শরণাগতিই বড় কথা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ বর্তমান বা ভবিষ্যতের চেয়ে অতীত নিয়েই বেশী মাথা ঘামায়৷ অনেককেই অনেক সময় বলতে শোণা যায়, ‘হে ঈশ্বর, আমি পাপী, তুমি আমাকে ত্রাণ করো’ এই ধরনের চিন্তা তন্ত্রসম্মত নয় কারণ ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্বির্ভবতি তাদৃশী’৷ যে নিজেকে সর্বদা পাপী ভাবে, সে যদি পাপী নাও হয়, তবু যদি সে ভাবে, ‘আমি পাপী, আমি পাপী’---এই রকম ভাবতে ভাবতে সে পাপী হয়ে যাবে৷ সুতরাং এ ধরনের চিন্তা খুবই খারাপ৷ বরং এটাই ভাবা উচিত, আমি পাপী ছিলুম, আজ আর পাপী নই, কারণ আমি ঈশ্বরের শরণে এসেছি, আমার পাপ কোথায় থাকবে?

মহাপ্রভু বলেছেন, যে মুহূর্তে মানুষ ঈশ্বরের শরণে এল, সেই মুহূর্তে তার পাপ শেষ হয়ে গেল৷ তারপর যেই কীর্ত্তনের প্রথম পঙ্‌ক্তি গাইবে সঙ্গে সঙ্গে সে ঈশ্বরের দিকে এগোতে থাকবে৷ সুতরাং পাপ নিয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে কেন? পাপ হচ্ছে কী?---না, চলার পথের ধুলো৷ পথে চলতে গেলে ধুলো লেগেই থাকে৷ ধুলো ঝেড়ে ফেলে দিলেই হ’ল৷ তা না করে কবে কাপড়ে ধুলো লেগেছিল সেই চিন্তা করে মূল্যবান সময় নষ্ট করে কী লাভ? ‘O God, I am a sinner---এ ধরনের কথা ভাবাও উচিত নয়৷ বরং ভাবা উচিত, ‘‘আমি পরমপুরুষের সন্তান, আমার গায়ে যদি ধুলো লেগেও থাকে তবে পরমপুরুষ যিনি আমার পিতা তিনি ধুলো ঝেড়ে আমায় কোলে তুলে নেবেন’’৷ বাস্তবিক জিনিসটা তাই---পিতা-পুত্রের সম্পর্ক৷ পুত্র নর্দমায় পড়ে গেলে রাস্তার অন্যান্য লোক হাসতে পারে, ঠাট্টা-ঘৃণা বা অপমানও করতে পারে, কিন্তু তার পিতা যদি সে দৃশ্য দেখেন তবে তা’’ করবেন না৷ বরং তিনি ছুটে এসে নর্দমা থেকে তার ছেলেকে তুলে নেবেন৷ কারণ, এইটাই পিতার ধর্ম৷ তারপর পুত্রকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করবেন---এইটাই তার কাজ৷ সুতরাং মানুষকে শুধু তার শরণে আসতে হবে৷ বলা হয়েছে---

‘‘অপিচেৎ সুদূরাচারো ভজতে মামমন্যভাক্‌৷

সোহপি পাপবিনির্মুক্তঃ মুচ্যতে ভবৰন্ধনাৎ৷’’

অর্থাৎ যদি কোন লোক পাপীর চেয়েও পাপী হয়, দুরাচারীর চেয়েও বেশী দূরাচারী হয়, যাকে অন্যান্য পাপী ও দুরাচারী তাদের চেয়েও বেশী পাপী ও দুরাচারী বলে ঘৃণা করে, সেই ঘৃণ্য সুদূরাচারী পাপীও যদি একমন হয়ে অন্য ভাবনা ত্যাগ করে আমার শরণাপন্ন হয় ও সে যদি বলে, ‘আমি আমাকে তোমার হাতে সমর্পণ করলুম, তুমিই আমার পরাগতি’, তাহলে তিনি তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারেন না, পাপী বলে অবজ্ঞা-অবহেলা করতে পারেন না, তিনি তাকে কোলে তুলে নিতে বাধ্য, আর এইটাই হ’ল পিতা-পুত্রের যথার্থ সম্পর্ক৷ ঈশ্বর কোন Impersonal Entity বা আকাশচারী বস্তু নন৷ এক্ষেত্রে তিনি Personal Entity৷ সেই মানুষটি যদি অতীতের কথা, বর্তমানের কথা, ভবিষ্যতের কথা, কোন কথাই না ভেবে শুধু বলে, ‘আমি তোমার শরণে এসেছি,’ তা হলে সে ঈশ্বরের আশ্রয় পাবেই৷ ঈশ্বর তাকে কোলে তুলে নেবেনই৷ পাপের বন্ধনে যে মানুষ আৰদ্ধ হয়ে আছে, কৃপা করে তিনি স্বহস্তে তার সেই পাপের বন্ধন ছিন্ন করে দিতে পারেন৷

মানুষের অজস্র ৰন্ধন---সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক৷ অজস্র জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে জীব৷ বন্ধনযুক্ত সত্তাই হ’ল জীব, আর বন্ধনমুক্ত সত্তা হলেন শিব৷ জীব আর শিবের এই হ’ল পার্থক্য৷ পরমপুরুষ যার বন্ধন খুলে দিচ্ছেন, সব রকম বন্ধন থেকেই তিনি তাকে মুক্তি দিতে পারেন, তিনি তা করেনও৷ তিনি যখন ব্যষ্টিগতভাবে বন্ধনমুক্তির জন্যে পৃথিবীতে নেমে আসেন---যেমন এসেছিলেন শিব, যেমন এসেছিলেন কৃষ্ণ---তখন তিনি সর্বাত্মক বন্ধনমুক্তির জন্যেই নেমে আসেন৷ তখন কোন্‌ মানুষ কীভাবে কষ্ট পাচ্ছে, কোন্‌ মানুষ কোন্‌ পাপে অতিষ্ঠ হয়ে রয়েছে, সে কথা ভাববার তাঁর দরকার নেই--- শরণাগতিই এখানে বড় কথা অর্থাৎ ‘‘আমি তোমার আশ্রয়ে এসেছি, আমার জন্যে যা দরকার তা আমার চেয়ে তুমিই বেশী ৰোঝ আর আশা রাখি, তুমি তাই করবে৷ তুমি কখন করবে, কেমন ভাবে করবে, সেটা তুমিই ৰোঝ৷ আমি কেবল তোমার হাতের যন্ত্র মাত্র---যেমন বলবে আমি তেমনটি করব৷’’ এইটাই হ’ল আসল কথা৷ ১৩ নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সন্ধ্যাবেলা (ইংরেজী থেকে অনুদিত)