যে অনির্বাণ দীপশিখা আজও প্রোজ্জ্বল

দীপশিখা জ্বলে কীভাবে দীপশিখার শীর্ষবিন্দু সবসময় ওপরের দিকে থাকে৷ হাওয়ায় সেই দীপশিখা হয়তো কিছুটা নড়ে–চড়ে, হেলে–দুলে যায়৷ কিন্তু তার শীর্ষভাগের অবস্থান কখনও বদলায় না৷ এইভাবে সেই দীপশিখা প্রোজ্জ্বল অবস্থায় অনড়–চল থাকে৷ আর সেই দীপশিখা যদি অনির্বাণ হয় সেই নিরন্তর দেদীপ্যমান ঊর্ধ্বপানে অবিচল অনলশিখাই তো মানুষকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করে৷ চিরকাল তাই করে এসেছে৷
আমি যে দীপশিখার কথা বলছি তা হচ্ছে আনন্দমার্গের সংগ্রামের দীপশিখা৷ আনন্দমার্গের সুমহান আদর্শের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিকটি হচ্ছে এই সংগ্রাম৷ আনন্দমার্গের জন্মলগ্ণ থেকে এই সংগ্রামের সূত্রপাত৷ আর তার হোতা ও পুরোধা স্বয়ং আনন্দমার্গের প্রবর্তক ও প্রতিস্থাপক শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ এই তো সেদিন সর্বত্র উদ্যাপিত হ’ল নীলকণ্ঠ দিবস৷ কী সেই নীলকণ্ঠ দিবস আর কেনই বা এই নাম
১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী বিহারের পটনা বাঁকীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারুদ্ধ থাকাকালে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর বিষপ্রয়োগ করা হয়৷ একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এইভাবে তাকে হত্যা করা৷ এর পটভূমি অনেক দিন ধরেই তৈরী হচ্ছিল৷ আনন্দমার্গের আদর্শ ও কর্মধারাই এমন যে রাষ্ট্রশক্তি, নিহিত স্বার্থবাদী, কুসংস্কারপন্থী, দুর্নীতিবাজ ও রাজনৈতিক দলগুলি অর্থাৎ এককথায় পাপশক্তির বিষনজরে সে পড়বেই৷ তাই প্রতি পদক্ষেপে সংগ্রাম করতে করতে আনন্দমার্গ এগিয়েছে৷ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি তখন তাঁর নিজস্ব কায়দায় নিজের প্রধানমন্ত্রীর আসন পাকাপোক্ত করে নিচ্ছেন৷ এবার তাঁর নিষ্ক্ণ্ঢক হওয়ার পালা৷ তখন তিনি তৎকালীন রাশিয়ার (পড়ুন কে.জি.বি–র) অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হচ্ছিলেন৷ তখন রাশিয়া ও বিশ্বজুড়ে কম্যুনিষ্টদের লৌহ শাসন ও সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করার মাধ্যম ছিল মূর্ত্তিমান আতঙ্ক এই কে.জি.বি৷ এই কে.জি.বি–র ধাঁচেই ও অনুকরণে ইন্দিরা গান্ধী গড়ে তোলেন সি.বি.আই৷ সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর মনে কোনভাবে ঢোকে যে আনন্দমার্গ তাঁর পথের কাঁটা৷ তাঁরই নির্দেশে সি.বি.আই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা তৈরী করে ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাঁকে কারারুদ্ধ করে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল আনন্দমার্গের সংঘপ্রধানকে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে আনন্দমার্গকে হীনবল করে দেওয়া, দাবিয়ে দেওয়া ও শেষে নির্মূল করে দেওয়া৷
প্রথমে তাঁকে বিহারের বক্সার জেলার কারাগারে রাখা হয়৷ সেখানে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে পটনার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়৷ জেলে প্রথম থেকেই কর্তৃপক্ষ সি.বি.আই–এর নির্দেশে তাঁর ওপর নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতো৷ বিচারাধীন বন্দী হিসেবে তাঁর প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল৷ ছোটখাট ব্যাপারেও তাঁকে পটনা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হতে হত৷ এমনকি তাঁর সেলে পাখা, আলোর ব্যবস্থাটিটুকুও ছিল না৷ এ ব্যাপারে পটনা হাইকোর্টের আদেশের পরেও অনেক গড়িমসির করে পাখা–আলোর বন্দোবস্ত হয়৷ এসব কারণে মাঝে–মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন৷ ১৯৭২ সালে তাঁর মা শ্রীমতী আভারাণী সরকারের দেহাবসান হয়৷ সবরকম চেষ্টা করা সত্ত্বেও সি.বি.আই–এর তীব্র বিরোধিতায় তিনি জ্যেষ্ঠ্য পুত্র হিসেবে মায়ের শেষকৃত্যটিও করতে পারেন নি৷
এইভাবে প্রায় দেড় বছর চলার পরে সি.বি.আই লক্ষ্য করে যে শ্রীশ্রীআনন্দমূত্তিজীক্ সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করেও আনন্দমার্গের অগ্রগতি বিন্দুমাত্র রোধ করা যায়নি৷ বরং তা ভারতের সর্বত্র আরও বিশালভাবে বিস্তারিত হয়েছে৷ এমনকি জেলের ভিতর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর সি.বি.আই–এর সর্বদা তীক্ষ্ণ নজর থাকা সত্ত্বেও তাঁরই নিদেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আনন্দমার্গের অনেক সন্ন্যাসীকে ধর্ম প্রচারের জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
ফলতঃ রাষ্ট্রশক্তি ও সি.বি.আই শঙ্কিত হয়ে পড়ে৷ উপায়ান্তর না দেখে রচিত হয় সুপরিকল্পিত জঘন্য এক ষড়যন্ত্র৷ এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তাঁর সহ–ভিযুক্তদের বাঁকীপুর জেল থেকে বিহারের অন্য জেলায় স্থানান্তরিত করা হয়৷ পরে তাঁর দেখাশোনার জন্যে নিযুক্ত জেলের কয়েদীদেরও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে অন্যান্য জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জেলের ভেতর সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন৷ তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ঠিক এই অবস্থায় কর্তৃপক্ষ জেলের ডাক্তারকেও বদল করে অন্য এক ডাক্তারকে নিয়ে আসে৷ আসলে নোতুন ডাক্তার ছিল সি.বি.আই–এর হীন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার এক দোসর মাত্র৷
১২ ফেব্রুয়ারী বিকেলে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করায় জেলের নোতুন ডাক্তার এসে তাঁকে পেট খারাপ ও আমাশয়ের ওষুধ দেয়, যা তাঁর কষ্টের বিন্দুমাত্র লাঘব করেনি৷ সেইদিন রাত্রে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে, বারংবার খবর করার পরে জেলের ডাক্তার এসে তাঁকে বলে যে পটনা সিবিল সার্জেনকে খবর করা হয়েছে৷ তিনি আসবেন৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অনেক কষ্টে নিজের হাতে লিখে পটনা আনন্দমার্গের আশ্রমের তাঁর নিজের লোকেদের খবর করার জন্যে তাদের নাম–ঠিকানা টেলিফোনের নম্বর ইত্যাদি ডাক্তারের হাতে দেন৷ কিন্তু জেনেশুনেই জেল কর্তৃপক্ষ তাদের কোন খবর দেয়নি৷ রাত ১১টার সময় জেলের ডাক্তার এসে বলে যে সিবিল সার্জেন আসবেন না ও তিনি একটি ওষুধ খাওয়ানোর জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন৷ এইভাবে সিবিল সার্জেনের নাম করে এক ওষুধ গভীর রাত্রে তাঁকে খাওয়ানো হয়–যা বাস্তবে ছিল তীব্র বিষ৷ সেই ওষুধ খাওয়ার পরে পরেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন৷ পরের দিন সকাল সাতটার পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে৷
তখন তাঁর সারা শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা৷ সেই তথাকথিত ওষুধ বা বিষের প্রভাবে তাঁর শরীরে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা তিনি নিজে কয়েকদিন পর লিখিতভাবে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ ও ভারতের রাষ্ট্রপতিকে লিখে পাঠান৷ তাতে তিনি তথাকথিত ওষুধের নিম্নলিখিত প্রতিক্রিয়াগুলি উল্লেখ করেন–(ক) সারা শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা, (খ) স্নায়ূসমূহের অচলাবস্থা, (গ) দুই চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ও চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল বেরোতে থাকা, (ঘ) মাথায় অসহনীয় যন্ত্রণা, (ঙ) মস্তিষ্কের অসাড়তা নুন্দ্বব্জব্ধন্দ্বব্দব্ প্সন্দ্র ত্ব্ব্জ্ত্রনুগ্গ৷ দুই তিন দিন পরে বাইরে থেকে এক ডাক্তার এসে তাঁকে পরীক্ষা করেন৷ সেই সময় তাঁর অস্বাভাবিক রকমের উচ্চ রক্তচাপের কথা ডাক্তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন৷ আরও পরীক্ষার পর তাঁর শরীরে শর্করার অংশ দেখা যায় থ্রি–প্লাস ()৷ উল্লেখ্য যে তাঁর শরীরে উচ্চ রক্তচাপ বা শর্করার চিহ্ণমাত্র ছিল না৷ এ সবই স্পষ্ট বিষপ্রয়েগের লক্ষণ৷ কয়েকদিন ধরে তিনি সেই বিষকে আত্মস্থ বা আত্মস্যাৎ করেন৷ আসলে যে সংকল্প সাধনের জন্যে তিনি তারকব্রহ্ম রূপে জন্ম নিয়েছেন, তা সাধিত না হওয়া পর্যন্ত কে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে৷
দ্বিতীয় পর্ব
পূর্বেই বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী পটনার (বিহার) বাঁকীপুর সেন্ট্রাল জেলে মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর পরিকল্পিত ভাবে বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ ভয়াবহ রকমের শারীরিক নানা রকমের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর ঐশ্বরীয় ক্ষমতায় সেই বিষ ধারণ করেন ও আত্মস্থ করেন৷ এটা তিনি করেন মানবতা ও জগৎকে বাঁচানোর স্বার্থে৷ মানুষের মধ্যে যে হানাহানি, কাটাকাটি, হিংসা–দ্বেষ, খন্ডীকরণ, বিখন্ডীকরণ, দু’–দু’টো বিশ্বযুদ্ধের রণোন্মত্ততা ও তার বিষময় প্রভাব – এই সমস্ত কিছুর যে মিলিত হলাহল জমা হচ্ছিল, এই সঙ্গে তাও তিনি আত্মসাৎ করেন৷ শুধু তাই নয়৷ ভবিষ্যতেও মানুষেরই ভুলে একই রকমের হলাহল মানব–সমাজে উদ্গীন হবে, তার তীব্রতাকে হ্রাস করতে সে সবের বৃহদংশ তিনি গ্রাস করে নেন৷ এইভাবে তিনি মানবতাকে এগিয়ে যাবার পথ প্রশস্ত করেন৷
পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী সমুদ্রমন্থন থেকে উত্থিত বিষের প্রভাবে মরণাকুল মানুষ অন্যান্য জীবকে বাঁচাতে শিব তা কন্ঠে ধারণ করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন৷ কিন্তু সে তো ছিল, কল্পনার কথা৷ আর এই ঘটনা বাস্তব, অতি বাস্তব, জেলের মধ্যেই এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল৷ তাই পৃথিবী ও মানবতার ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব অত্যাশ্চর্য ঘটনা৷ সেই জন্যে আনন্দমার্গীরা এই দিনটিকে ‘‘নীলকন্ঠ দিবস’’ রূপে পালন করেন৷ তাদের কাছে এই দিনটি শোকের বা দুঃখের দিন নয়, আনন্দের দিন৷ কেননা পাপশক্তির ষড়যন্ত্র শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন, পাপশক্তি পরাজিত হয়েছিল৷
যাই হোক, সি, বি, আই বিষ প্রয়োগ করল ও তিনি তা আত্মসাৎ করে বেঁচে থাকলেন – এটুকুর মধ্যেই ঘটনাপ্রবাহ শেষ হয়ে যায়নি৷ বরঞ্চ এটা ছিল সূত্রপাত মাত্র৷ বিষ প্রয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এর পরে পরেই শুরু হয়ে গেল বহুমুখী তীব্র সংগ্রামের ঘটনাস্রোত৷ এই জঘন্য ঘটনার অভিঘাতে দেশ–বিদেশে আনন্দমার্গীরা গর্জে উঠলেন, তীব্র থেকে তীব্রতর প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন, বিক্ষোভে–মিছিলে–আইন তাঁরা উত্তাল হয়ে উঠলেন৷ পটনাতে আনন্দমার্গীদের বিক্ষোভ সামলাতে মুখ্যমন্ত্রী আব্দুল গফুরের পুলিশকে অনেকবার লাঠিচার্জ ইত্যাদি করতে হয়েছিল৷ শত শত আনন্দমার্গী ও কর্মীরা কারাবাস করলেন৷ অতসব করেও আনন্দমার্গীদের বিন্দুমাত্র থামানো বা দমানো যায়নি৷ গুরুর প্রতি এতবড় অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম ক্রমে প্রচন্ড রূপ নিল৷
আনন্দমার্গের ইতিহাস নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাস, আর সেই সংগ্রামের সূত্রপাত ১৯৫৫ সালে বিহারের জামালপুরে আনন্দমার্গের জন্মলগ্ণ থেকেই৷ আনন্দমার্গের আদর্শ কত সমৃদ্ধ, অতি উচ্চ, সংকীর্ণতা–মুক্ত, উদার, সার্বভৌম ও সম্পূর্ণ ভাবে অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ৷ সেই জন্যেই আনন্দমার্গ পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে৷ এ বাধা আর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, আর তার ফলশ্রুতিতে আনন্দমার্গের গতিবৃদ্ধি – এর একটা ধারাবাহিকতা আছে৷ প্রথম হ’ল জামালপুর পর্ব (১৯৫৫–১৯৬৬), তারপর আনন্দনগর পর্ব (১৯৬৬–৬৭), রাঁচী পর্ব–যার মধ্যে কুচবিহারের একটি উপপর্ব আছে (১৯৬৭–১৯৭১), পটনা পর্ব (১৯৭১–১৯৭৮), কলকাতা পর্ব (১৯৭৮–১৯৯০)৷ প্রত্যেকটি পর্বেই সংগ্রামের সঙ্গে আছে আনন্দমার্গীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন ষড়যন্ত্র প্রতিবাদ কষ্টবরণ ও আত্মবলিদান৷ ‘‘নীলকন্ঠ দিবসে’’র সূত্রে আমরা শুরু করেছি পটনা পর্ব থেকে৷ তার আগেকার আনন্দনগর ও রাঁচী পর্বের কথা এরপরেই আসবে৷ আনন্দনগর পর্ব থেকে আনন্দমার্গের সংগ্রামী পরিচয় বেশী করে জনসমক্ষে আসতে থাকে৷
সংগ্রামের একটি দীপশিখা অসংখ্য দীপশিখাকে প্রজ্জ্বলিত করে দেয়, একটি স্ফুলিংগ অগণিত স্ফুলিংগ সৃষ্টি করে৷ সমাজের ক্ষেত্রে স্ফুলিংগ মানেই তা মনের গভীরে তীব্র নাড়া, আলোড়ন সৃষ্টি করবেই৷ আর মানুষের অন্তর মন সেই আগুন, সেই আলোড়নকেই চায় –বিশেষ করে তরুণ–যুব সম্প্রদায় আর সচেতন মানুষের মন৷ তাই আনন্দনগর পর্ব থেকেই আনন্দমার্গের সংগ্রাম মুখরতার আকর্ষণে বাংলা, বিহার ও ভারতের সব স্থান থেকেই দলে দলে তরুণ–তরুণী ও সচেতন–সম্বুদ্ধ মানুষ আনন্দমার্গে যোগদান করে৷ পটনা পর্বের সময় আনন্দমার্গীদের সংখ্যা যেমন লাখের কাছাকাছি হয়, তেমনি ত্যাগব্রতী সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনী কর্মীর সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছে যায়৷ পটনার সংগ্রামী পর্বে আনন্দমার্গীদের সঙ্গে এই সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনী কর্মীরাই তো ছিলেন অগ্রবর্তী সৈনিক৷ তাঁদেরই মধ্যে একজন হলেন আচার্য দিব্যানন্দ অবধূত৷
ইতোমধ্যে জেলের ভেতর আনন্দমূর্ত্তিজীর ওপর দুর্ব্যবহার, অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে৷ তিনি তখন চরম অসুস্থ, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ৷ তাঁর সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও মার্গের কাউকেই দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ তাঁর সেলে দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী, ম্যাগাজিন কিছুই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ এমন কি পটনায় তাঁর বাসস্থান থেকে কোন খাবারও আসতে দেওয়া হচ্ছে না৷ জেলে খাবারের নাম করে যা তাঁকে খেতে দেওয়া হচ্ছে তা অখাদ্য তো বটেই, তা এক ধরণের আমিষ৷ তা তিনি স্পর্শও করছেন না৷ এইভাবে বেশ কয়েকদিন তিনি অভুক্ত৷ বিষ প্রয়োগে কাজ হল না৷ এসব করার উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে তিল তিল করে হত্যা করা৷ মধ্যযুগীয় বর্বরতা৷ এতসব কিছু হচ্ছিল সি.বি.আই আর দিল্লীস্থিত তাদের প্রভুর অঙ্গুলীহেলনে৷ এর প্রতিবাদে আনন্দমূর্ত্তিজী ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট, জেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, বিহার গভর্ণর, ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে অত্যাচারের কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন৷ ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল বিহারের গবর্ণরকে লিখিতভাবে জানালেন যে তাঁকে বাধ্য হয়ে খাদ্যগ্রহণ বন্ধ করতে হচ্ছে (ক্টঢ ন্দ্রনুস্তু প্স প্সব্ধড়ন্দ্বব্জ ব্ধব্ধন্দ্বব্জুত্রব্ধন্ ত্ব্ব্ভব্ধ ব্ধপ্স ব্দব্ধপ্সহ্ম ব্ধ্ত্রন্সনুন্ধ ন্দ্রপ্সপ্সস্তু ন্দ্রপ্সব্জ নুস্তুন্দ্বন্দ্রনুন্ব্ধন্ হ্মন্দ্বব্জন্প্সস্তু.ক্ট)৷ এই সব চিঠিপত্রের কথা দাবিয়ে দেবার জন্যে কর্তৃপক্ষ ও সি.বি.আই যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও যেভাবেই হোক তা জনসমক্ষে চলে আসে৷ আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল৷ আনন্দমার্গীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল৷
আচার্য দিব্যানন্দ অবধূত – প্রাণে উষ্ণ স্পন্দন জাগানো এক নাম৷ দিব্যকান্তি তেজস্বী চেহারা৷ সুশিক্ষিত, তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর, কর্মেষণায় সমুজ্জ্বল, জনসেবা–আদর্শ নিষ্ঠা আর গুরুভক্তিতে অসীম প্রত্যয়ী৷ সাহস ও শৌর্যে অদম্য এক ব্যষ্টিত্ব৷ পাপশক্তির হাতে গুরুর এহেন চরম লাঞ্ছনা–যাতনা–ত্যা কথা জেনে অন্যেরা যখন রাগে–ক্ষোভে ফুঁসছে, তখন আচার্য দিব্যানন্দজী এক কঠিন, কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন৷ হঠাৎ করে ঝোঁকের বশে নেওয়া কোন উটকো সিদ্ধান্ত নয় ধীরস্থির ভাবে ভেবে, সব দিক খতিয়ে চিন্তা করে আদর্শ, সংঘটন ও গুরুর প্রতি সমর্পিত প্রাণ সৈনিকের মতই এক অভাবিত সিদ্ধান্ত নিলেন৷ আত্মদাহ হ্যাঁ, আত্মদাহই৷ তা যেমন পাপশক্তিকে প্রবল ধাক্কা দেবে তেমনি জনচেতনার মূল ধরে ভুমিকম্পের মত জোর কম্পন সৃষ্টি করবে৷ পটনায় আনন্দমার্গী ও কর্মীদের সামনে এই সাহসী সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানালেন, তারিখও জানিয়ে দিলেন – ৯ই এপ্রিল৷ সরকার এমনকি আনন্দমার্গের কেউ যাতে তাঁকে এই কাজ থেকে বিরত করতে না পারে, তাই তিনি অজ্ঞাত স্থানে চলে গেলেন৷ সেখান থেকে আত্মদাহের আগের দিন অর্থাৎ ৮ এপ্রিল, ১৯৭৩ কেন্দ্রীয় সরকার ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের উদ্দেশ্যে এক চিঠি পাঠালেন৷ যার প্রতিলিপি আনন্দমার্গীদের কাছে সেদিনই পৌঁছাল৷ এক অনন্য সাধারণ সিদ্ধান্ত, ঐতিহাসিক ঘটনা৷ মরমী অথচ সংগ্রামী চিঠি৷ ইংরেজীতে লিখিত তাঁর সেই চিঠির কিয়দংশের বাংলা তর্জমা নীচে উদ্ধৃত করছি –
‘‘ভারতীয় যোগী–মুনি–ঋষিদের প্রাচীনতম পরম্পরার নামে এই ভারত সরকারকে আমি অভিযুক্ত করছি, যারা আমার মহান গুরু ও আদর্শকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মুক্ত পৃথিবীর বৃহত্তর মানবতার নামে এই ভারত সরকারকে আমি অভিযুক্ত করছি তাদের পাপকর্মের জন্যে সত্য ও ধর্মের নামে সর্বশক্তিমান পরমপুরুষের সর্বোচ্চ দরবারে ভারত সরকারকে আমি অভিযুক্ত করছি যাতে তারা সম্যুচিত শাস্তি পায়৷ হে প্রিয় বাবার অকুতোভয় আধ্যাত্মিক সৈনিকেরা, পাপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আপনারা এগিয়ে যান৷ জয় আমাদেরই হবে৷
জয় আনন্দমূর্ত্তিজী, জয় আনন্দমার্গ, জয় নবীন বিশ্ব৷’’
পাপী সরকারের আত্মদাহ নিবারণের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হ’ল৷ আচার্য দিব্যানন্দজী পথ দেখালেন৷ তারপর একে একে আচার্য দীনেশ্বরানন্দ অবধূত, আচার্য অতুলানন্দ অবধূত, আরও কয়েকজন, এমনকি বিদেশের কয়েকজন সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীও আত্মদাহ করলেন৷ এ যেন ঠিক –‘‘নিঃশেষে প্রাণ কে করিবে দান তারই লাগি কাড়াকাড়ি’’৷