তিলজলা আশ্রমে পরমারাধ্য মার্গগুরুর মহাপ্রয়াণ উদ্‌যাপন দিবস উপলক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা

লেখক
প্রভাত খাঁ

এই জগৎ সংসার এর সৃষ্টিকর্তা হলেন পরপুরুষ৷ যিনি সৃষ্ট জগতের সকলেরই স্রষ্টা৷ এই কথাটি এই জগতের সকল মননশীল মানুষের সর্বদা স্মরণে রাখা ও তার সৃষ্টিকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করাটাই হ’ল পবিত্র কর্তব্য কর্ম৷ এই প্রপঞ্চময় জগতে অতি সোজা কথাটি অধিকাংশ মানুষ ভুলে গিয়ে আত্ম-অহঙ্কারে এমন সব কাজ করে, যা মারাত্মক ধবংসাত্মক হয়ে ওঠে ও তাতে মহান সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যটাই অস্বীকৃত হয়৷ তাতে চরম ধংস নেমে আসে এই ধরার বুকে৷ তখনই সেই মহান শক্তির স্রষ্টা মানুষের রূপে নেমে আসেন সৃষ্টিকে রক্ষা করতে মহাসম্ভূতি রূপে এই ধরার বুকে৷

তিনি বার বার এসেছেন যেমন অতি প্রাচীনকালে সদাশিব, শ্রীকৃষ্ণও এসেছিলেন, ঠিক তেমনই এসেছিলেন আধুনিক যুগে বিংশ শতাব্দীতে যখন পরপর দুটি মহাযুদ্ধে পৃথিবী ক্ষতবিক্ষত হয়৷ তিনিই হলেন আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ লৌকিক জগতে যিনি পরমশ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নামে পরিচিত৷ তিনি প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব প্রাউট দর্শনের স্রষ্টা৷ এই প্রাউট দর্শন আর্থিক তথা সামাজিক দর্শন যা পৃথিবীর মানুষ জীবজন্তু, গাছপালা সকলের বেঁচে থাকার ও বিকাশের গ্যারাণ্টি দিতে পারেন এই অত্যাধুনিক যুগে৷

তাঁর আবির্ভাব ঘটে ১৯২১ সালের ২১শে মে পূর্ণিমার শুভদিনে জামালপুরে সরকার পরিবারের রেলওয়ে কোয়াটার্সে৷ ওনার তিরোধান ঘটে তিলজলার আনন্দমার্গ আশ্রমে তাঁর বাসভবন ‘মধুকোরকে’ ১৯৯০ সালের ২১শে অক্টোবর৷ এই ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি সমগ্র বিশ্ব কল্যাণে প্রাণপাত করে গেছেন৷ দিনে প্রায় ১৮ ঘণ্টার কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন৷ তিনি অধ্যাত্ম বিজ্ঞান, আর্থিক তথা সমাজ বিজ্ঞান, সঙ্গীত বিজ্ঞান, নানা বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, গাছপালা সম্বন্ধে ও এমন কিছু নেই যার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেননি৷ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে৷ সবচেয়ে উল্লেখ্য যে, তিনি ৫,০১৮টি গান দিয়েছেন ও তাতে সুর সংযোজন করে গেছেন৷ তাঁর অনেক লেখা আজও অপ্রকাশিত আছে৷ তিনি নৃত্যশিল্পেও পারদর্শী ছিলেন৷ এমনকি ভেষজ বিজ্ঞানের মহামূল্যবান পুস্তক দিয়ে গেছেন৷ তিনি নিজে ছিলেন এক বিস্ময়৷

১৯৫৫ সালে আনন্দমার্গ দর্শনের বাস্তবায়নে অনুগত ভক্তবৃন্দের অনুরোধে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন৷ তাঁর এই সংঘটনকে সারা বিশ্বব্যাপী করে তোলেন তাঁর অদম্য কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা৷ তিনি তাঁর গৃহী ভক্ত ও সর্বত্যাগী সর্বক্ষণের কর্মী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের দিয়ে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে সারা পৃথিবীতে তাঁর আধ্যাত্মিক ও জনসেবামূলক সংঘটনকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন৷ আজ এই ধরার বুকে ১৮২টি দেশে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে৷ অত্যন্ত আনন্দের ও বিস্ময়েরর কথা তাঁর প্রদত্ত ও সুরোপিত ‘প্রভাতসঙ্গীত’ বিশ্বের মধুরতম ভাষা বাংলা ভাষায় গীত হয়ে চলেছে সারা পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে৷ এটার মধ্যে দিয়ে তিনি পৃথিবীতে রেণেশাঁ ইয়ূনিবার্সালকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন৷ এটি তাঁর এক সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান যা পৃথিবীতে অন্য কোন ভাষা স্বীকৃতি পায়নি৷ আগামী ভবিষ্যৎ বুঝবে ও জানবে যে তিনি পৃথিবীর বুকে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ৷

ক্ষুদ্র লেখনীর মাধ্যমে তাঁর সম্বন্ধে কতটুকু বলা যায়৷ তিনি অনন্ত ও অব্যক্ত৷ তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর প্রদত্ত আধ্যাত্মিক সাধনা করতে হবে ও তাঁর নির্দেশিত পথে চলতে হবে৷ তিনি আনন্দময় আর তাঁর প্রদত্ত আধ্যাত্মিক দর্শন হ’ল ব্যষ্টিজীবনের মহামোক্ষের পথ৷ সত্যই আজ মনে হচ্ছে তিনি অবাঙমানসগোচর৷ তিনি ছিলেন আনন্দমার্গীদের কাছে অতিপ্রিয় আদরের ‘ৰাৰা’৷ ২১শে অক্টোবর থেকে ২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত যে তিলজলায় ১২০ ঘণ্টার ‘বাবানাম কেবলম্‌’ মহামন্ত্রের অখণ্ড কীর্ত্তন হয়ে চলেছে সেটা এই ধরণীর বুকে ত্রিতাপ জ্বালা জুড়াবার এক মহামন্ত্র৷ আজকের সমস্যাসংকূল পৃথিবী নানা সমস্যার জর্জরিত ও খণ্ড-বিখণ্ড৷ মানুষ ভুলেই গেছে তাঁদের জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য কি? আমাদের লক্ষ্য হ’ল আমরা সবাই অমৃতের সন্তান৷ আমাদের মিলতে হবে সেই অমৃতের সঙ্গে৷ সেই সৎ চিত্ত আনন্দমের সঙ্গে৷ তাই মানুষ জড়সর্বস্ব জীব বিশেষ নয়, মানুষ আধ্যাত্মিক জীব৷ তাকে সেই আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে তাঁরই সঙ্গে মিলতে হবে৷ ভূমাকে লাভ করাই আনন্দ৷ এছাড়া পথ নেই৷ তাই মহান ঋষি মানুষকে অমৃতের সন্তান হিসাবে চিহ্ণিত করে গেছেন৷ সেখানে কোনও জাতপাত নেই৷ তাই মানব সমাজ এক অবিভাজ্য---‘‘শুনরে মানুষ ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই৷’’

আজ আনন্দমার্গের অনুরাগীরা সেই পরমারাধ্য ৰাৰাকে স্মরণ করছেন দেশদেশান্তর থেকে এসে তাঁরই মহাপ্রয়াণের দিনে৷ তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিচ্ছেন আর মনে প্রাণে প্রতিজ্ঞা করছেন তাঁর দেওয়া কর্মযজ্ঞকে বাস্তবায়িত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে৷

আজ পৃথিবীকে ধবংসস্তুপে পরিণত করছে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল তাদের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে৷ পৃথিবী ও মানব সমাজকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করার মহান ব্রত নিয়েছেন আনন্দমার্গের অনুগামীরা৷ জগতের জীবজন্তু গাছপালাকে রক্ষার দায়ও তাদের নব্যমানবতারস্পর্শ্ ও প্রাউটের আদর্শে৷ পৃথিবীর বুকে এক নতুন মানব সমাজ গড়ে তুলে ও তাদের বিশ্বৈকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তোলার মহান লক্ষ্যেই আনন্দমার্গীদের পবিত্র কর্ম৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মহাপ্রয়াণের এই স্মরণ দিবসগুলি যাতে তারা ভুলে না যায়, তারই জন্যে ছয় দিন ব্যাপী এই অখণ্ড কীর্ত্তনের অনুষ্ঠান৷ অত্যন্ত আশার কথা আনন্দমার্গীরা পরমারাধ্য ৰাৰার নির্দেশ বাস্তবায়িত করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছেন এই নশ্বর পৃথিবীতে৷ আদর্শই বেঁচে থাকবে আর পরিবর্তনশীল জগৎ এগিয়ে যাবে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে৷

জয় ৰাৰার আদর্শ৷ আর এগিয়ে চলুক আমার ও আমাদের অতি প্রিয় সংঘটন৷ এই সমাবেশের গুরুত্বটা যে কতখানি অনেকে হয়তো বোঝেন না৷ বুঝতে চায় না ইচ্ছাকৃতভাবে৷

মনে রাখা জরুরী গুরুত্বপূর্ণ কথাটি---মহান কর্মজীবন সমাপ্ত করে ৰাৰা দেহ রেখেছেন এই তিলজলা আশ্রমে যে আশ্রম তাঁরই মহান কীর্তি৷ সারা পৃথিবীর এক মহান তীর্থক্ষেত্র ৰাৰার এই স্মৃতিসৌধ৷ এখানে একদিন সারা পৃথিবীর নব্যমানবতাবাদী সাধকগণ আসবেন আর তারই শ্রীচরণকমলে শ্রদ্ধার্ঘ্য দান করবেন৷ আজকের আনন্দমার্গী ভাইবোন তারই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছেন পাপশক্তির সকল বাধা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে৷ জয় হোক তোমাদের সকলের৷