স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রীতিলতা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সব শহীদ অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়ে ‘অগ্ণি আঁখরে আকাশের গায়’ নাম লিখে গেছেন  তাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়৷ আজ আমি এমন একজন নারীর কথা বলবো যাঁর অসীম সাহস ও স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ ভারতের স্বাধীনতা আনয়নের পথ যথেষ্ট সুগম করেছিল৷

ব্রিটিশ শাসনে ও শোষণে জনগণ যখন বিক্ষুদ্ধ ঠিক সেই সময় প্রবর্তিত হলো সাইমন কমিশন৷ ফলে জনগণের বিদ্রোহাগ্ণিতে যেন ঘৃতাহুতি পড়লো৷ সাইমন কমিশনকে কেউই সুনজরে দেখলো না৷ কমিশনের সদস্যরা যেখানেই যান সম্বর্ধনা দূরের কথা কেবল গালিগালাজ আর অসম্মানসূচক শ্লোগান পুরস্কার স্বরূপ নিয়ে আসেন৷ ভারতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই রুখে দাঁড়ালো সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে৷ ভারতের ভাগ্যাকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো৷ ১৯৩০ সাল৷ গান্ধীজী শুরু করলেন লবণ আন্দোলন৷ এই আন্দোলনের  ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতে৷... ১৮ই এপ্রিল৷ চট্টগ্রামে উঠলো তুমুল ঝড়৷ সশস্ত্র বিপ্লবী দল হুংকার দিয়ে উঠলো৷ আকাশ মাটি কাঁপিয়ে ফাটতে লাগলো বোমের পর বোম৷.... রাত তখন সোয়া দশটা৷ লোকনাথ বল, নির্মল সেন, রজত সেন, মনোরঞ্জন সেন, ফণী নন্দী, সুবোধ ঘোষ আর জীবন ঘোষাল ট্যাক্সি করে চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগারের দরজায় পৌঁছলেন৷ উচ্চপদস্থ সেনানীর  ছদ্মবেশে লোকনাথ অস্ত্রাগারের বারান্দায় উঠতেই একটি প্রহরী তাঁকে বাঁধা দিল৷

লোকনাথের পিস্তল গর্জে উঠলো গুড়ুম! সঙ্গে সঙ্গে  প্রহরীর দেহ লুটিয়ে পড়লো মাটিতে৷ পিস্তলের আওয়াজ শুনে অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মেজর ফারেল ত্রস্তচকিতে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে৷  বিপ্লবীর গুলিতে তিনিও লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে৷ আর উঠলেন না৷ ....অন্যান্য প্রহরীরা যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেল৷  বিপ্লবীরা অস্ত্রশস্ত্র লুট করে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পালিয়ে গেলেন৷....অস্ত্রাগারে ধরিয়ে দিলেন আগুন৷ অনন্ত সিংহ আর গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে পাঁচজন সেনানী-বেশী বিপ্লবী পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে দখল করে নিল৷.. অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে জনকয়েক বিপ্লবী টেলিগ্রাম ও টেলিফোন অফিস দখল করে একচেঞ্জ-বোর্ড ভেঙ্গে চুরমার করে দিল৷... বিপ্লবীরা রেললাইন সরিয়ে দিয়ে চট্টগ্রামকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেললো৷... বিপ্লবীরা সকলে পুলিশ হেড-কোয়ার্টারে একত্রিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘টেম্পরারি গভর্নমেন্ট’৷ সভাপতি নির্বাচিত হলেন মাষ্টারদা--- সূর্য সেন৷... রাত্রি তখন দুটো৷ মুহুর্মুহু মেশিনগানের গুলি ছুটে আসতে লাগলো হেডকোয়ার্টারের দিকে৷ বিপ্লবীরা অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে পালিয়ে গেলেন৷ কয়েকজন আত্মগোপন করলেন জালালাবাদের পাহাড়ে৷ বিপ্লবী হিমাংশু সেন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আগুন ধরিয়ে দিলেন... কয়েকদিন উভয়পক্ষই চুপচাপ৷... ২২শে এপ্রিল আবার সংঘর্ষ শুরু হলো৷ সরকারী পুলিশ ও সৈন্যরা জালালাবাদ পাহাড় চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো৷ বিপ্লবীরা বীরবিক্রমে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন তাদের দিকে৷ ...সারাদিন যুদ্ধ করে সন্ধ্যা সাতটার সময় তাঁরা জয়ী হলেন৷

১লা সেপ্ঢেম্বর৷...

সরকারী সৈন্য ও বিপ্লবীদের মধ্যে আবার সংঘর্ষ বাধলো চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে৷ এই গ্রামে সাবিত্রী দেবী নামের এক বিধবার বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সূর্য সেন, নির্মল সেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত আর অপূর্ব সেন৷ সৈন্যরা তাঁদের ঘেরাও করলো৷... সূর্য সেন, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সৈন্যদের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে গেলেন৷... বাদ বাকী সব ধরা পড়লেন৷ কারো হলো ফাঁসি, কারো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, কারো বা দীপান্তর বাসঙ্গী... সূর্য সেন তখনো মুক্ত৷ চট্টগ্রামের উপকন্ঠে পাহাড়তলীতে ইয়ূরোপীয়দের ক্লাব৷ ক্লাবটা রেল ষ্টেশনের কাছেই অবস্থিত৷ প্রতি শনিবার রাত্রে এই ক্লাবে উচ্চপদস্থ রেলওয়ে অফিসার ও ইয়ূরোপীয়ানরা আমোদ প্রমোদে মেতে ওঠে৷ অনেক বদমাইস সাহেবও তাতে যোগ দেয়৷

সূর্য সেন ঠিক করলেন ক্লাবটা আক্রমণ করতে হবে৷ কিন্তু  নেতৃত্ব করবে কে? চিন্তিত হলেন সূর্য সেন৷ এমন সময় তাঁর সামনে দাঁড়ালেন একজন নির্ভীক নারী৷ বুদ্ধিদীপ্ত তাঁর চেহারা৷ শরীরের গঠন লতার মতো অবনত নয় ---রীতিমতো সুঠাম ও শক্ত সবল৷ কে তিনি? চট্টগ্রামের  বীরকন্যা৷ কি নাম? প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার৷ সংসারের কঠোর দারিদ্র্য তাঁকে কাবু করতে পারেনি৷ মেয়েরাও যে দুর্বলতার ঘোমটা খুলে ও লজ্জার বেড়া ভেঙ্গে মহাসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারেন তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এই প্রীতিলতা৷ ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সংঘটনমূলক কাজে উৎসাহ ছিল৷ স্কুল-লাইফে তিনি গার্লসগাইডে নিযুক্ত ছিলেন৷ লাঠিখেলায় তিনি ছিলেন ওস্তাদ৷ অসি চালনায়ও তাঁর জুড়ি পাওয়া ভার৷

পিতার সামান্য চাকরিটা যখন খোয়া গেল, সংসারে যখন দুর্ভাবনার কালো ছায়া ঘনিয়ে এলো প্রীতিলতা তখন চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন৷ একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষয়িত্রীর চাকরি পেয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে ৷ কিন্তু আয় সামান্য৷ সংসার চালানো দায়৷ বাবা-মা বুড়ো হয়েছেন৷ চার চারটে ভাইবোন তাঁর মাথার ওপর ৷ অবসর সময়েও কিছু ছাত্রী পড়িয়ে কোনরকমে সংসার চালাতে লাগলেন৷ কিন্তু তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভারতের তেত্রিশ কোটি অসহায় নরনারীর পাণ্ডুর ম্লানমুখ৷ ইংরেজ সরকারের শাসনে শোষণে নিপীড়িত লাঞ্ছিত ব্যথিত ভারতীয় আবাল-বৃদ্ধ বনিতার আর্তনাদ তাঁকে ক্ষণে ক্ষণে চঞ্চল করে তোলে৷ পরাধীন ভারতের মুক্তির আহ্বানে তিনি সাড়া না দিয়ে পারলেন না৷.... যোগ দিলেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সাথে৷ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন গুরুভার---বিপদ সংকুল নেতৃত্ব৷ ২৪শে সেপ্ঢেম্বর, ১৯৩২ সাল৷ শনিবার রাত্রি৷ ক্লাবে উল্লাসের ঢেউ বইছে৷ অফিসাররা প্রমোদে গা ভাসিয়েছেন৷  হাসি ঠাট্টা তামাসার বান ডেকেছে৷ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অদূরে অপেক্ষা করছেন অগ্ণিকন্যা প্রীতিলতা৷ সাথে তাঁর আটজন অনুগামী৷ ক্লাবের সদস্যরা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না যে দুয়ারে স্বয়ং যম এসে উপস্থিত হয়েছেন৷ রাত্রি ন’টা৷ সুযোগ বুঝে অতর্কিতে আক্রমণ করলেন প্রীতিলতা৷ নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল হাসির রোল৷ চট্টগ্রামের মাটি কেঁপে উঠলো বোমার হুংকারে৷ আকাশ বাতাস আলোড়িত হলো পিস্তলের অবিরাম গর্জনে৷ সাদা চামড়ার লাল রক্তে ভেসে গেল ক্লাবের মেঝে৷... অক্ষত দেহে ফিরে এলেন বিপ্লবীরা৷

কিন্তু তাঁদের নেত্রী প্রীতিলতা রেহাই পেলেন না৷ একটি বোমার টুকরো তাঁর বুকের অনেকখানি ভেতরে ঢুকে গেছে৷ টলতে টলতে তিনি বেরিয়ে এলেন ক্লাব থেকে৷ সঙ্গীদের  ইশারা করে পালাতে বললেন৷ তিনি বুঝতে পেরেছেন, তাঁর জীবন প্রদীপের তেল ফুরিয়ে এসেছে৷ শরীর অবসন্ন৷ রক্তে ভেজা ছপছপে বুকে হাত দিয়ে ক্লাব ভবন থেকে কিছুদূর এগোলেন৷ বজ্জাত ইংরেজের হাতে তিনি ধরা দেবেন না৷ মৃত্যুর জন্য তিনি তৈরী হয়েই এসেছেন৷

....ধীরে ধীরে কোমরের গুপ্তস্থান থেকে বের করলেন সায়ানাইড---বিষ! তাই মহাশান্তিতে মুখ পুরে তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটির কোলে৷