস্থ্য রক্ষায় খাদ্য ও ঔষধী হিসাবে গণ্য৷ তাছাড়া মানুষের সমাজ প্রকৃতি দত্ত খাদ্য ও ঔষধী ছাড়া বাঁচতে পারে না তাই সেই পরমারাধ্য কল্যাণময়ী দেবী হিসাবে এদের পূজা করা হয়৷ এই পূজা এই জনগোষ্ঠীর সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে৷ তবে ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে জাঁকজমক সহকারে এই পূজার প্রচলন হয়৷ তাহেরপুরের জমিদার কংস নারায়ণ নাকি জাঁক জমক সহকারে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে পূজার প্রচলন করেন৷ বর্ত্তমানে এই তাহেরপুর বাংলা দেশে অবস্থিত৷ জমিদার গণ এই পূজা করতেন পরে বারোয়ারী পূজার প্রচলন হয়৷ হুগলী জেলার গুপ্তি পাড়ার (বাঁশ বেড়িয়ার কাছে) বারজন ইয়ার বন্ধু মিলে পূজার প্রচলন করেন৷ পরে সারা রাজ্যে এমন কি বাংলার বাইরে বারোয়ারী পূজার প্রচলন হয়েছে৷ অতি সাধারণ ব্যষ্টিরাও সামান্য উপচারে ভক্তি সহকারে আজও পূজা করে থাকে৷ বর্ত্তমানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এই দুর্গোৎসব করা হয়৷ প্যাণ্ডেল, আলোর রোশনাই, মাইকের জৌলুস এতে পূজা মণ্ডপ জ্বল জ্বল করে৷ সারা রাত ধরে ঠাকুর ও প্যাণ্ডেল দেখতে মানুষের ঢ়ল নামে৷ চার কেন আরো কিছু দিন ধরে উৎসব চলে৷ বাংলার বারো মাসে তের পার্বন চলে৷ কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়৷ চাঁদার জুলুমে গরিব মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে কিন্তু হই হই, আনন্দের যেন শেষ নেই৷ এই যে বিরাট অর্থ ব্যয় এর কিছু যদি সমস্যা সংকূল রাজ্যের জনগণের সেবায় কাজে লাগানো যেত তা হলে এই হতভাগ্য বাঙালী সমাজ স্থায়ী ভাবে উপকৃত হতে পারতো যেটা সেই মহাপ্রকৃতি স্বরূপিনীরই ইচ্ছা বলে মনে হয়৷

আজ যে যুগ এই যুগে যাঁরা বাস করছেন সেই সব নরনারীকে অবশ্যই যুক্তিবাদী হয়ে চলতে হবে৷ সফল আচরণে মানুষকে অবশ্যই সংযমের পরিচয় দিতে হবে৷ আগে এই উৎসবে পাড়ায় পাড়ায় যে আন্তরিক ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে মিলিত আহারের আয়োজন হতো সেটার বড়ই অভাব৷ তাই ভক্তি, নিষ্ঠা এবং মিলিত আহার ব্যতীত উৎসব সফল হতে পার না৷ তবে আজও দিল্লী, মুম্বইয়ের কোথাও কোথাও বাঙ্গালীরা মিলিত আহার করে থাকেন৷

আজকে অনেক থিমের ও মিথের পূজা হয়৷ অজস্র লক্ষ লক্ষ টাকার খেলা চলছে৷ কিন্তু কই কেউ তো এই রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে, অর্দ্ধাহারে পথে পড়ে পড়ে দিন যাপনের গ্লানী বহন করে চলেছে, তাদের কথা ভাবছে না৷ তাদের হাতে কিছু কিছু নোতুন জামাকাপড় তুলে দিলে ও পূজার দু’একদিন পেট ভরে খেতে দিলে তো দূর্গাপূজা সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়৷ সবাই সেই মহাপ্রকৃতির অতিপ্রিয় সন্তান তাই তাদের চোখের জলে যে তিনি কষ্ট পান৷ এমন মানসিকতা নিয়ে যখন তাঁর আরাধনা হবে তখনই বলা যাবে সত্যই এই বাংলায় শারদীয় উৎসব সফল হচ্ছে নচেৎ নয়৷

পাঠকদের কাছে একটা কথা জানানো দরকার তা হলো এই বাংলার জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষই তার আদরের সন্তান৷ তার ভেদাভেদ কিছু নেই৷ বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত অনেকে হয়েছে কিন্তু সেও তো মায়েরই পুত্র কন্যা৷ আর সকলেই তো ভাই বোন৷ রক্তের কোন জাত পাত নেই৷ জীবিকা নির্বাহে সবাই কোন না কোন কাজ করে৷ এই উৎসবে জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই কাজ করে ও সমবেত ভাবে উৎসব করে আন্তরিকতার সঙ্গেই৷ কেউ দেশ মাতৃকার কাছে ব্রাত্য নয়৷ তাই এটা কিন্তু সেই মিলনের মহামন্ত্রের জয় গান৷ বাঙালী জাত পাতের ধার কোন দিনই ধারে নি৷ তাই ভেদাভেদ ভুলে অগ্রগতির মেলে চেপে এগিয়ে চলো৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও৷ ঐক্যবদ্ধভাবে মিলিত প্রয়াসে সব দুর্যোগের মোকাবিলা করো৷