শ্রাবণী পূর্ণিমার কথা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভূত হলেন এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় আর এক বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে৷ পৃথিবীতে সর্বপ্রকারের মূল্যবোধ হয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত৷ সত্য, শিব, সুন্দর হয়েছে অস্বীকৃত৷ নানা ধর্মমত ও রাজনৈতিক মতবাদ–প্রচারিত ভাব–জড়তা (ডগ্মা) মানব–সমাজকে করেছে খণ্ডবিখণ্ড, রক্তাক্ত, কলুষিত, কলহপ্রবণ ও পরমত–সহিষ্ণু৷ শিক্ষা হারিয়ে বসেছে তার মূল উদ্দেশ্য৷ আর যার জন্যে এত সব সমারোহ, এত সব আয়োজন, এত সব ঢ়ক্কানিনাদ–সমাজের সেই কেন্দ্রবিন্দু, সেই মধ্যমণি মানুষ হয়েছে চরমভাবে উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত৷ মানব ধর্মের সাধনা ছেড়ে মানুষ ছুটে চলেছে সহজ ধর্মের পথে, ভোগের পথে, পর ধর্মের পথে৷

তিনি এলেন আশার প্রদীপ জ্বেলে ৷ পরম স্নেহে বুকে তুলে নিলেন ধূল্যবলুণ্ঠিত, পীড়িত মানবতাকে৷ মানুষের সার্বিক মঙ্গলসাধনের জন্যে দিলেন এক সর্বানুসূ্যত–জীবনা–সর্বজনহিতায় সর্বজনসুখায় চ৷ শেখালেন দিব্যজীবন লাভের সাধন–প্রক্রিয়া৷ জ্ঞান–বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাও তাঁর দিব্যপ্রজ্ঞার কল্যাণস্পর্শ পেয়ে ধন্য হ’ল৷ ––এ–সবের শুরু কিন্তু সেই ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমায়–যখন তিনি এক দুষৃকতীর আঁধার হূদয়ে আলো জ্বেলে দিলেন৷ সেই শুরু–যার শেষ নেই৷

১৯৩৯ সাল, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের রনদামামা বেজে গেছে ইউরোপে৷ দিনটা ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা৷ প্রাত্যহিক অভ্যাসমত কলিকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের এক ছাত্র তরুণ প্রভাতরঞ্জন সরকার গঙ্গার পাড়ে কাশীমিত্র ঘাটে একটি গাছের তলায় বসে ছিলেন৷ বয়স মাত্র ১৮ বছর৷ তখন সন্ধ্যাবেলা৷ দেখা হ’ল ডাকাত কালীচরণের সঙ্গে–কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ‘কালীচরণ’–ৰাৰার স্নেহভরা আহ্বান শুনে কী জানি কি ঘটে গেল তার অন্তরে৷ কাঁদতে কাঁদতে সে লুটিয়ে পড়ল ৰাৰার শ্রীচরণে৷ ৰাৰা সস্নেহে তাকে কাছে টেনে নিলেন৷ শেখালেন আধ্যাত্মিক সাধনা–পদ্ধতি৷ শেখালেন সাধনার গূঢ় তত্ত্ব৷ করলেন মন্ত্রশক্তি–সম্পাত৷ দীপনীশক্তি, মন্ত্রাঘাত, মন্ত্রচৈতন্য ও পুরশ্চরণের মাধ্যমে জেগে উঠল তাঁর প্রসুপ্ত দৈবশক্তি৷ পরমারাধ্য ৰাৰা তাঁর ভেতরে জ্বালিয়ে দিলেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মঙ্গলদীপ৷ যে পরস্বাপহারী ছুটে চলেছিল অন্ধ–তমিস্রার দিকে–ৰাৰা তাঁকে দিলেন আলোকতীর্থের ঠিকানা৷ উত্তরণ ঘটল তাঁর–জীবন থেকে মহাজীবনে–চেতনা থেকে দিব্যচেতনায়৷ আর এক দিব্যজীবন উদ্ভাসিত হ’ল শাশ্বত জ্যোতির মহিমায়৷

ডাকাত কালিচরণ এক প্রতীক মাত্র৷ মানুষ মনপ্রধান জীব৷ প্রতিটি মানুষের জীবনেই রয়েছে কতকগুলি সহজাত বৃত্তি৷ কিছু বৃত্তি যেমন মানুষকে অধঃপথের দিকে ঠেলে দেয় আবার কিছু বৃত্তি মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়৷ তাই প্রত্যেক মানুষের মনে লুকিয়ে আছে একটি কালিচরণ, মনের এই কালিচরণই সমাজকে নানা ব্যধিতে পুঁতিগন্ধময় করে তোলে৷

সমাজের এমনি এক বিপর্যস্ত অবস্থায় আনন্দমূর্ত্তিজীর আবির্ভাব৷ তিনি সমস্ত সমস্যা সমাধানের পথ দেখালেন সর্বাত্মক ও সর্বানুসূ্যত জীবন দর্শন আনন্দমার্গে৷ সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব–‘প্রাউট’, নব্যমানবতাবাদ, মাইক্রোবাইটাম, শিল্পকলা, সাহিত্য, সঙ্গীতবাদ্য ও আধ্যাত্মিক সাধনা৷ এই দর্শনকে বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত আদর্শ মানুষ৷

সেই আদর্শ মানুষ গড়ার কাজ তিনি শুরু করলেন কালিচরণকে আধ্যাত্মিক সাধনা শিখিয়ে৷ এই সাধনাই মনের কালিচরণের বিনাশ ঘটিয়ে তাকে উন্নত আদর্শ মানুষে পরিণত করে বিকাশের পথে আলোর পথে নিয়ে যাবে৷ তাই ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমা ভূ–লুন্ঠিত মানবতার কুহেলিকা চিরে আলোর পথে উত্তরণের শুরু৷

কালিচরণদের তামসী বিভাবরী পার হয়ে, আপাত মধুর তমোগুণী মরিচিকার পথ ত্যাগ করে যাত্রা শুরু বৈরাগ্যের পথে৷ তাই শ্রাবণী পূর্ণিমা শুধু এক কালীচরণ নয়, সমগ্র মানব সমাজেরই অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু৷