সদ্বিপ্র সমাজকে ঠেকাতে পুঁজিপতিদের নয়া কৌশল

লেখক
সুকুমার সরকার

যোগী মহারাজ যোগের উচ্চাসন ছেড়ে উত্তরপ্রদেশে রাজ-সিংহাসনে বসেছেন৷ এ নিয়ে ভারতীয় সমাজ-রাজনীতি আজ দ্বিধা বিভক্ত হিন্দুত্ববাদীরা মহা উল্লাসিত ৷ তারা ভাবছেন, এবার উত্তরপ্রদেশে ধর্মের ধবজা পত্পত্ করে উড়বে৷ অহিন্দুত্ববাদী বা সেকুলারবাদীরা ক্ষুব্ধ তারা ভাবছেন এবার ভারতীয় মিলন-সংসৃকতিতে সংকীর্ণতার বীজ বপন হবে ৷

কিন্তু কোনটা ঠিক ভারতীয় সমাজ-রাজনীতিতে৷ ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত সাধুসন্তরা কখনো প্রত্যক্ষ ভাবে রাজসিংহাসনে বসেননি৷ বিপ্রযুগেও রাজসিংহাসনে যোগী-মুনীরা বসতেন না৷ তাঁরা রাজাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন৷ পরোক্ষভাবে রাজাদেশ নিয়ন্ত্রিত হতো কোনো যোগী বা ত্যাগী মহারাজের দ্বারা অর্থাৎ সিংহাসনে কোনো গৃহী বসতেন, আর সিংহাসনের উচ্চাসনে পরোক্ষে থাকতেন সন্ন্যাসী বা সাধু-সন্তরা৷

এখন বৈশ্যতন্ত্রের যুগ প্রত্যক্ষে রাজা বা মন্ত্রিবর্গ রাজসিংহাসনে বসেলেও, সেই সিংহাসনে কখন কে বসবেন, বা তিনি কী কী কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করবেন, তা ঠিক করেন বৈশ্যরা বা পুঁজিপতিরা৷

এইভাবে প্রথমে শূদ্রযুগ, তারপর ক্ষাত্রযুগ, তারপর বিপ্রযুগ, তারপর বৈশ্যযুগ আসে৷ সমাজচক্র এভাবেই ঘুরে চলে৷ কোনো যুগে সেই যুগের শাসকেরা যখন অতিমাত্রায় শোষক বা অত্যাচারীর ভূমিকায় নামেন তখন জনগণ ভোটের দ্বারা বা বিপ্লবের দ্বারা সেই যুগের অবসান চায়৷ আমরা বিংশ শতাব্দীতে সেই রকমের একটি পরিবর্তনের চেষ্টা দেখেছি মার্ক্সীয় সাম্যবাদীদের মধ্যে৷ কিন্তু তা পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব ছিল না৷ ফলে তা ক্ষণস্থায়ী হয়েছে৷ প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবার ফিরে এসেছে চরম বৈশ্যতান্ত্রিকতা৷ আর সবচেয়ে বিপদের হচ্ছে এই বৈশ্য (পুঁজিবাদী ছায়া সংঘটক)-রা সিংহাসনে বসছেন না৷ সিংহাসনে বসাচ্ছেন এমন কাউকে যাঁকে দিয়ে তাদের পুঁজির পাহাড় আরও স্ফীত হয়ে উঠবে৷ অর্থাৎ সমাজচক্রের নিয়ন্ত্রণে আজ পুঁজিবাদীরা৷ তারাই ভারতীয় জনমানসের সেণ্টিমেণ্ট বুঝে সেই মতো যোগী বা ভোগীদের সিংহাসনে বসাচ্ছেন৷ কিন্তু জনগণ যেটা আশা করেছেন সেটা এই নেপথ্যের পুঁজিবাদীদের দ্বারা কখনোই পূরণ হবে না ৷ চাই নোতুন কোনো নিয়ন্ত্রক সংঘটক যাঁরা সর্বযুগেই সমাজচক্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকবেন৷ তাঁরা হবেন সর্বত্যাগী সদ্বিপ্র৷ এমনই এক নোতুন যুগান্তকারী আর্থ-সামাজিক দর্শন এসেছে ---যার নাম প্রাউট (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব)৷

প্রকৃতির নিয়মে সমাজচক্র ঘুরে চলবেই৷ কিন্তু সেই ঘূর্ণায়ণে কোনো যুগে যদি সেই যুগের শাসকেরা শোষকের ভূমিকায় বা অত্যাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে এই সদ্বিপ্ররা তা নিয়ন্ত্রণ করে পরবর্তী যুগকে আনয়ন করবেন৷ ভারতীয় সমাজ-রাজনীতিতে সর্বত্যাগী সদ্বিপ্রদের এই ভূমিকা এঁরা কখনোই চক্রের পরিধিতে থাকবেন না৷ এঁরা থাকবেন চক্রের ধুরী বা প্রাণকেন্দ্রে নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে৷ আর যেহেতু সদ্বিপ্রের জীবনে শূদ্র, ক্ষাত্র, বিপ্র (Intellectual) ও আধ্যাত্মিক মানসিকতার সমন্বয় থাকবে তাই তাঁদের মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকবে না ৷

কিন্তু আজকের উত্তরপ্রদেশে যে যোগী মহারাজ রাজসিংহাসনে বসলেন---তাঁর রাজভিষেক ভারতীয় সমাজ-মানসিকতায় কাঙ্ক্ষিত নয়৷ এতে ত্যাগীদের গেরুয়া রঙে কলঙ্কের ছাপ লাগবে৷ আগামী দিনে সদ্বিপ্রদের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরী হবে ৷

বোধকরি আগামী দিনে সদ্বিপ্রদের ঠেকাতে, সদ্বিপ্র সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখতে পঁুজিবাদীদের এটা একটি কৌশল৷ কেননা দোর্দণ্ডপ্রতাপ আজকের কর্পোরেট পুঁজিবাদ ধর্মের নামে প্রথাপদ্ধতি, আচার-আচরণ সর্বস্ব ধর্মমতগুলিকেই বেশি করে উৎসাহিত করছে, যাতে করে প্রকৃত মানব ধর্মের জয়যাত্রাকে প্রতিহত করা যাবে৷ প্রাউটের সদ্বিপ্র-নিয়ন্ত্রণে যে সমাজ-রাষ্ট গঠিত হবে তা হবে ধর্মমত, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের৷ আবার শুধু মানুষের নয়, মানুষ, পশু, পাখি-উদ্ভিদ সকলের সকলের বাঁচা, বাড়ার প্রকৃত মুক্তির সনদ এনে দেবে৷ সদ্বিপ্র নিয়ন্ত্রিত প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের আদর্শের ওপর আধারিত রাষ্ট্রনীতি নিপীড়িত নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত মানবকুল, জীবকুল চাইছে এই সমাজ ব্যবস্থা৷ যোগী মহারাজদের হাতে কি সেই দর্শন আছে ?

---হলফ করে বলা যায়, নেই

---তাহলে

---যা হবার তাই হবে যোগগুরু রামদেব যেমন যোগাসন শেখানোর নামে হাজারো পণ্যের বিজ্ঞাপনের ব্র্যাণ্ড এ্যাম্বাসেডার হয়ে উঠেছেন, তেমনি যোগী মহারাজ ভোগী মহারাজ হয়ে উঠবেন রাজ-সিংহাসনের ইতিহাস তো তাই বলে |