বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সঙ্গীত গাইতে শিখেছে, আর এই সঙ্গীত গেয়ে মানুষ নিজে আনন্দ পেয়েছে ও অন্যকেও সঙ্গীত শুণিয়ে আনন্দ দিতে শিখেছে৷ এরপর যখন মানুষ বাদ্যযন্ত্র তৈরী করতে শিখল তখন থেকে ওই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ পেয়েছে ও মানুষকে আনন্দ দিয়েছে৷
শুধু যে মানুষই কণ্ঠ সঙ্গীত ও যন্ত্র সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত তা নয়৷ আমরা প্রাণীজগতেও সঙ্গীতপ্রিয় প্রাণী ও বাজনদার কিট–পত ঙ্গদের সন্ধান পাই৷ প্রাণীজগতের মধ্যে সুগায়ক হিসাবে পক্ষীকুলই সব চাইতে বেশী পরিচিত৷ কোয়েল, দোয়েল প্রভৃতি পাখীরা বেশ মিষ্টি সুরে গান গাইতে পারে৷ এরা কণ্ঠ সঙ্গীতে ভালই কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম৷ মানুষ ও পক্ষীকূলই যে কণ্ঠ সঙ্গীতে দক্ষতা বা কৃতিত্বের অধিকারী তাও নয়৷ সঙ্গীত বা বিশেষ ধরণের শব্দ উৎপাদনে ব্যাঙ্ কি কারও অপেক্ষা পিছিয়ে আছে? বর্ষার প্রাক্কালে আকাশে যখন মেঘরাশির সমারোহ চলে তখন শুরু হয় এদের সঙ্গীতের আসর৷ ব্যাঙের দল মেঘ রাশিকে মেঘ হতে বর্ষাধারার আগমনকে স্বাগত জানায় তাদের স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠ সঙ্গীতের মাধ্যমে৷ গ্যাঙ্র গ্যাঙ্, গ্যাঙ্র–গ্যাঙ্ সুরধ্বনির ঐক্যতান শুরু হয়ে যায়৷ মনে হয় যেন অব্যক্ত ভাষাহীন এই ব্যাঙের দল তাদের এই ঐক্যতানের মাধ্যমে প্রার্থনা জানাতে থাকে– ‘‘মেঘ, তুমি কাছে এস, জল চাই, আরো জল চাই৷ ....৷’’ এ ধরণের ধ্বনিকে ঠিক মত সঙ্গীত হিসাবে বিবেচনা করাযায় না৷ মানুষের কাছে হয়ত এদের গানের কোন্ কদর নেই কিন্তু ওদের স্বজাতীয়দের মধ্যে এই কণ্ঠ সঙ্গীতের কদর আছে ও অর্থ আছে৷ বর্ষার আগমনে এদের মধ্যে চলে কণ্ঠ সঙ্গীতের প্রতিযোগিতা৷ এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই প্রণয়িণীরা এদের নিজ নিজ সঙ্গী নির্বাচন করে নেয়৷ জানা যায়–শীল জাতীয় মাছেরা নাকি মাঝে মাঝে করুণ সুরে ঐক্যতানে গান গেয়ে থাকে৷
পাখি, ব্যাঙ্, শীলজাতীয় প্রানীরা যেমন সঙ্গীতে পারদর্শিতা দেখাতে পারে, তেমনি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পারি বেশ কিছু কীট–পতঙ্গ আমাদের আশেপাশে ঝোপে–ঝাড়ে, মাঠে–ঘাটে, পথে–প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা গান গাইতে অক্ষম বটেকিন্তু তাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সঞ্চালিত ক’রে অনেক বিচিত্র ছন্দ ও সুরের লহরী তুলতে পারে৷ এটাই হ’ল এদের সঙ্গীতের বাজনা৷ সন্ধ্যার পর আমাদের আশেপাশে মাঠে–ঘাটে, পথে প্রান্তরে কত না বিচিত্র ধরণের কীট পতঙ্গকে দেখি যারা প্রায়শই এরূপ বাজনা বিরামবিহীন ভাবে বাজিয়ে থাকে৷ এই সমস্ত পতঙ্গদের মধ্যে যন্ত্রসঙ্গীতে সুদক্ষ হ’ল ঝিঁ–ঝিঁ পোকা ও পঙ্গপাল জাতীয় ফড়িং৷ এদের বাজনার সুরগ্রাম এতটাই তীক্ষ্ণ যে সহজেই এই সুরগ্রাম মানুষের কর্ণগোচরে এসে পড়ে ও মানুষের মনে জাগায় এক ঐক্যতানের বিশেষ অনুভূতি৷
এমন কিছু প্রাণী আছে যারা তাদের বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গগুলিকে এধার–ওধার সঞ্চালিত ক’রে অথবা কাঁপিয়ে এক বিশেষ আওয়াজ করতে পারে৷ মশারা ওদের ডানাগুলিকে কাঁপিয়ে যে একপ্রকার গুণ–গুণ আওয়াজ তোলে তাও এক প্রকার বাজনার ঐক্যতান৷
বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে কোন কোন কীটপতঙ্গ যেমন বাজনা বাজাতে সক্ষম, আবার এমন সব কীটপতঙ্গদের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা যন্ত্রসঙ্গীতে বা বাজনা শোনার শ্রোতা৷ কীট পতঙ্গ গবেষকদের কাছে জানা যায় যে, মাকড়সা খুবই সঙ্গীতপ্রিয় পতঙ্গ৷ এদের সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ খুবই প্রগাঢ়৷ বলা যেতে পারে, এরাই প্রথম শ্রেণীর শ্রোতা৷
এ সম্পর্কে কীটপতঙ্গ গবেষকরা বিশেষভাবে প্রমাণ করেছেন–যে মাকড়সার গানের প্রতি গভীর আসক্তি আছে৷ জানা গেছে, একজন বেহালা বাদক একটা পাকা হল ঘরে বসে প্রতিদিন বেহালা বাজাতেন৷ বেহালা বাজাবার সময় প্রতিদিনই লক্ষ্য করতেন যে–বেহালা বাজানো শুরু করলেই একটি মাকড়সা মুখনিসৃত লালার তৈরী সুতো বেয়ে ছাদ হতে নীচের দিকে নেমে আসত, আর বেহালা বাজানো শেষ হলেই আবার উপরে উঠে যেত৷
সন্ধ্যার সময় যখন পল্লী গ্রামে অন্ধকার নেবে আসে তখন পথে, প্রান্তরে, মাঠে, ঘাটে থেকে এক বৈচিত্র্যময় সুরের ঐক্যতান অবিরাম ভাবে আমাদের কানে আসতে থাকে৷ এই ঝঙ্কারকে আমরা সাধারণতঃ ঝিঁ–ঝিঁর ডাক বলে থাকি৷ সঙ্গীতবিদগণ এই ঝিঁ–ঝিঁর ডাক বিশ্লেষণ করে বলেছেন–ঝিঁ–ঝি– পতঙ্গদের সুরঝঙ্কারের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করেই বোধ হয় এদের সঙ্গীতশিল্পী বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে৷
এই পতঙ্গশিল্পীদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে৷ এরা হ’ল ক্রিকেট, গ্রাস্–হপার ও সিকেদ্যা৷ সুর–শিল্পী পতঙ্গদের মধ্যে ক্রিকেট শ্রেণীর পতঙ্গরাই উল্লেখযোগ্য প্রথম শ্রেণীর যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী৷ সন্ধ্যার সময় হতে শুরু হয় এদের সুরের ঐক্যতান, সুরের লহরী৷ ক্রিকেট শ্রেণীর পতঙ্গদের দুটি ডানা আছে৷ এই দুটি ডানার পাখার সাহায্যেই উচ্চসুর সৃষ্টি করে থাকে৷ ডানপাখাটি বামপাখার উপর রেখে বেহালার ছড়ের মত ঘষতে থাকে৷ আর এই ঘর্ষণের জন্যই সুরঝঙ্কারের সৃষ্টি হয়৷
গ্রাস্হপার পতঙ্গরা সবুজ রঙের হয় ও এরা সবুজ ঘাসের উপর বসেই এদের সুর সাধনা করে৷ গ্রাসহপার যাকে আমরা গঙ্গা ফড়িং বলি, এরা দুই রকমের হয়–এক শ্রেণীর গঙ্গা ফড়িংয়ের লম্বা শৃঙ্গ আছে আর একশ্রেণীর শৃঙ্গটি হয় খর্বাকৃতির৷
এ পর্যন্ত, কীট পতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের কাছে সিকেদ্যা জাতীয় পতঙ্গ বা ঝিল্লিদের সম্পর্কে এখনও বিশেষ কিছু পরিচিতি স্বচ্ছভাবে জ্ঞাত হয়নি৷ তবে জানা গেছে স্ত্রী সিকেদ্যারা কোন শব্দই উৎপন্ন করতে পারে না৷ পুরুষ সিকোদ্যারা দেহের ভিতরে নীচের দিকে অবস্থিত পেশীর স্পন্দনের সাহায্যে সুর নির্গত করে থাকে৷ পরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, এরূপ সুর নির্গত করার প্রধান উদ্যেশ্য হ’ল স্ত্রী পতঙ্গদের আকৃষ্ট করা৷
পঙ্গপাল জাতীয় ফড়িংরা সাধারণত যাযাবর৷ এদের আওয়াজের সুরগ্রাম বেশ উগ্র হয়৷ এর ফলে মানুষ এদের সুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়৷ এদের সৃষ্ট সুরগ্রাম অনেকটা সারঙ্গীর সুর যেমন, ঠিক তেমন হয়৷ এদের সামনের পাগুলি বেহালার ছড়ের মত কাজ করে৷
এই পৃথিবীতে রয়েছে অজস্র সংখ্যক কীট–পতঙ্গ, আর রয়েছে এদের বহু অজানা রহস্য৷ এই অজানা রহস্য নির্ণয় নিয়ে কীটপতঙ্গ গবেষণাবিদ্রা অতীতে গবেষণা করেছেন, বর্তমানেও ক’রে চলেছেন৷ পরমপুরুষের অন্যতম সৃষ্টি এই কীটপতঙ্গদের মধ্যে আরো যে কত অজানা বিচিত্র রহস্য থেকে গেছে তা আমরাভবিভষ্যৎ পতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের কাছে জেনে যাবো৷
- Log in to post comments