প্রভাতী

ৰেফাঁস কথার ফ্যাসাদ 

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘খরগ্রহ’ শব্দের ভাবারূঢ়ার্থ হল যেখানে  অনেক গাধা রয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে এক-একটি মানে হল গাধার আস্তাবল৷  দ্বিতীয় মানে হচ্ছে প্রাচীনকালে যখন দ্রুতগামী যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না তখন রাজপথ ধরে দূর দূরান্তে মানুষ চলত পদব্রজে৷ অবস্থাবান মানুষেরা ও নারীরা চলতেন শিবিকায় (দোলায়)৷ পাল্কী জিনিসটা তখনও আমাদের দেশে আসেনি৷ ওটি  এনেছিলেন ইয়ুরোপীয়রা৷ Palanquin’ শব্দ  থেকে ‘পাল্কী’ শব্দটি এসেছে৷ এই শিবিকা বা দোলার ব্যবহার  নারীদের জন্যে  তো করতে হতই, অবস্থাপন্ন মানুষেরাও বেশী দূর যেতে হলে শিবিকায় বা দোলায় যেতেন৷ ছোটখাট দোলা (দ্বিদোলা) দু’জন লোক কাঁধে বহন  করত৷ আর বড় দোলা বহন করত চারজন  লোকে (চতুর্র্দেলা)৷ দূর পাল্লার পথে গো-শকট, গর্দভ-শকট, ঘোটক শকটের ব্যবস্থা তো ছিলই৷ তবে  সাধারণতঃ মালবাহী শকটের জন্যে  গর্দভ শকট অধিক ব্যবহৃত হত৷  এই ‘শকট’ শব্দ থেকে ওড়িয়ায় ‘শগর’ শব্দটি  এসেছে৷

 যাইহোক, সরকারী ডাক ও কিছুটা বে-সরকারী ডাক বহনের  জন্যেও ঘোটক-শকট অথবা অশ্বারোহী মানুষ কাজ করে দিত৷ দূরগামী মানুষ ও শকটের  জন্যে প্রতি যোজন অন্তর (আন্দাজ ছ’ক্রোশ বা ৰার মাইল) একটি করে চটি (প্রাচীন তামিলে চউলট্রি ও সংস্কৃতে ‘চউট্রি’, বাংলায় ‘চটি’ শব্দ এসেছে) বা সরাই থাকত৷ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তীর্থযাত্রীদের জন্যে আজও এই ধরনের চটি রয়েছে৷ আমাদের আসানসোলের কাছে রয়েছে নিরসাচটি, বর্ধমানের কাছে নঈসরায়, মুঙ্গেরের কাছে রয়েছে পূরসরায় ও সোফিয়াসরায়, কাশীর কাছে রয়েছে মোগল সরায়৷  তা সেই  সরকারী সরক ধরে যে যোজনান্তর চটি বা সরায় থাকত সেখানে যাত্রীদের জন্যে জ্বালানী কাঠ, জল ও কাঁচা খাদ্যের ব্যবস্থা থাকত৷  লোকেরা নিজে রেঁধে খেতেন৷ যাঁরা রাঁধতে পারতেন না তাঁদের জন্যে রেঁধে দেবার লোকও থাকত৷  এই চটি বা সরায়ের  কাছাকাছি জায়গায় থাকত খরগৃহ, যেখানে  পরিশ্রমে ক্লান্ত পশুরা বিশ্রাম নিত,তাদের  দানা-পানী পেত৷ যাঁরা ডাক বহন করতেন (ডাকহরকরা) তাঁরা ওখানে এসে অনেক সময় বিশ্রাম নিতেন! আবার  অনেক সময়  কর্মচারী-বদলও ওই স্থানে  করে দেওয়া হত৷  কর্মচারী বদলের সঙ্গে সঙ্গে  অনেক সময় বাহক  পশু বা শকটের  পরিবর্তনও করে দেওয়া হত৷ এখন তোমরা উত্তর ভারতের  দিকে  যাবার সময় বিহার ও উত্তর প্রদেশের পথপার্শ্বে কিছু কিছু এই ধরণের  গুমটি হয়তো দেখে  থাকবে৷ তা’ পশুদের জন্যে নির্দিষ্ট সেই গুমটিতে গোরু, গাধা, ঘোড়া, যাই থাকুক না কেন তাদের সাধারণ শব্দ ছিল ‘খরগ্রহ’৷

খরগ্রহের  কথা বলতে গিয়ে একটি গল্পের কথা মনে পড়ল৷ একবার এক স্কুল-ইন্সপেক্টর সাহেব বেশ পণ্ডিত মানুষ তো ছিলেনই, সংস্কৃতে ছিল তাঁর অসামান্য দখল৷ যে বিদ্যালয় পরির্দশনে গেছলেন সেখানকার সংস্কৃতের পণ্ডিত মশায়ও ছিলেন ধুরন্ধর পণ্ডিত৷ মানুষটি বেশ ভাল, তবে একটু স্পষ্টবাদী৷ ইন্সপেক্টর সাহেবের বিদ্যালয়টির কোন কিছুই পছন্দ হল না৷ সংস্কৃতের ক্লাশে  গিয়ে তিনি তো রেগেই টং৷ পণ্ডিতজীর দিকে তাকিয়ে রোষকোষায়িত নয়নে বললেন--- এটি কি বিদ্যালয়, না  ‘খরগ্রহ’ (গাধার ঘর) ?

পণ্ডিত মশায় তাঁর কথাটা গায়ে না মেখে হাসতে হাসতে  ৰললেন--- একটা অনুরোধ রাখবেন স্যর?

ইন্সপেক্টার সাহেব বললেন--- কী অনুরোধ! কিসের অনুরোধ! কেন অনুরোধ!

পণ্ডিতজী ৰললেন--- আপনি  দয়া করে দরজার চউকাঠের  বাইরে দাঁড়ান স্যার, নইলে আমি মনে অত্যন্ত ব্যথা পাব৷

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন--- আমি ঘরে থাকলে ব্যথা পাবেন, আর আমি চউকাঠের বাইরে দাঁড়ালে ব্যথা দূর হবে, এ কেমনতর কথা৷

পণ্ডিতজী বললেন--- ‘‘খরগ্রহ’’ মানে যে ঘরে গাধারা থাকে৷ আমরা তো গাধা আছিই...ছিলুম... থাকবও৷ কিন্তু আপনাকে আমরা একমূহুর্তের জন্যেও  গাধা বলে ভাবতে চাই না৷ তাই  আপনাকে  অনুরোধ করছি আপনি  ঘরের বাইরে থাকুন৷                    

‘খর’ সম্বন্ধে আরো একটি ছোট্ট গল্প মনে পড়ল৷ একবার নাকি পাটনা সচিবালয় থেকে কোন একজন বি.ডি.ও, সাহেবের কাছে একটি পত্রাঘাত গেছল যে তিনি যেন আগামী চবিবশ  ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দেন তাঁর ব্লকে কতগুলি ‘খর’ অর্র্থৎ গাধা আছে৷

তোমরা সেই পটনা সচিবালয়ের গল্প জান তো? একবার আকল্‌মন্দ সিং বাঁকীপুর রেল ইষ্টিশান থেকে (এখন ইষ্টিশানটির নাম হয়েছে পটনা জংশন) সেক্রেটারিয়েট যাচ্ছিলেন৷ ইষ্টিশনে তিনি রিক্সাওলাকে বলেছিলেন--- ‘‘মুঝে সচিবালয় লে চলো’’৷

রিক্সাওলা তাঁর কথা ৰুঝতে না পেরে ৰলেছিল--- সা’ব,রাষ্ট্রভাষামে ৰোলিয়ে, সচিবালয় মুঝে মালুম নেহী হৈ৷ আকল্‌মন্দ সিং ৰলেছিলেন---  সচিবালয় তুমহে মালুম নহীঁ?  সচিবালয়! সচিবালয়! জিস্‌কো আংরেজীমেঁ সেক্রেটারীয়েট  কহতেঁ হৈ৷

রিক্সাওলা তাকে বলেছিল--- বহী ৰোলিয়ে সেক্রেটারীয়েট, আপ রাষ্ট্রভাষা মেঁ  কিঁউ নহী ৰোলতে হেঁ?  কিঁউ আপ আংরেজীমেঁ ‘সচিবালয়’ ‘সচিবালয়’ ৰোলতা হেঁ? আজকাল আংরেজী কা জমানা নহীঁ হৈ৷

তা’সে যাইহোক, সেই পটনা সচিবালয় থেকে পত্র দণ্ডটি পেয়ে বি.ডি.ও সাহেব তাঁর বি. এল ডব্লিউ Village  level worker)  বা গ্রামসেবককে বললেন---তিনি যেন চবিবশ ঘন্টার মধ্যে তথ্যটি পটনা সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেন৷ বি.এল. ডব্লিউ. তো খবরটা শুণে ভয়ে চক্ষুস্থির ৷ চবিবশ ঘন্টার মধ্যে  সে কী করে তাদের বাহাত্তরটি গ্রামে গিয়ে গাধার সংখ্যা নিয়ে আসবে৷ যখন তেইশ ঘন্টা উর্ত্তীণ হয়ে গেল তখন বি.ডি. ও  সাহেবের  কাছে  গিয়ে কেঁদে  কেটে আছড়ে পড়ে বললে--- স্যার, আর চাকরি বাঁচানো গেল না৷  আমি মাত্র দশটি গ্রামে এযাবৎ ঘুরতে পেরেছি৷ এখন যেভাবে হো’ক আমার চাক্‌রিটা বাঁচিয়ে দিন স্যর!

বি.ডি.ও সাহেব বললেন---সে জন্যে ঘাবড়াচ্ছো কেন? তুমি শুধু জানিয়ে দাও, আমি কেবল তিনটি গাধার সন্ধান জানি৷

বি.এল.ডব্লিউ. বি.ডি.ওকে  শুধোলেন--- তিনটি গাধা কে  কে  স্যর !

বি.ডি. ও সাহেব ৰললেন--- এক গদ্‌হা তুম, দুসরা গদহা মঁৈ, অঔর তীস্‌রা গদ্‌হা সচিবালয় কা বহ আফুসার জিন্‌হোনে গদ্‌হাওলা রাপোর্ট মাংগা৷ (শব্দ চয়নিকা-১৩শ খণ্ড)

পাখী জানে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

 

পাখী জানে ঘুম ভাঙানো গান,

খুশির স্রোতে ভাসিয়ে দিতে প্রাণ!

 

পাখী জানে নিরুদ্দেশের পানে

মেলতে ডানা অজানারই টানে৷

 

পাখী জানে হারিয়ে যেতে বনে,

নীড় বাঁধতে একান্তে নির্জনে৷

 

পাখী জানে মান-ভাঙানো শিষ

দোদুল ডালে দুলতে অহর্নিশ৷

 

পাখী জানে যেথায় খুশি যেতে

বাঁধন-হারা মুক্তির স্বাদ পেতে৷

 

পাখীর জানে সুদূর মেঘের আড়ে

উড়তে উড়তে হয়তো পাবে তাঁরে৷

‘তুমি নিজে এলে’

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তুমি নিজে এলে আমার ঘরে

সেকি আমার তরে শুধু আমার তরে!

নাই আবাহন নাই আমন্ত্রণ

তবুও তোমার শুভ পদার্পণ,

সূর্যোদয়ের রাঙা ঊষায়

মনোবীণায় সুর ভেসে যায়!

 

দিবস রজনী আলোকে আঁধারে

আশা-হতাশায় ‘এ’ জীবন ভরে,

কত কাল যুগ কতনা জীবন

অজান্তে কভুকি করেছি স্মরণ!

তাতো জানা নাই মনে নাই ঠাঁই

তবু ভোরের আঙ্গিনায়

তোমা দেখা পাই৷

 

কেন আমায় করলে স্মরণ,

তুমি জানো এর গোপন কারণ৷

আলো হাতে দিলে পথের দিশা,

কাটিল গহন অমানিশা৷

বুঝিনি তো আগে স্নেহ-অনুরাগে

গড়েছ প্রীতির বন্ধন,

ভাব-জড়তা দূর করে দিলে

পেয়েছি প্রেমের স্পন্দন৷

 

মানব জীবনে শঙ্কা হরণে

যোগাও দুর্জয় সাহস,

হতাশার যবনিকা টেনে 

প্রাণচঞ্চলতা নিরলস৷

অন্তঃবিহীন পথের পুঁজি

 অনন্ত আলোর প্রেরণা৷

তাই স্বাগত জানাই প্রাণ মন ভরে

কাটিল বিড়ম্বনা৷

গদ্দী মেঁ কৌন্ হ্যায়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

মানুষ আরামের অন্বেষণ করে৷ তাই এই অর্থে ‘ঢুণ্ঢ’ড করে যে ‘ঢ’ শব্দ পাই  তার একটা অর্থ হ’ল আরামের উপকরণ (ভাবারূঢ়ার্থ), যোগারূঢ়ার্থে ‘গদি’৷ গদি বলতে ৰোঝায় যা শয়নকে বা উপবেশনকে আরামদায়ক করে দেয়৷ খাটের তোষকের নীচে যে গদি ব্যবহার করি ৰা চেয়ারের ওপর যে গদি ব্যবহার করি তার জন্যে ‘ঢ’ ব্যবহার করা যেতে পারে৷

উত্তর ভারতে সাধারণতঃ ‘গদ্দা’ ব্যবহূত হয়৷ তবে ‘গদ্দী’ শব্দে ব্যবহার যে নেই এমন নয়৷ তবে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ‘গদ্দী’ বলতে ৰোঝায় দোকানদার যেখানে বসে তার কাগজপত্র দেখে বা হিসেব–নিকেশ করে সেই  স্থানটি অর্থাৎ অফিস৷ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অফিসকেও গদ্দী বলা হয়৷ গদ্দীর কথায় শেঠজীর সেই গপ্পটাও মনে পড়ে গেল৷

শেঠজীর বাড়াবাড়ি অসুখ........মৃত্যুশয্যায়৷ বাড়ীতে কান্নার রোল উঠেছে৷ খবর পেয়ে শেঠজীর পাওনাদারেরা উদ্বিগ্ণ৷  শেঠজীর অধমর্ণদের মুখে আনন্দের পাতলা ঝিলিক, যেন জল মেশানো ভেজাল দুধের পাতলা সরটি৷ শেঠজীর পুত্রেরা শশব্যস্ত হয়ে বিক্রয়কর, আয়কর ও আৰগারী বিভাগের খাতাপত্র সামলাতে ব্যস্ত৷

শেঠজী মরণাসন্ন৷ সেদিনকার মত গদ্দী ৰন্ধ করে তাঁর সাত ছেলে করজোড়ে শয্যাপার্শ্বে  এসে দাঁড়াল৷ শেঠজী নাম করে করে তাদের খবর নিতে লাগলেন৷ প্রথমে খোঁজ করলেন প্রথম পু–ের৷ শেঠজী বললেন– রামনজ র  হাজির রামনজ র হাত জোড় করে বললে–জী পিতাজী, হাজির৷ এবার দ্বিতীয় পু–ের খোঁজ করে বললেন–রামপরীক্ষণ হাজির৷ রামপরীক্ষণ বললে–জী পিতাজী, ম্যাঁয় উপস্থিত হুঁ৷ এবার তৃতীয় পু–ের খোঁজ নিয়ে শেঠজী বললেন–রামসুরথ হাজির রামসুরথ বললে–জী পিতাজী, ম্যাঁয় আপকা চরণ–কমলোঁ মেঁ হুঁ৷ এবার চতুর্থ পু–ের খোঁজ নিয়ে শেঠজী বললেন–রামসিংহাসন হাজির রামসিংহাসন বললে–জী পিতাজী, আপকা দাস হাজির৷ এবার পঞ্চম পু–ের খোঁজ নিয়ে বললেন–রামইক্ৰাল হাজির রাম ইক্ৰাল বললে–জী পিতাজী, ম্যাঁ আপকা চরণোঁ মেঁ হুঁ৷ এবার ষষ্ঠ পু–ের খোঁজ নিয়ে বললেন–রামবেশন  হাজির রামবেশন বললে–জী পিতাজী, দাস উপস্থিত হ্যায়৷ এবার সপ্তম পু–ের খোঁজ করে শেঠজী বললেন–রামনুঠা হাজির রামনুঠা বললে–দাস আপকে সেবা মেঁ হাজির হ্যায়৷ এবার শেঠজী ক্রোধে অগ্ণিশর্মা হয়ে বললেন–তুমলোগ  সাতোঁ ভাই  ইহাঁ পর হাজির হো তো গদ্দী মেঁ কৌন হ্যায় শেঠজী রাগে গর্জন করতে থাকায় হূদপিণ্ডের  ক্রিয়া ৰন্ধ হয়ে গিয়ে শেঠজীর মৃত্যু হ’ল৷

হ্যাঁ, তাহলে ৰুঝলে বাংলা ‘গদি’ ও উত্তর ভারতের ‘গদ্দী’ এক জিনিস নয়৷ একটার সঙ্গে অপরটা তোমরা গুলিয়ে ফেলো না৷

গাজনের গপ্পো

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

শিব নাকি শ্রাবণ মাসে জন্মেছিলেন৷ আর বিয়ে করেছিলেন চৈত্রমাসের শেষে৷ তাই তো চৈত্রমাসের শেষে হিন্দুনারীরা উপোস করে৷ তারা বলেন নীলের উপোস৷ আর তার সঙ্গে শুরু হয় গাজন উৎসব৷ শিবের বিয়ে উপলক্ষ্যে সন্ন্যাসীরা ছিলেন বরযাত্রী৷ বরযাত্রীরা মাঝে মাঝে গর্জন করতেন৷ সেই গর্জন থেকে গাজন শব্দের উৎপত্তি৷

আবার কেউ কেউ বলেন অন্যকথা৷ গাজনের শেষদিনে হয় চড়ক৷ মাটিতে চড়কের গাছ পুঁতে তার মাথায় আড়ভাবে একটা বাঁশ এমনভাবে বাঁধা হয় যাতে পাক খাওয়া যায়৷ আগে সন্ন্যাসীরা পিঠে লোহার বড় বঁড়শি বিধিয়ে বাঁশের শেষ অংশ থেকে ঝুলে পাক খেতো৷ এই নৃশংস প্রথাটিকে ইংরেজ সরকার ১৮৬৫ সালের ১৫ই মার্চ আইন করে বন্ধ করে দেন৷ তখন থেকে সন্ন্যাসিনীরা বুকে গামছা বা কাপড় বেঁধে চড়ক গাছে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করেন৷ চড়কের গাছটি হওয়া চাই শক্ত৷ নচেৎ ভেঙে পড়তে পারে৷ তাই শাল বা গজারি বা গর্জন গাছের একটি খুঁটি বছর খানেক পুকুরের জলে ডুবিয়ে রাখা হয়৷ গাজনের আগের দিন ভক্তরা সেই খুঁটি জল থেকে তুলে বেশ করে তেল মাখিয়ে মাটিতে পোঁতে৷ একে বলে গাছ জাগানো৷ এই গর্জন গাছের  সাহায্যে অনুষ্ঠান হয় বলেই হয়তো উৎসবের নাম গাজন৷

আবার বর্তমানকালের পণ্ডিতগণ বলেন, সার্বজনীন ভাবনা থেকে গাজন শব্দের উৎপত্তি৷ গ্রামের সকলে মিলে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতো বলে এই উৎসবের নাম গাজন৷ গ্রা+জন= গ+জন= ‘গাজন’৷

তবে এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি তাঁর নমঃ শিবায় শান্তায় গ্রন্থে বলেছেন---‘‘সারা বছর ধরে নানান জনের সঙ্গে নানান কথাই তো বলছি---জাগতিক কাজ করছি, ধান চালের কথা বলছি, পটোলের দর, বেগুনের দর নিয়ে চর্চা করছি৷ অন্ততঃ একদিন প্রাণভরে চিৎকার করে শিবের নামে গর্জন করি, ‘শিবহে’ বলে মানুষকে আহ্বান করি৷ গর্জন প্রাকৃতে গজ্জন/ বর্তমান বাংলায় গাজন৷

নববর্ষের আশিস

লেখক
আচার্য প্রবুদ্ধানন্দ অবধূত

নববর্ষের শুভ প্রভাতে

প্রীতিভরা অভিনন্দন

জানাই সকলকেই  এ জগতে,

আনন্দে কাটুক সবার মন৷                           

 

হৃদয়ে আজ হোক

চেতনার উন্মেষ,

দূর হোক জড়ীভূত

দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ৷

 

আমরা রয়েছি মিলে

এক প্রাণ এক মন,

সবাই সবার পাশে

 সবাকার আপনজন৷

 

কেহ নয় পর, দু দিনের খেলা, 

এই ভুবনের লীলা,

নিঃস্ব হাতে আবির্ভূত

নিঃস্ব হাতেই ফিরিবার পালা..

 

মিছে হানাহানি কেনই বা এত,                                          

দুঃখ কিসের তরে?

বিধাতার দান সবার জন্য

ক্ষণিকের এ সংসারে৷

 

আকাশ বাতাস সূর্য চন্দ্র

ঢেলে দেয় সবে আলো,

উদ্ভিদ,পশু,পাখি

মোদের আত্মীয়,

বাস সবারেই ভাল৷

 

এই ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলতে,

নাহি বাধা কোন আর,

 গড়িব নোতুন বিশ্ব আমরা

পরমপুরুষের এ সংসার৷

 

নববর্ষের পূণ্য লগ্ণে

এই আমাদের শপথ,

মঙ্গলময় কর্মে রত

ছুটিবে বিজয় রথ৷

শোল–ঘাপটি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

গাত্রূসম্কুচূঘঞূণিনি‘গাত্রসংকোচিন্’৷ ভাবারূঢ়ার্থে গাত্রসংকোচিন্ মানে যে শরীরকে সংকুচিত করে, যোগারূঢ়ার্থে যে পরিবেশগত ও মানসিক কারণে শরীরকে ছোট করে দেয়, ঘাপ্পি বা ঘাপটি মেরে বসে পড়ে৷ এই ঘাপ্পি বা ঘাপটি মারা আবার তিন ধরনের হয়৷

১) শোয়া–ঘাপটি ঃ যেমন হাত–পা কুঁঁকড়ে হাঁটু দু’টো ৰুকের কাছাকাছি এনে চিৎ হয়ে ৰা পাশ ফিরে শুয়ে থাকা৷ এতে শীত একটু কম লাগে৷ শীতের দিনে বিড়াল, কুকুর ও অন্যান্য অনেক জীৰকে এই ভাবে শোয়া অবস্থায় দেখতে পাৰে৷

 তোমরা কখনো কখনো ঠান্ডায় অনেকক্ষণ থাকার পর শীতের রাতে যখন নেপের তলায় চলে যাও যদিও সে সময়টায় আমি তোমাদের নেপ সরিয়ে দেখিনি তবু অনুমান করি খানিকটা সময় শরীরকে কিছুটা তাতিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তোমরা ৰোধ হয় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাক অর্থাৎ কুঁকড়ি হয়ে শুয়ে থাকো৷

২) বসা–ঘাপটি ঃ দ্বিতীয় ঘাপটি হল বসা–ঘাপটি বা তিন–মুণ্ডে ৰসা৷ দু’টো হাঁটু হল দু’মুণ্ড ও তোমার নাকের ডগা হল তিন মুণ্ড৷ দু’হাতে করে অনেক সময় পা দু’টোও জড়িয়ে ধরো৷ তোমরা অনেক ক্ষেত্রে দুঃখের সময়ে, শোকের সময়ে এইভাবে ৰসে থাকো৷ আবার অনেক সময় হাঁটাহাঁটি ভাল লাগছে না ৰলেও ওই ভাবে বসে থাকো৷ হুগলী জেলার কলাচাষীদের আমি সাধারণতঃ ওইভাবে উৰু হয়ে বসে কলার কাঁদির ছড়া গুণতে দেখেছি৷ তোমরা দেখোনি

৩) দাঁড়িয়েও ঘাপটি মেরে থাকা যায়৷ এক হাতের কনুইয়ের ওপর বা কনুইয়ের ফাঁকে আরেক হাতের কনুই ঢুকিয়ে দিয়ে শীতের রাতের কষ্ট দূর করার চেষ্টা তোমরা করো না কি! নিশ্চয় করো৷ এতে শীতের কষ্ট কিছুটা কমানো যায়৷

একটা মজার কথা ভেবে দেখ৷ পরচর্চা করবার সময় (কারো কারো মতে যা ডালমুট–চানাচুরের চেয়েও মুখরোচক) কেউ কিন্তু ঘাপটি মেরে ৰসে না, ভাল করে আসন পেতেই বসে৷ মেয়েরা যাঁতীতে সুপুরি কোচাবার সময় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসেন.... ঘাপটি মেরে বসেন না, কতকটা যেমন বসেন পা দিয়ে সলতে তৈরী করার সময়৷ যাই হোক্, এই ঘাপটি মারা হল এক ধরনের গাত্র সংকোচন৷

অনেকদিন আগে তোমাদের একবার শোল–ঘাপটির গপ্প ৰলেছিলুম না! একজন ছিলেন জাঁদরেল হাকিম সাহেৰ তাঁদের ছিল পারিবারিক একটি হেয়ার–কাটিং সেলুন৷ আরেকজন ছিলেন জাঁদরেল মৎস্যজীবী তাঁর ছিল সাতখানা মাছ ধরার ডিঙ্গি৷ কেউ কারো চেয়ে কম নয়–ইজ্জতে, আভিজাত্যে, অর্থকৌলীন্যে৷

গোপেন্দ্রনাথ হাকিমের এজলাসে একটা খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসেছেন সেই মৎস্যজীবী বৃন্দাবনচন্দ্র৷ গোপেন্দ্রনাথ হাকিম বৃন্দাবনচন্দ্রকে শুধোলেন–আচ্ছা, যখন লোকটাকে খুন করা হচ্ছিল লোকটা কোনো আবাজ করেনি

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–হ্যাঁ, লোকটা তখন কই–কাতরান কাতরাচ্ছিল৷

হাকিম শুধোলেন––ওই বীভৎস কাণ্ড দেখবার সময় তুই কী করছিলি

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–আমি তখন ভয়ে শোল–ঘাপটি মেরে ৰসেছিলুম৷

গোপেন্দ্রনাথ হাকিম বৃন্দাৰনচন্দ্রকে শুধোলেন–সময়টা তখন দিন না রাত্তির, আলো না অন্ধকার

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–দিনও নয়, রাতও নয়, আলোও নয়, অন্ধকারো নয়, কেমন একটা আলো–আঁধারি৷ এই পুকুর পাড় ঘেঁসে মাছেরা যে সময় গাঁদি মারে তেমন সময়৷

গোপেন্দ্রনাথ হাকিম শুধোলেন–তুই তারপর কী করলি

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–আমি জাল–কাটা বোয়ালের মত ঝপাঙ করে জলে লাফ দিয়ে পড়লুম, তারপর চ্যাঙ মাছের মত চোঁ চোঁ করে পুকুরের ওপারে পঁৌছে গেলুম...কাতলা মাছের মত কেৎরে গিয়ে একটা আঁৰ গাছের আড়ালে গিয়ে নুকোলুম৷

গোপেন্দ্রনাথ ৰললেন–তোর ভীমরতি হয়েছে, সবেতেই মাছের কথা, সবেতেই মাছ নিয়ে আদিখ্যেতা৷ যেন মাছ ছাড়া দুনিয়ায় আর কোনো কুলীন ৰামুণ নেই৷

কথাটা বৃন্দাবনচন্দ্রের গায়ে লাগল....লাগল না ৰলে ৰলতে হয় ৰিঁধল৷

গোপেন্দ্রনাথ বৃন্দাবনচন্দ্রকে শুধোলেন–আচ্ছা, ৰল তো এই যে খুনের ঘটনাটা ঘটল .... রক্তপাত হল এতে আন্দাজ কতখানি রক্ত বেরিয়েছিল ৰলতে পারিস

বৃন্দাবনচন্দ্রের মুখেচোখে, ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির ঝিলিক নেৰে এল৷ সে ৰললে– তা ঠিক কী করে ৰলি ৰলুন হুজুর, তৰে আপনি যাতে আন্দাজ পেতে পারেন সেই ভাবে ৰলছি...অ এই নাপতে বাটির এক বাটি হৰে৷

যাই হোক্, এই ঘাপ্পি মারা বা ঘাপটি মারা কাকে ৰলে জেনে গেলে৷

হ্যাঁ, তবে মটকা মারা কিন্তু আলাদা জিনিস আর এই মটকা মারার সঙ্গে গরদ–মটকা–তসরে কোনো সম্পর্ক নেই৷ ৰাঙলা ভাষায় ‘মটকা’ শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহূত হয়৷ প্রথমতঃ যে পলু পোকার গুটি খেয়ে প্রজাপতি গুটি কেটে বেরিয়ে যায় সেই গুটির গরদ মোটা ও নিকৃষ্ট মানের হয়৷ সেই মোটা ও নিকৃষ্ট মানের গরদকে মটকা ৰলা হয়৷

পাকা ঘর বাদে খড়, টিন, টালি প্রভৃতি দিয়ে ঘর তৈরী করলে ঘরের যেটা সর্বোচ্চ অংশ তাকেও মটকা ৰলে–‘‘চেয়ে দেখ মটকার ওপর একটা মুরগী ৰসে রয়েছে’’৷

‘মটকা’র তৃতীয় অর্থ হল ভাণ বা অছিলা৷ ‘‘চেয়ে দেখ, মনে হচ্ছে ও ঘুমুচ্ছে, আসলে কিন্তু ঘুমুয়নি, মটকা মেরে পড়ে আছে৷ যে ঘুমায় তাকে ডেকে বা ধাক্কা দিয়ে তোলা যায় কিন্তু যে মটকা মেরে পড়ে থাকে তার ঘুম ভাঙ্গানো যায় না’’৷

হ্যাঁ, যদি কেউ কোনো জায়গায় ঢুকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে বা নিজ উদ্দেশ্য চেপে রেখে চুপ করে একটা জায়গায় গিয়ে ৰসে থাকে তাকেও বলে ঘাপটি মারা–ভাল ৰাংলায় ‘গাত্রসংকোচী’, কথ্য ৰাঙলায় ‘ভিজে ৰেড়ালটি’৷

আয় চৈতালী ঝড়

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

আয় বসন্ত, আয় দুরন্ত, আয় চৈতালী ঝড়

আয়রে ভীষণ, আয়রে ভয়াল, আয়রে ভয়ংকর!

আনরে কাঁপন জীর্ণ শাখায়,

আনরে মরণ শুষ্ক পাতায়,

আনরে মাতন সবুজ পাতায়--- হানরে অসুন্দর!

আয় বসন্ত, আয় দুরন্ত, আয় চৈতালী ঝড়!

আয় ভাঙনের জয়গান গেয়ে, আয় মহা তাণ্ডবে,

এক ঘেয়েমির সুর-তাল কেটে আয় হত গৌরবে৷

আয় ধবংসের ডঙ্কা বাজিয়ে,

আয় সৃষ্টির অর্ঘ্য সাজিয়ে,

নবীন আশার পুলক জাগিয়ে আয় নতুনের চর!

আয় বসন্ত, আয় দুরন্ত, আয় চৈতালী ঝড়!!

ভুমাদর্শ

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

একই পিতার পুত্র কন্যা

মানব মোদের এই পরিচয়

অন্য কিছু নাই৷

একই আকাশ একই বাতাস

যোগায় সবে বল

অভিন্ন এক হৃদিধারায়

আমরা উচ্ছ্বল৷

একই রণন---মাতিয়ে প্রাণে

টানছে একই পানে

সঞ্জীবীত আমরা সবাই

একের অভিধ্যানে৷

জীবন মরণ তুচ্ছ করি

গড়ি মোরা সমাজ

অসীম অপার ভালবাসায়

চাহি একের রাজ৷

বসন্ত-প্রকৃতি

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

কাঁপন ধরা মাঘের শেষে

 বসন্তের আগমন,

চেয়ে নীহারিকা আকাশের রাকা

 মুখরিত উপবন৷

কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া

 মেতেছে আজ রঙের খেলায়,

অজ্ঞাত কার কোমল ছোঁয়ায়

 সুপ্তি ভাঙ্গল দূর অবেলায়!

সম্ভাবনাময় কুঁড়ি গুলি চায়

 পূর্ণ প্রস্ফুটন,

বসন্তের একান্ত অভিপ্রায়

 হোক রূপায়ণ৷

 

করবী-কামিনী নয় অভিমানী

 বসন্তে তারা হাসে,

আজ মধুমাসে চৈতি হাওয়ায়

 ফুলের সুরভী ভাসে৷

অশোকে-পলাশে কি উচ্ছ্বাসে

 রঞ্জিত করে বন,

কাঞ্চন বনে কোকিলের গানে

 আবিষ্ট তনু মন৷

নব কিশলয় সবুজ ভূষণে

 উজ্জীবিত উদ্যান,

পাতা ঝরে যাওয়া শীতের তরু

 ভুলে গেছে অভিমান!

অলি-প্রজাপতি বাসন্তী অতিথি

 বকুলের আবাহনে,

সৌরভ তার মৃদু সমীরণে

 বয়ে আনে বাতায়নে৷

 

মাধবীলতার গোপন কথা

 শুনিতে আসে ভ্রমর,

শিমুল-পারুল স্বাগত জানাতে

 খুলিয়া রেখেছে দোর৷

রঙের খেলায় ফুলের মেলায়

 পূর্ণিমা চাঁদ হাসে,

মধুপ-গুঞ্জরণ পুলকিত মন

 মহুয়া ফুলের বাসে৷

আম্রমুকুলে ঢেকেছে রসাল

 জগৎ জোড়া সুনাম,

বৈভবে ভরা ঋতুরঙ্গে ধরা

 স্রষ্টাকে জানাই প্রনাম৷