সেবা, পরিষেবা ও ব্যবসা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

সেবা বলতে আমরা বুঝি যে কাজ নিঃস্বার্থে করা হয়, যে কাজের বিনিময়ে কোন কিছু প্রত্যাশা করা হয় না৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আর্তজনের সেবা, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য, দরিদ্র নারায়ণের সহায়তা ইত্যাদি৷ সেবার মাধ্যমে অপর জনের অভাবকে শ্রম, অর্থ, বুদ্ধি তথা মানসিক ও মানবিক সহায়তা দিয়ে নিঃস্বার্থ ভাবে পূরণ করে দেওয়ার প্রয়াসই প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয়৷ যখন অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে অপরের জন্যে কাজ করা হয় তাকে বলে পরিষেবা৷ পুরসভা অর্থ বা করের বিনিময়ে নাগরিকদের যে কাজগুলো করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, পরিবহন, শিক্ষা, ব্যাঙ্ক, ডাক ও তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের কাজকর্ম ইত্যাদি হল পরিষেবা---এককথায় যেগুলোকে বলা হয় service sector ৷ এদিক থেকে দেখতে গেলে জনস্বাস্থ্য বিভাগ, হাসপাতাল বা নার্সিং হোম গুলির কাজকর্ম পরিষেবা হিসেবেই গণ্য৷ যখন কোনও পণ্য বা ভোগ্যবস্তু অন্য কোনও পণ্য বা অর্থের (ধাতব মুদ্রা বা কাগজে মুদ্রিত নোট যেমন টাকা, ডলার, পাউণ্ড ইত্যাদি) বিনিময়ে বেচাকেনা হয় তখন আমরা ব্যবসা বলি৷ প্রকৃত অর্থে পরিষেবা বিভাগ(service sector) এক ধরণের ব্যবসাই করে, তবে তাদের কাজের ধরণটা আলাদা৷ আর স্বাস্থ্য বিভাগ, হাসপাতাল, নার্সিং হোম ইত্যাদির পরিষেবার চরিত্র ও পরিসর ভিন্নতর৷ কারণ তাদের কাজকর্মের সঙ্গে মানুষের অসহায়তার সম্পর্ক রয়েছে৷ মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়, তখনই হাসপাতাল, নার্সিং হোমে আসে৷ এই সময় মানুষ ভীষণ দুর্বল ও অসহায় হয়ে যায়৷ সেই কারণে হাসপাতাল, নার্সিং হোমের পরিষেবা শুধুমাত্র আর্থিক লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না---সেখানে মানবিক আবেদন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷
স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সরকারী হাসপাতাল রয়েছে, তেমনি অপরদিকে আছে বেসরকারী হাসপাতাল ও নার্সিং হোম---বিভিন্ন নামে ও সংস্থার পরিচালনায় সাধারণ মানুষ সরকারী হাসপাতালগুলি থেকে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে পরিষেবা পান৷ সরকারী হাসপাতালগুলি সরকারী অর্থে পরিচালিত ---সেখানকার ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মচারীগণ সরকারের তহবিল থেকে বেতন পান আর এই তহবিল আসে জনগণের প্রদত্ত বিভিন্ন ধরণের করব্যবস্থা থেকে৷ বেসরকারী হাসপাতাল বা নার্সিংহোমগুলি পরিচালিত হয় ব্যষ্টিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে আইনগত বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে৷ এই বেসরকারী হাসপাতালগুলির পরিষেবা জনগণকে উচিত মূল্য দিয়েই কিনে নিতে হয়৷ এই উচিৎ মূল্যের জায়গাটাই হল সবথেকে বেশী গোলমেলে আর এর ফলেই সাধারণ রোগী ও তাঁর আত্মীয়স্বজন হয়রানির শিকার হন৷ এক-একটা বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম তাদের পরিচ্ছন্নতা, রকমারি ব্যবস্থাপনা, সৌন্দর্য্যায়ন, বেড, কেবিন, অপারেশন থিয়েটার, আইসিইয়ূ, আইটিইউ, ভেণ্টিলেশন ইত্যাদির জন্য এক এক রকম খরচ ধার্য করে৷ যার ফলে চিকিৎসা খরচ এতটাই ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে যে সাধারণ মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যায়৷ তবুও মানুষজন শুধুমাত্র সঠিক ও সত্ত্বর চিকিৎসা পাওয়ার আশায় ওইসব বেসরকারী হাসপাতালগুলিতে আসেন৷ কিন্তু সাধ্যাতীত ব্যয় করা সত্ত্বেও (অনেক ক্ষেত্রেই জমিজমা, সঞ্চিত অর্থ, সোনাদানা ইত্যাদি বিক্রি করে) যদি মানুষ সঠিক ও সত্ত্বর সু-চিকিৎসা না পায়, মানবিক ব্যবহারের পরিবর্তে কঠোরতার সম্মুখীন হয় তখনই বাধে গণ্ডগোল৷ এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী বা মৃত রোগীদের নিয়েও বিভিন্ন রকম টালবাহানা চলে ও মূল্যবান সময়ের অপচয় হয়---ফলে জীবনের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অযথা সময় ক্ষেপনের জন্যে মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়৷ তখনই রোগীর আত্মীয়-পরিজন বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে৷ যে সময়ে মানুষের সব থেকে বেশী মানবিক ব্যবহার প্রয়োজন, তখন যদি রূঢ় ব্যবহার ও অর্থপিশাচসুলভ আচরণ প্রদর্শিত হয়---সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগী মানুষজনের ক্ষোভের মাত্রা ভীষণভাবে বেড়ে যায় ও বিভিন্ন ভাবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ পরিস্থিতি বিচার করে সঠিক আচরণ ও আর্থিক লাভের অঙ্কের পরিবর্তে সেবা পরায়নতার মনোভাবই কাম্য ও আবশ্যিক৷
সরকারী হাসপাতাল- গুলিতে রোগীর চাপ, আনুপাতিক পরিষেবার অপ্রতুলতা, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিলম্ব ও একশ্রেণীর কর্মচারীর দুর্নীতি, লোভ, অভব্য আচরণ ইত্যাদির ফলে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষও বেসরকারী হাসপাতালে সুচিকিৎসা পাওয়ার জন্যে ছোটেন৷ এছাড়া যাঁদের যথেষ্ট সামর্থ্য আছে, তারা তো যানই৷ কিন্তু এক ধরণের বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিং হোম কেবলমাত্র লাভের অঙ্ক বাড়াবার উদ্দেশ্যে মানুষের অসহায়তা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে বিভিন্নভাবে শোষণ করে নিঃস্ব করে দেয় অথচ প্রয়োজনীয় পরিষেবাটুকুও প্রদান করে না৷ অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সাধারণ বেডের পরিবর্তে মূল্যবান আইসিইউ, ভেণ্টিলেশনে রেখে অর্থের অপচয়, অপ্রয়োজনীয় বা ভুল অপারেশন ও চিকিৎসার বিধিব্যবস্থা, ঔষধ, ভুয়ো ওষুধপত্র ও চিকিৎসকের বিল ইত্যাদি নানাভাবে খরচের বহর বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল রোগীর পরিজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হয়রান করে---যা একেবারেই এই পরিষেবার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷ শুধু তাই নয়, এই বেসরকারী হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলি সেবার নাম করে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে জমি ও বিবিধ রকমের ছাড়ের সুযোগ সরকারের কাছ থেকে পেয়ে থাকে৷ বেসরকারী হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে মানুষজনকে হয়রান করার অভিযোগ বহুদিন ধরেই চলছিল৷ সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধ্যক্ষ মহোদয় বিধানসভার বিধায়ক ও মন্ত্রীগণের চিকিৎসার বিলগুলি পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেশ কিছু অসঙ্গতি ও অনিয়ম লক্ষ্য করেন তিনি এই অসঙ্গতির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে সম্যক অবহিত করান৷ এছাড়াও অতি সম্প্রতি বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতালগুলির অমানবিক ও অর্থপৈশাচিক মানসিকতার বেশ কয়েকটি ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হয়েছে যা সত্যিই সভ্য সমাজে সম্পূর্ণতঃ অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়৷ হুগলীর ডানকুনির যুবক সঞ্জয় রায়ের দুর্ঘটনার চিকিৎসার বিষয়ে কলকাতাস্থিত অ্যাপোলো হাসপাতালের ভূমিকা, বর্ধমানের রত্না ঘোষের চিকিৎসা ও মৃত্যু, বর্ধমানে অবস্থিত পিজি নার্সিংহোমের ঘটনা হিমশৈলের চূড়ার নিদর্শন মাত্র৷ ইতিমধ্যে বাঙলাদেশের কূটনীতিক ও এই রাজ্যের উপ স্বাস্থ্য অধিকর্তারও এই ধরণের ব্যবহারের ভুক্তভোগী হওয়ার সংবাদ শিরোণামে উঠে এসেছে৷ সুতরাং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কতটা তা সহজেই অনুমেয়৷ গত ২২শে ফেব্রুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত বেসরকারী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলিত হয়ে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন ও সতর্ক করে দেন যাতে তারা যথাবিহিত নিয়মনীতি মেনে চলেন ও মানুষকে অযথা হয়রানির শিকার হতে না হয়৷ যদিও তার পরেও এই ধরনের ঘটনা খুব একটা কমেছে বলে তেমন কোনও তথ্য নেই৷
চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সেবার একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে৷ সেই কারণে চিকিৎসক ও নার্সদের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে সেবার পাঠ প্রদান করা হয় ও মূলতঃ তাদের কাজ যে জনকল্যাণে তথা আর্ত-পীড়িতের সেবায় নিয়োজিত তা তাঁরাও জানেন ও মানেন৷ তাই তারা রাত-দুপুর-সকাল-সন্ধ্যা কোন সময়ের বাছবিচার না করে রোগীর সেবায় এগিয়ে আসেন৷ এই সকল চিকিৎসক ও নার্সদের মানুষ দেবতার মত ভক্তি করেন আর যারা অর্থলোভী, অহংকারী, রূঢ়---মানুষ হয়তো বিপদগ্রস্ত হয়ে তাদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন কিন্তু পারতপক্ষে এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন৷ সরকারী বা বেসরকারী সবক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য মানুষের সার্বিক হয়রানি ও শোষণ বন্ধ করতে হলে সরকারকে সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই কঠোর অনুশাসন, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, চিকিৎসার সঠিক পদ্ধতি ও বিবরণ প্রকাশ, অন্তর্বিভাগের রোগীদের আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, উপদেশ-নির্দেশ দান বাধ্যতামূলক করতে হবে৷ এছাড়াও Reception Counter, Cash Counter, Doctor's advice room--এর সামনে ও ভেতরে C.C.TV ও Voice Recording- এর ব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন যাতে সেই সব স্থানে কে যাচ্ছে, কে আসছে, কী কথা হচ্ছে, কী পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদির নথি পাওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতের অনেক ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা কমে যাবে ও অনেকটাই স্কচ্ছতা আসবে৷ চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, কোন পরীক্ষার কত খরচ, কোন প্যাকেজের কত ব্যয়বরাদ্দ---এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য ও বিজ্ঞপ্তি সকলের নজরে আসে এমন প্রকাশ্য স্থানে লিখে রাখতে হবে যাতে মানুষের বুঝতে ও জানতে অসুবিধা না হয় রোগীর ব্যষ্টিগত বিষয়গুলি ছাড়া অন্যান্য খরচ বা রোগীর অবস্থা সম্পর্কে কোনরকম গোপনীয়তা রাখা চলবে না৷ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও হাসপাতাল-নার্সিং হোম সম্পর্কিত কঠোর আইন প্রণয়ন ও সেগুলির সঠিক প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে৷ নিদিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রশাসনিক নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে৷ সুনির্দিষ্ট গাফিলতির অভিযোগ যথাসত্ত্বর সমাধান করা বাঞ্ছনীয় ও এই সমস্ত বিষয়ে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে৷
সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও সেবার মনোভাব নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার, নার্স কর্মচারী সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে যাতে মানুষ কষ্ট নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করে ও রোগমুক্ত হয়ে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে আসে---আর তখনই এই পরিষেবার সার্থক রূপায়ন ও মূল্যায়ণ সম্ভব হবে৷