সংকীর্ণ দলতন্ত্র গণতন্ত্রের ভীত দুর্বল করছে

লেখক
প্রভাত খাঁ

ভারত নাকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র! জন সংখ্যায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ৷ কিন্তু সেখানকার দারিদ্রসীমার নীচে যে মানুষ ও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের যে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা তাতে ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির চেয়ে অনেকটাই পশ্চাতে অবস্থান করছে৷ কিন্তু এ দেশের প্রধানমন্ত্রী আহ্লাদে আটখানা হয়ে গর্ববোধ করছেন তিনি নাকি অন্য রাজনৈতিক দল যেমন কংগ্রেস (গান্ধীবাদী) অটল বিহারীর চেয়ে গরিবদের জন্য সবচেয়ে বেশী কাজ করেছেন৷ মানুষ তো চোখে দেখছে কারা কতটুকু শাসনে এসে জনগণের জন্য কাজ করেছেন৷ মাননীয় অটল বিহারী  প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যেভাবে রাজধর্ম পালন করতেন অন্য কোন প্রধানমন্ত্রীকে সেটা করতে দেখিনি৷ মোদীজী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী৷ দাঙ্গার সময় মোদিকেও রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন অটল বিহারী৷ রাজধর্ম পালন দূরে থাক, প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিরোধী দলের রাজ্যগুলিকে রাজ্যের প্রাপ্য টাকা দেন না৷ এই আর্থিক সংকটে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গই তার প্রকৃষ্ট প্রমান৷ কিন্তু দাঁতে দাঁত দিয়ে এই রাজ্যের শাসকগণ জনসেবা করে যাচ্ছেন যার প্রমান স্বয়ং কেন্দ্রসরকারেরই রিপোর্ট৷

অত্যন্ত লজ্জার কথা  পাঁচ  রাজ্যের বোটের পর প্রতিদিন নিয়ম করে পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ছে৷ এইভাবে পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়লে গরিবের কি হাল হয় দশলাখি পোষাকের প্রধানমন্ত্রীর সেই বোধ আছে কি? সে বোধ থাকলে গরিবের জন্যে কাজ করার বড়াই করতেন না? পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে যানবাহনের ভাড়াও সমহারে বাড়তে থাকবে৷ গরিব জনগণ বাসে যাতায়াত করবেন কি করে? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বহন করার ক্ষেত্রেও চরম সংকট দেখা দেবে৷ আর তার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এমন আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায় যা সাধারণের ক্রয় করা অসম্ভব হবে৷ কারণ কর্মহীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ লোক বেকারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, লক্ষ লক্ষ কলকারখানা প্রায় সব বন্ধ৷ চাকরী নেই, আয়ের পথ বন্ধ৷ তা হলে এই দাম বৃদ্ধিটা তো আরো অনর্থক সংকট বাড়াবে? এতে গরিবের সরকারের কোন হুঁস নেই৷ বিরোধীরা অভিযোগ তুলছেন এই  বলে যে সরকার যে রেশন বিনা পয়সার কিছু লোককে দিচ্ছেন তারই খরচ তুলতে এই তুঘলকী কাণ্ড করছেন মোদী সরকার৷ চরম আর্থিক সংকটে সরকারকে প্রশাসনিক কিছুটা ব্যয় সংকোচ করতে হয়৷ কেন্দ্র সরকার সরকারী কর্মচারীদের ৩ শতাংশ ডি.এ ঘোষনা করছেন কিন্তু, রাজ্যসরকারগুলি কিভাবে ডিএ দেবেন কর্মচারীদের,  তাঁদের তো নোট ছাপাবার কল নেই! বিরোধী রাজ্যগুলিতে কথায় কথায় সিবিআই তদন্ত, কিন্তু উত্তর ভারতে যোগী রাজ্যে যে, দীর্ঘ বছর ধরে ভয়ংকর নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল তার জন্য তো একটিও সিবিআই তদন্ত হয়নি কারণটা কী সেটা কেন্দ্র সরকারের দলীয় সরকার বলে? এই সব অসাংবিধানিক কর্মটা কী গণতন্ত্র বিরোধী নয়? পদে পদে সংবিধান লঙ্ঘন করার মহামান্য সুপ্রিমকোট তো কেন্দ্রকে সচেতন করেছেন কিন্তু যেহেতু কেন্দ্রের শাসনে আছেন তার জন্য কি কানে তুলো দিয়ে আর চোখে রঙ্গিন চশমা এঁটে আছেন? মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট  এক সময় বলেছিল সিবিআই কার্য্যত একটি খাঁচাবন্দি তোতা পাখি৷ নিজেদের স্বার্থে এই পাখিকে কেন্দ্রের দলীয় সরকারগণ কাজে লাগান৷ যে কাজ করে গেছেন খোদ ইন্দিরা গান্ধী তাঁর রাজত্বকালে৷

আজ মোদিজীর কেন্দ্র সরকারও তাই করছেন ---রাজনৈতিক স্বার্থে বিশেষ করে  বিরোধী দলের রাজ্যগুলিকে হেনস্থা করতে৷ প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাননীয় এন.ভি.রামনা একটি মন্তব্য করেছিলেন সিবিআই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে৷ তাঁর কথায় ‘কখনও সক্রিয় আবার কখনও নিষ্ক্রিয় থাকাটা সিবিআই-এর গ্রহণ যোগ্যতার উপর প্রশ্ণ তুলে দিচ্ছে৷ তিনি আরো বলেছিলেন মানুষ তাদের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছে৷ সেই বিশ্বাস ও সামাজিক স্বীকৃতি ফিরে পেতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে অবিলম্বে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ তাঁর বক্তব্য একের পর এক ঘটনায়  সিবি আই তদন্তে  অনাস্থা করছে বিরোধীরা৷ বার বার  অভিযোগ উঠছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে প্রতিবাদী কন্ঠগুলিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে শাসক দল৷

তিনি দেশের পুলিশ ব্যবস্থা এবং সিবি আই-এর কাজকর্মকে বাক্যবানে বিদ্ধ করে বলেছিলেন---রাজনৈতিক নেতারা অস্থায়ী,  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে যান৷ কিন্তু আপনারা থেকে যান৷ পুলিশ ব্যবস্থার একটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে৷কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এমন কোনও আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ পায় না৷ এরজন্য অনেক সময় নিরপরাধ শাস্তি পায় এবং প্রকৃতদোষী মুক্তি পেয়ে যায়৷

তাই অতীতেও দেখা গেছে শাসক দলের চাপে সিবি আই তদন্তকারীরা অনেক অমানবিক ব্যবহার করত আটক ব্যষ্টিদের উপর৷ তার প্রধান দৃষ্টান্ত আনন্দমার্গের শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ মিথ্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল সিবিআই তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে৷ প্রতিবাদে পাঁচবছর চার মাস অনশন করার কারণ তিনি দিনে মাত্র এক কাপ ঘোল খেয়ে৷ সেদিন কেন্দ্রীয় সরকার আনন্দমার্গীদের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী না মানায় একটি বেসরকারী তদন্ত কমিশন তদন্ত করে বিষ প্রয়োগের  সত্যতা প্রমাণ করে৷ পরে আদালতের  রায়ে নির্র্দেষ প্রমাণিত হয়ে সসম্মানে মুক্তিলাভ করেন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ও তাঁর সহকর্মীরাও৷

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির সিবিআই সম্পর্কে করা মন্তব্য শুধু সিবিআই নয়, আজ গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তম্ভের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ যে যখন শাসন ক্ষমতায় আসে তখনই সে নিজের ও দলীয় স্বার্থে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে ব্যবহার করতে শুরু করে৷ 

মোদিজীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ই বিচার বিভাগেও একধরণের অভিযোগ শোণা গেছে বিচারপতিদের কাছ থেকে৷ সুপ্রিমকোর্টে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়ে গেছে৷ তাই বিশ্বের বৃহত্তম দেশে আমলা প্রশাসন গণমাধ্যম ও বিচারবিভাগ প্রতিটি স্তরেই জনগণের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ যা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে অশনি সংকেত৷ রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্রের মূল চারটি স্তম্ভের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না করলে  বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সফল হবে না৷