সেবা ও ব্যবসায়

লেখক
শ্রীসুভাষ প্রকাশ পাল

১৯৯৫ সালের সেপ্ঢেম্বর মাস৷ কয়েকদিন প্রবল বর্ষনের কারণে কংসাবতীর বাঁধ ভাঙায় ডেবরা ও পাঁশকুড়া  ব্লকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে৷ বিপুল সংখ্যক মানুষ, গবাদি পশু চরম দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে, বন্যা হওয়ার পরের দিন থেকেই আনন্দমার্গ ইয়ূনিবার্র্সল রিলিফ টীমের Amurt) উদ্যোগে আচার্য পূর্ণানন্দ অবধূতের পরিচালনায় ১৫/১৬ জনের একটি রিলিফ টীম বন্যাত্রাণ কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক শ্রী নির্মলচন্দ্র মাইতির বদান্যতায় শ্যামসুন্দরপুর পাটনা হাইসুকলের একটি কক্ষে শিবির স্থাপন করে ত্রাণকার্য পরিচালিত হতে থাকল৷ প্রথমদিন বাড়ির ছাদ, খড়ের চালের মাথায়, গাছের ডালে  আশ্রয় নেওয়া মানুষজনদের উদ্ধারকার্যে হাত লাগালেন তরুণ সর্বক্ষণের কর্মী আচার্য নবোন্মোষানন্দ অবধূত এবং অসিত, পুতুল, সুশান্ত, চঞ্চল,নয়ন প্রমুখ স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ, যেভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা উদ্ধারকর্ম সমাধা করলেন সেই লোমহর্ষক কাহিনী আজও লোকের মুখে মুখে শুণতে পাওয়া যায়, তারপর কয়েকদিন চিঁড়া,গুড়, মুড়ি, বিসুকট ইত্যাদি শুকনো খাবার ও শিশুদের জন্য দুধ ও অন্যান্য শিশু খাদ্য  বিতরণ করা হল৷ সরকারী সাহায্যও আসতে শুরু করেছে৷ তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য, রান্না করা খাদ্য সামগ্রীর প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের পক্ষ থেকে রান্না করা সামগ্রী খিঁচুড়ি-ভাত-ডাল-শব্জী বিতরণ করা শুরু হল৷ আচার্য পূর্ণানন্দ অবধূতের  সুনিপুন পরিচালনায় স্বেচ্ছাসেবকদের একটি টীম মাঠে নেমে ত্রাণকার্যে হাত লাগিয়েছে অন্য আর একটি টীম যে এলাকায় বন্যা হয়নি সেখানে ত্রাণকার্যের জন্য খাদ্যসামগ্রী এবং অর্থ, ঔষধ ইত্যাদি সংগ্রহ করা শুরু করেছে৷ চার পাঁচদিন যেতে না যেতেই বন্যা অঞ্চলে দেখা দিল আর এক ধরণের বিপদ সংকেত, যাকে বলা যায় গোদের উপর বিষফোঁড়া,চারিদিকে শুধু জল আর জল৷ মানুষ ও গরু ছাগলের  মল-মূত্র সেই জল মিশ্রিত হওয়ার এবং গাছের ডাল,গাছপালা, ঘাম ইত্যাদি পচে যাওয়ায় সেই জল আর বিশুদ্ধ থাকল না৷ ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ দেখা দিল৷ ফলে পেট খারাপ, জ্বর, সর্দি-কাশি ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিল৷

ডাক পড়ল হোমিওপ্যাথিতে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত আচার্য গুণাতীতানন্দ অবধূতের, শান্তি রাণীপালকে সহকর্মী হিসেবে রেখে তিনি হোমিও চিকিৎসা শুরু করলেন, প্রথম তিন-চারদিন বন্যাপীড়িত মানুষেরা এসে ঔষধ নিয়েছেন, কিন্তু রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্দ্ধমান, সকাল আটটায় চিকিৎসা পরিষেবা শুরু হয়৷ দুপুরে এক ঘন্টা বিশ্রাম, তারপর রাত্রি দশটা এগারটা পর্যন্ত সেবাকার্য চলতেই থাকে৷ এমনও দিন গিয়েছে--- যখন চেম্বার বন্ধ করা হয়েছে, ঘড়িতে তখন রাত্রি বারটা, রাত্রি দশটা থেকে সন্ন্যাসী দাদাকে চেম্বার বন্ধ করার জন্য বারে বারে অনুরোধ জানান হত৷ কিন্তু কে শোনে  কার কথা, তাঁর একটাই কথা ---যতক্ষণ রোগী থাকবে ততক্ষণ আমি পরিষেবা দিয়ে যাব, ওরা অসুবিধায় পড়েছে বলেই না আমাদের কাছে এসেছে৷’’ পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল--- যেখানে বন্যা হয়েছে সেখানকার মানুষজন তো অসুস্থ হয়ে ঔষধ নিচ্ছেই, যেখানে বন্যা হয়নি সেখানকার মানুষজনও এসে ঔষধ নিচ্ছেন৷ কাউকে না বলা যাচ্ছে না, পাশাপাশি এক-দুই কিলোমিটার মধ্যে ডাক্তারবাবুদের চেম্বার পুরোপুরি বন্ধ, তাঁদের কয়েকজন লজ্জা, সঙ্কোচ, অভিমান ত্যাগ করে অবধূতজীর কাছে এসে জানালেন--- ‘আমাদের ডাক্তারী চেম্বার পুরোপুরি বন্ধ৷ এতে আমাদের কোনো দুঃখ নেই৷ শুধু আপনার পাশে থেকে আমাদের সেবা করার একটু সুযোগ দিন অন্তরের আশা---এভাবে বন্যাদুর্গতদের সেবা করে নিজেদের জীবন ধন্য করবেন৷ দ্বিতীয়তঃ মহারাজের নিকট থেকে তাঁর অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতিটাও কিছুটা শেখা যাবে৷ সেই যাই হোক, রোগীর সংখ্যা এত বাড়তে থাকল যে দিন পনের পার আনন্দমার্গের পক্ষ থেকে চেম্বার বন্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকল  না৷

একদিন কথাপ্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় নির্মলবাবু হাসতে হাসতে গুণাতীতানন্দদাকে বললেন---আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই৷ আমাদের এলাকার ডাক্তার বাবুদের রুজি-রোজগার বন্ধ করে দিচ্ছেন৷ আপনার কাছে রোগীদের এত যে ভীড় হচ্ছে ---এর রহস্যটা কী? উত্তরে গুণাতীতানন্দ দা জানালেন ---আমার কাছে রোগীদের এত যে ভীড় হচ্ছে এতে আমার বা আমাদের কোন কৃতিত্ব নেই৷ সবই গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কৃপা৷ তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই আমরা মানুষের সেবা করি৷ সেবা হবে একতরফা, সেবা হবে শর্তহীন, সেবার বিনিময়ে আমরা কোন কিছু ফিরে পাওয়ার আশা রাখি না৷ যখনই বিনিময়ে কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকবে তখন তা হবে ব্যবসায়৷ পাঁচ কেজি আলু দিলাম একশত টাকা পেলাম৷ এটা ব্যবসায় কিন্তু প্রকৃত সেবার মধ্যে বিনিময়ে কোন কিছু প্রাপ্তির আশা থাকবে না৷ আমি যখন ঔষধ দিচ্ছি, বিনিময়ে কোন অর্থ বা অন্যকিছু নিচ্ছি না, শুধু তাই নয়, সেবা করতে হয় সেবাকে নারায়ণ জ্ঞানে,অর্থাৎ পরমপুরুষ ক্ষুধার্থ রোগক্লিষ্ট মানুষের রূপ ধরে আমাদের কাছে সেবা নিতে এসেছেন এতে তিনি ধন্য হচ্ছেন না৷ ধন্য হচ্ছি আমি বা আমরা যারা সেবা করছেন৷ এই বোধে সেবা করার জন্যই এত দ্রুত রোগমুক্তি সম্ভব হচ্ছে৷ আনন্দমূর্ত্তিজীর কথায় ---‘‘কোনো জীবকে ঘৃণা করবার অধিকার তোমার নেই৷ তুমি কেবল সেবাই করতে পার৷ মনে রেখো প্রতিটি জীবকে ব্রহ্মের বিকাশ ভেবে সেবা করতে হবে৷ এটাও মনে রেখো  এই সেবার গৌরবও তোমার প্রাপ্য নয়৷ এই গৌরব তাঁরই প্রাপ্য যাঁর শক্তিতে তুমি সেবা করছ, যাঁর ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তুমি সেবা করবার  যোগ্যতা অর্জন করেছ৷’’ বিবেকানন্দ বলেছেন---‘‘জীবে প্রেমে করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর৷’ অর্থাৎ জীবই শিব৷ শিবজ্ঞানে জীবের সেবা করতে হবে৷

বর্তমান সমাজে বিপরীত চিত্রটাই আমরা দেখতে পাই--- জনগণের সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠা বিজ্ঞাপন দেন--- জনগণের সেবায় নিয়োজিত অমুক প্রতিষ্ঠান৷ কতখানি মিথ্যাচার এটা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ রাজনীতির  নামে জনসেবা --- বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এটা ভ্রষ্টাচার ছাড়া কিছু নয়, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ দেশসেবার নাম করে আত্মসেবায় মগ্ণ হন৷ এটা প্রকারান্তরে ব্যবসায়৷ নিন্দুকেরা বলে-বিনা মূলধনে ব্যবসায় অর্থাৎ একটু সেবা দিলাম, বিনিময়ে অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি, নিজের পরিবারের ও আত্মীয় স্বজনের আখের গোছানো ইত্যাদি সুবিধা নিলাম৷ যাঁরা ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনে বিশ্বাসী তাঁদের পক্ষেই প্রকৃত সেবা করা সম্ভব হয়৷ তাঁরা  অনুভব করেন--- সবার মাথার উপ একজন সৃষ্টিকর্র্ত আছেন৷ তাঁকে কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে খৃষ্ট, কেউ বা বলে আল্লা ইত্যাদি৷ মানুষ, তরুলতা, পশুপাখী সবাই তাঁর সন্তান৷ আমাদের পরস্পর ভাইবোনের সম্পর্ক, কারও সন্তানকে ভালবাসলে মা যেমন তুষ্ট হন, সেরূপ ঈশ্বরের সৃষ্ট জীবজগতকে ভালবাসলে ঈশ্বর ও সন্তুষ্ট হন৷ এই মনোভাবের বশবর্তী হয়ে তাঁরা সেবাকর্মে রত হন৷ অপরপক্ষে যাঁরা জড়বাদী দর্শনে বিশ্বাসী, তাঁরা কর্তব্যের তাড়নায় রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে সেবামূলক কর্ম শুরু করেন, কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর সেই কর্তব্যবোধ ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে শুরু করে ও পরার্থ পরতার পরিবর্তে আত্মসুখ চরিতার্থতাই জীবনে প্রধান হয়ে উঠে, ফলত একসময় তাঁরা সবার অশ্রদ্বার পাত্রে পরিণত হন৷

আমাদের সবারই শিববাক্য মেনে চলা উচিত, তা হল--- ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্বিতায় চ’’ জীবনের লক্ষ্য আত্মমুক্তি বা মোক্ষ জগতের কল্যাণের  মধ্য দিয়েই সেই মুক্তি লাভ সম্ভব৷ নিষ্কামভাবেই মানুষ, পশুপক্ষী ও উদ্ভিদজগতের সেবা করতে হবে৷ এছাড়া অন্য কোন পথ নেই৷ ‘নান্যঃ পন্থাঃ আয়নায়৷’’