স্বর্গ ও নরক

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

মানব সভ্যতার ঊষালগ্ণ থেকে মানুষ বলে আসছে আর তাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে বলছে যে যদি তুমি এটা করো তবে স্বর্গ পাবে আর যদি না করো তবে নরকে যাবে৷ একটা হ’ল স্বর্গ বা বেহেস্ত (Heaven), অপরটা হ’ল নরক বা দোজখ্ (Hell)৷ এ বিষয়ে কত রঙ-বে-রঙের চিত্র দেখিয়ে সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষকে ৰোঝানো হয় যে নরকবাসীদের কী দুঃসহ যাতনায় না ভুগতে হয়৷ আর যারা কর্মগুণে স্বর্গে যায় তারা কী অপূর্ব আনন্দে না দিন কাটায়৷ তারা সোণার পালঙ্কে শোয়, রুপোর পালঙ্কে পা বিছিয়ে আরাম করে আর শুয়ে শুয়ে তারা চর্ব-চূষ্য-লেহ্য-পে ভোগ করে৷ গত কয়েক হাজার বছর ধরে এই ধরনের বহুতর গাল-গল্প চলে আসছে, এই ধরনের ডগমা বা ভাবজড়তা শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে গণমানসে সঞ্চারিত হচ্ছে৷ এসবের পেছনে মূল মতলবটা হ’ল যে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে সৎ পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অথবা তার ভীতম্মন্যতার সুযোগ নিয়ে তাকে ভালোভাবে শোষণ করা৷

এখন দেখা যাক, এই যে স্বর্গ-নরক সম্পর্কিত কাহিনীর দার্শনিক দৃষ্টিকোণগুলো আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা অথবা এগুলি নিতান্তই ৰৌদ্ধিকতা বর্জিত ভাবজড়তা বা ডগ্মা কিনা৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, সুখ ভোগটা করে কে? -- না, ভোগটা করে মন, শরীর নয়৷ আবার তেমনি দুঃখ ভোগটাও করে মন৷ কর্মের কর্তা হ’ল মন৷ শরীরের মাধ্যমে মনই কাজ করে৷ আবার কর্ম-ফল ভোগাটা হ’ল মানুষের মন৷ মন হয় শরীরের মাধ্যমে ভোগটা করে নয়তো মনের দ্বারা সরাসরি ভোগ করে৷ শারীরিক কষ্ট হলে সেই কষ্টটা শরীরের মাধ্যমে ভোগ করে মন৷ আবার কখনও কখনও এমন হয় যে কারো বিশেষ পরিচিত ব্যষ্টির মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুজনিত দুঃখ মনই প্রত্যক্ষ রূপে ভোগ করে৷ এতে কোন শারীরিক মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা নেই৷ মৃত্যুর পর মানুষের মন আর মস্তিষ্ক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ স্নায়ুকোষের অভাবের ফলে মন ৰীজাকারে থেকে যায়, কর্ম করতে পারে না৷ কেন না স্নায়ুকোষ না থাকলে তার ভৌতিক স্পন্দনের সাহায্য মিলছে না৷ যদি মস্তিষ্ক বা স্নায়ুকোষ না থাকে তা হলে মন সুখভোগ বা দুঃখ ভোগ করবে কেমন করে? সুখ ভোগ বা দুঃখ ভোগের অনুভূতি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের মাধ্যমে গৃহীত হয়৷ যেমন ভুত৷ সংস্কৃত ভাষায় ভুত কে বলা হয় প্রেত৷ মস্তিষ্কের অভাবে প্রেত সুখ ভোগ বা দুঃখভোগ করতে পারে না৷ কারণ মৃত্যুর পর তার তো আর শরীর থাকে না৷ আর মনের সাথে চৈত্তিক ধাতুর কোন সম্পর্ক থাকে না৷ এই অবস্থায় মনও কাজ করতে পারে না৷ কেন না তার শরীর তো আর নেই৷ এই অবস্থায় ভুতও থাকতে পারে না, প্রেতও থাকতে পারে না৷ তাই ভুত-প্রেত বলে কিছু নেই৷ বিদেহী মনের দ্বারা কর্ম ফল ভোগ একেবারে অসম্ভব৷ সম্ভব নয়, এমন কি কোন কিছু করাও সম্ভব নয়৷ যতক্ষণ মন ও মস্তিষ্ক এক যোগে কাজ করে ততক্ষণই কোন কাজ করা সম্ভব বা কর্মভোগ করা সম্ভব৷ অতএব ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে মৃত্যুর পর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মন কোন কিছু করতে পারে না৷

এই পৃথিবীতে মানুষ সৎকর্ম বা অসৎকর্ম যাই করুক না কেন তার ফলভোগ তৎক্ষণাৎও হতে পারে, এই জীবনেও হতে পারে আবার পর জীবনেও হতে পারে৷ যদি কারুর মৃত্যু হয়ে গেল আর তার পুনর্জন্ম হ’ল না এই অন্তর্বর্তী সময়টায় কর্মফল ভোগ সম্ভব নয়৷ যেমন, যে লোকটার জিব নেই সে যেমন কিছুই খেতে পারে না তেমনি তার দ্বারা ফলভোগও সম্ভব নয়৷ যেমন ধর, কারুর মৃত্যু হয়ে গেল৷ জীবিত কালে যে খাবারটা সে খেত সেটা খেত তার শরীর৷ চিকিৎসা হ’ত তার শরীরটারই৷ এইজন্যে মানুষ যতদিন জীবিত আছে ততদিন তার ঠিক ঠিক উপযুক্ত খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত৷ মৃত্যু হয়ে গেলে আর এ সব করার অবকাশ নেই৷ সেই অবস্থায় তুমি একটা কাজই করতে পার৷ পরমপুরুষকে বলতে পার যে যতদিন এই মানুষটা আমাদের সাথে ছিল ততদিন যতদূর সম্ভব আমরা তার সেবা-শুশ্রুষা করেছি৷ এখন সে আর আমাদের মধ্যে নেই৷ তাই হে পরমপুরুষ, সেই তুমি মানুষটাকে দেখাশুনা করো৷ আনন্দমার্গে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বিধি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রচিত হয়েছে৷

এই ব্যক্ত জগৎ সপ্তলোক তথা পঞ্চকোষে বিভাজিত৷ ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ তপঃ ও সত্য -- এই সপ্ত লোকের অধীশ্বর হলেন পরমপুরুষ৷ তারই পবিত্র জ্যোতির ধ্যান করা হয়৷ সেই ধ্যান মন্ত্রকে সবিতৃ ঋক্ বলা হয়৷ সাধারণত লোকেরা যাকে গায়ত্ত্রী মন্ত্র বলে থাকে৷ এই সপ্তলোক বলতে পৃথক পৃথক দুনিয়া ৰোঝায় না৷ এই সপ্তলোকের নিম্নতম স্তর হ’ল ‘ভূঃ’ লোক আর ঊর্ধ্বতম স্তর হ’ল ‘সত্য’ লোক৷ এই উভয় স্তরই পরমপুরুষ দ্বারা আধৃত৷ আর এই দু’য়ের মধ্যবর্তী যে পঞ্চলোক সেটাই হ’ল মানব মনের পঞ্চকোষ৷ ভুবর্লোক হ’ল স্থূল মন যা প্রত্যক্ষভাবে দৈহিক কর্মের সাথে সম্পর্কিত৷ আর স্বর্লোক হ’ল সূক্ষ্ম মন৷ আর মনোময় কোষ হচ্ছে মানসিক স্তর৷ মুখ্যতঃ সুখ-দুঃখের অনুভূতি স্বর্লোক আর মনোময় কোষে হয়ে থাকে৷ তো এই যে স্বর্লোক একেই লোকে স্বর্গ বলে৷ স্বঃ  গ ঞ্চ স্বর্গ৷ সুখ দুঃখের অনুভূতি এই স্তরেই হয়ে থাকে৷ সৎকর্ম সমাপনান্তে মনের মধ্যে যে একটা গভীর প্রসন্নতা জাগে সেটা এই স্বর্লোক বা মনোময় কোষে হয়ে থাকে৷ এই স্বর্লোক সর্বদাই তোমার সাথে সাথে রয়েছে৷ যখন সৎকর্ম করো, মানব থেকে অতীমানবত্তায় উন্নীত হও তখন এই স্বর্লোক আনন্দানুভূতিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে৷ আর যদি মানুষের শরীর পেয়েও অধম কর্ম করতে থাক তাহলে তোমার স্বর্লোক দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে৷ তখন মনের সমস্ত অংশটাই আত্মগ্লানিতে ভরে ওঠে৷ স্বর্গ-নরক বলে কোন পৃথক পৃথক কিছু নেই৷ এই পৃথিবীতে তোমার মনের মধ্যে স্বর্গ লুকিয়ে রয়েছে৷ তাই যে পণ্ডিত বা মূর্খ মানুষকে স্বর্গ-নরকের অলীক কাহিনী শোণায় সে ঠিক কাজ করে না৷ বরং সে বিশ্বাসপ্রবণ মানুষদের জেনে শুনে পথভ্রষ্ট করে, বিপথে পরিচালিত করে তাই এই সমস্ত মানুষদের থেকে সযত্নে দূরে থাকবে৷ এরা ভাবজড়তার প্রচারক৷ এরা ডগমার প্রচারক৷

এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখবে এই যে ভূর্লোক, তুমি এই ভূর্লোকে রয়েছো কিন্তু তোমার মন তার থেকেও নীচে নেমে যাচ্ছে৷ সেই অবস্থায় স্থূল বস্তু থেকেও ভুর্লোক স্থূল৷ মন তার থেকেও অধিকতর জড় হয়ে যায়৷ মানুষের শরীর রয়েছে ঠিকই কিন্তু তার মনটা মানুষের মনের চেয়ে অধিকতর জড় হয়ে যায়৷ এমন কিছু পশুপক্ষীর মনের চেয়েও অধিকতর জড় প্রাপ্ত হয়৷ এমন কি ইট, কাঠ পাথরের চেয়েও৷ সেই মন ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ সত্যের দিকে এগোয় না যদিও কামময় কোষ, মনোময় কোষ যথাক্রমে মনের ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতর কোষ৷ কিন্তু তার যে ধরনের ভাবনা, যে ধরনের পরিস্থিতি সেটা ভুর্লোক, স্থূল থেকেও স্থূল৷ এগুলো কোন পৃথক সত্যলোক নয়৷ কেন না বাস্তবে এ সবকিছুই মনের মধ্যে নিহিত রয়েছে৷ এগুলো হ’ল তল, অতল, বিতল, তলাতল, পাতাল, অতিপাতাল ও রসাতল৷

রসাতল হ’ল সর্বনিম্ন তল৷ যে লোকটার শরীর মানুষের মত কিন্তু কর্মগুলো মনুষ্যোচিত নয় তার অবস্থাটা কেমন? এমনিতে সে ভুর্লোকে রয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু তার মন ভুর্লোকের নীচে নেমে যাচ্ছে ও মৃত্যুর পর সে আর মানুষের শরীর পাবে না৷ সে তখন ইট, কাঠ, পাথরের মত সম্পূর্ণ জড়দেহ পাবে৷ অথবা গাছপালা, কীট-পতঙ্গ হয়েও জন্মাতে পারে৷ এসব ঠিক কথা, এসব যুক্তিগ্রাহ্য কথা৷ স্বর্গ-নরকের কথা বেহেস্ত-দোজখ্ (Heaven and Hell) -এর্ কাহিনী একেবারে ৰুজরুকি৷ এর পেছনে রেলিজন বা মঝহব কাজ করে ঠিকই, অপরকে ভীতি প্রদর্শন অথবা শোষণের জঘন্য মনস্তত্ত্ব ছাড়া এর পেছনে আর কোন সত্যতা নেই৷ এটা আগাগোড়াই ডগমা বা ভাবজড়তা৷ ৰুদ্ধিমান মানুষ, ধার্মিক সাধক এ ধরনের ডগমাকে প্রশ্রয় দেবে না৷ বরং সে বলবে, ‘‘এই ধূলির ধরণীকে স্বর্গে রূপান্তরিত করো৷ মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান্ ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করো৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে চল৷ আর এভাবে আমাদের এই মাটির পৃথিবীটা স্বর্গে রূপান্তরিত হোক৷’’