স্মরণিকা

লেখক
ব্যতিক্রমী চরিত্র -- অম্লান দত্ত

তিনি লিখেছিলেন, কলকাতার যে প্রান্তে আমার বাস সেখানে এখনো রাতে শিয়ালের ডাক শোনা যায়৷ শিয়াল-কুকুরে মাঝে মাঝে লড়াইও হয়৷ কখনো কখনো দুএকটা শিয়ালের মৃতদেহও দেখতে পাওয়া যায়৷ কিন্তু কোন কুকুর কুকুরকে খুন করেছে এমনটা দেখা যায় না৷ পারস্পরিক হিংসায় মানুষ যদি অন্তত কুকুরের স্তরেও উন্নীত হতে পারতো তাহলে সমাজে শান্তি বৃদ্ধি পেত৷

সত্তর দশকের উত্তাল কলকাতা৷ ট্রামে যাচ্ছেন তিনি৷ হঠাৎ রাস্তা আটকাল জ্বলন্ত মশাল হাতে একদল উগ্র যুবা৷ ট্রাম পোড়াবে তারা৷ ত্রস্ত যাত্রীরা সব প্রাণ বাঁচাতে হুড়োহুড়ি করে নেমে গেলো৷ তিনি নামছেন না দেখে তারা বলল শিগগির নামুন আমরা এখুনি  আগুন ধরিয়ে দেব৷ নির্বিকার মুখে তিনি বললেন, আমি তো টালিগঞ্জ যাব বলে টিকিট কেটেছি৷ তোমরা কী করবে আমি জানি না কিন্তু গন্তব্যে না পৌঁছে আমি নামব না৷ আর তোমরা এমন কিছু প্রশংসনীয় কাজ করছ না তার সঙ্গে আমাকে সহযোগিতা করতে হবে৷

ব্যক্তির অবিচল অহিংস প্রতিরোধে ক্ষিপ্ত জনতার হাত থেকে রক্ষা পেল জনগণের সম্পত্তিটি৷ তখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তিনি৷ দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে৷ দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে দেশের তাবৎ উপাচার্যদের ডাকা হয়েছে জরুরি অবস্থার পক্ষে তাঁদের সিলমোহর লাগানোর প্রত্যাশায়৷ সভায় পৌরহিত্য করছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি নামের  আদ্যক্ষর যেমন অনুযায়ী৷ আলিগড়, এলাহাবাদ... এইভাবে৷ কয়েকজনের পর হঠাৎ ইন্দিরা গান্ধী বললেন---প্রফেসর অম্লান দত্ত কী মনে করেন শোনা যাক৷ তিনি শান্তভাবে বলতে উঠলেন--- কিছুদিন আগে আমাদের দেশের সংবিধানে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এনে কিছু মৌলিক অধিকার সাময়িকভাবে রদ করা হয়েছে৷ এর আগেও সংবিধান সংশোধন হয়েছে এবং এবারের মতো প্রতিবারই বলা হয়েছে যে জনস্বার্থে তা করা হল৷ কিন্তু যতই জনস্বার্থের কথা বলা হোক না কেন, সব সময়ই তার পক্ষে ও বিপক্ষে না না মত শোনা গেছে৷ কিন্তু এই যে এবারের সংশোধন এর বিপক্ষে একটি মত ও শোনা গেল না৷  আমার আগে যে সাত আটজন গেছে৷ কিন্তু এই যে এবারের সংশোধন এর বিপক্ষে একটি মত ও শোনা গেল না৷ আমার আগে যে সাত আটজন উপাচার্য বক্তব্য রাখলেন প্রত্যেকেই এর অকুন্ঠ প্রশংসা করলেন৷ তার মানে কি এর বিরুদ্ধে কিছুই বলার নেই? আসলে এঁরা কিছু বলতে ভয় পাচ্ছেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় মুক্তচিন্তার দুর্গ৷ সেই দুর্গাধিপতিরাই যদি এত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তাতেই তো বোঝা যায় এ ব্যবস্থা কতটা ভয়ংকর!

এই কথার সাথে সাথে নেমে এল এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা৷ একটু পরেই সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন বিব্রত প্রধানমন্ত্রী৷ ওঁর জীবনের বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে দুটিকে বেছে নিলাম আজকের তমসাচ্ছন্ন আবহে তাঁর ব্যতিক্রমী চরিত্রের খানিক আভাস দিতে৷ নিজের জীবিকা এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় যেকোনো চাপ হুমকির সামনে ঊর্ধশির থাকতে পারেন এমন মানুষ যে বড় বিরল৷

আজ সামান্য পদ, পুরষ্কার বা পারিতোষিক এর জন্য  শাসকের পদলেহনকারীদের ভিড়ে এই ঋজু মানুষটির অভাব বড় বেশি করে অনুভব করি৷ সহনাগরিকদের মধ্যে তিনি খুঁজে বেড়াতেন, তাঁর নিজের ভাষায় তা হল---যে ব্যক্তি সমাজ রাজনীতি নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ভাববে কিন্তু দলদাস হয়ে যাবে না৷৷ রাজনৈতিক দলের  নিয়ন্ত্রণাধীন নয় এমন একটি সজীব সক্রিয় সিভিল সোসাইটি গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি মনে করতেন তিনি৷ এই অস্থির সময়ে আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে অম্লান দত্তের মতো ঋজু শিরদাঁড়ার মানুষের প্রয়োজন বড়ো বেশী৷