অধ্যাপক ভাস্কর পুরকায়স্থ স্মরণে

লেখক
আচার্য রবীশানন্দ অবধূত
Bhaskar Babu

অধ্যাপক ভাস্কর পুরকায়স্থের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১১ সাল থেকে৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান  ডঃ দিলীপ হালদার আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ভাস্কর পুরকায়স্থের সঙ্গে৷ ২০১১ সালের জুন মাসে আনন্দ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে  একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল মৌলালী যুবকেন্দ্রে৷ সেই সভায়  অধ্যাপক পুরকায়স্থ বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন৷ তিনি প্রাউটের  সমবায় পদ্ধতির অভিনবত্ব ও সদবিপ্রতন্ত্র সম্পর্কে  বক্তব্য রেখেছিলেন৷ সেই সময়  তিনি দক্ষিণ কলকাতার  হেমেন্দ্রচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক ছিলেন৷ তখন তিনি প্রাউটের  সমস্ত প্রোগ্রামেই  আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করতেন ও বক্তব্য রাখতেন৷ একটু সুযোগ পেলেই প্রাউট দর্শনের সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনা সভায় আমরা  সাধারণত পরম শ্রদ্ধেয় গুরুদেব শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীকে দার্শনিক  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার হিসেবেই  অভিহিত করি৷ কিন্তু এটাকে ডঃ ভাস্কর পুরকায়স্থ  পছন্দ করতেন না৷ একদিন তিনি আমাকে বলেই ফেললেন যে, এতবড় একজন পরম শ্রদ্ধেয় মহান গুরুকে নাম ধরে সম্বধন করা ঠিক নয়, তাঁকে পরম শ্রদ্ধেয়  গুরুদেব শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে সর্বত্র অভিহিত করতে হবে৷ এটাই ছিল তাঁর অভিব্যক্তি৷

একদিনের একটি কথা উল্লেখ না করে পারছিনা, সম্ভবত কল্যাণীতে আয়োজিত প্রাউটের আলোচনাসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলাম৷ সঙ্গে ছিলেন আমার আচার্য সুগতানন্দ অবধূত ও ডঃ দিলীপ হালদার ৷ প্রাউটের নানা বিষয় ও বর্তমান সামাজিক অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছিল৷  আলোচনা চলাকালীন ভাস্করবাবুর একটা মন্তব্য থেকে বুঝতে পারলাম যে তিনি শুধু প্রাউটের  সভা, আলোচনা ইত্যাদিতে শুধু তাত্ত্বিক ক্লাস নেন না৷ প্রাউট তত্ত্বটাকে নিজের জীবনে  কী করে ফুটিয়ে তোলা যায় সেটা তার মনকে তোলপাড় করত৷ তিনি  বলেছিলেন, ‘‘আমি যখন সকালে বাজার করতে যাই তখন আমি লক্ষ্য করে দেখি যে আমাদের সঙ্গে  সাধারণ মানুষের অর্র্থৎ যারা বিশেষ করে  শাকসব্জি বিক্রি করতে এসেছে, তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক একটা বড় ব্যবধান রয়েছে, যা প্রাউটের দৃষ্টিকোণ থেকে  বাঞ্ছনীয় নয়’’৷ প্রাউটের  অর্থনৈতিক  ব্যবস্থায়ও মানুষে মানুষে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য থাকবে, কিন্তু কখনো বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার  মত আকাশ-পাতালের পার্থক্য থাকবে না৷ বর্ত্তমানে ভারতের প্রথম সারির পাঁচজন সিইও-র বাৎসরিক  বেতন যথাক্রমে  ১)৫৯.৮৯,২)৫৯.৮৯,৩) ৫৮.৯৮ কোটি,৪)৪৯.৬২, ৫)৩২.৮০ কোটি টাকা৷ আর আমাদের দেশের  একজন  পরিচারিকার  মাসিক আয় দু’হাজার টাকা৷ উইকিপেডিয়ার  অর্থনৈতিক  সমীক্ষায় ভারতের  বি.পি.এল ভুক্ত একজন নাগরিকের  বাৎসরিক আয় মাত্র ২৭ হাজার টাকা৷

এই অমানবিক অর্থনৈতিক বৈষম্য এটা ভাস্করবাবুকে ভীষণভাবে নাড়া দিত৷ ভাস্করবাবু হেমেন্দ্র চন্দ্র কলেজ থেকে শিবপুর  দীনবন্ধু ইনস্টিটিউটের (কলেজ) অধ্যক্ষ হিসেবে কার্যভার  গ্রহণ  করেন ও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওখানেই  কর্মরত ছিলেন৷ দীনবন্ধু কলেজ থেকে ফ্লাইওভার হয়ে  এলে  খুব কম সময়ে  আমাদের তিলজলাস্থিত আশ্রমে  আসা যায়৷  কলকাতায় থাকলে  তিনি মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ফেরার  পথে  আমাদের আশ্রম হয়ে যাদবপুরে বাড়ি ফিরতেন৷

একদিন  কথা প্রসঙ্গে  তিনি বললেন, দেখুন এই আপনাদের  আশ্রম ছাড়াও  নানা কারণে ও কাজে অন্যান্য  আরও দুই-একটি আশ্রমে যাই৷ এছাড়া এক-দুটো রাজনৈতিক  দলের  নেতৃস্থানীয়রা মাঝে মধ্যে ওদের শিক্ষামূলক কর্মসূচীতে  আমাকে ডাকে৷ আমার সুযোগ  হলে  ওদের  প্রোগ্রামে যাই৷ কিন্তু আপনাদের সঙ্গে এদের একটি মৌলিক পার্থক্য আমি সর্বদাই লক্ষ্য করেছি, কোনো মিশন বা সংঘটনেরই আপনাদের মতো সুস্পষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই৷ দ্বিতীয়ত কারোর মধ্যেই  নিঃস্বার্থ মানব কল্যাণের কোন পরিকল্পনা নেই৷ সেদিন ভাস্কর বাবুর মুখে  আমাদের  সংঘটন সম্পর্কে  তাঁর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন শুণে খুবই  গর্ববোধ হচ্ছিল৷ তখন তিনি আরও একটি মর্মস্পর্শী কথা বললেন---শুনুন আমার এক অন্তরের  কথা আপনাকে বলছি, আমি অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে লক্ষ্য করেছি যে, আমি যখন অন্যান্য সংঘটন---সে ধর্মীয় সংঘটনই হোক আর রাজনৈতিক সংঘটনই হোক---ওদের সঙ্গে মেলামেশা করতে থাকি, তখন আমি লক্ষ্য করেছি যে আমার মন ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকে৷ আমি যেন ক্রমশঃ স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি৷ এই বোধটা আমার মনে ক্রমশঃ জাগতে থাকে---তখনই আমি ভাবি যে, না এটাতো পথ নয় আর তখনই আমি আপনাদের আশ্রমে ছুটে আসি, আর আমি এও লক্ষ্য করেছি যে আপনাদের সংস্পর্শে এলেই আমার মন অনেক ওপরে উঠে যায়৷ মনের শক্তি বেড়ে যায়৷ ভাস্করবাবু চাইতেন, প্রতিমাসেই যেন  প্রাউটের কিছু কর্মসূচী থাকে যাতে তিনি  অংশগ্রহণ করতে পারেন৷ গত ২০১৬সালে ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি ত্রিপুরায় কিছু প্রোগ্রাম করতে অনুরোধ করেছিলেন৷ সেই অনুযায়ী আমি এপ্রিল মাসে চারটি সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেছিলাম ত্রিপুরার বিভিন্ন শহরে৷ যথা সময়ে ভাস্করবাবু, ওঁর স্ত্রী অদিতি পুরকায়স্থ , তাঁর একমাত্র কন্যা অভিষিক্তা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের  তৎকালীন অধ্যাপিকা  ডঃ উমা চট্টপাধ্যায়সহ আমরা ত্রিপুরায় পৌঁছে পর পর  ৪টি সিম্পসিয়ামে অংশগ্রহণ করলাম৷  সেই সময় একটানা ৪দিন একসঙ্গে থাকায় অনেক বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অনেক আলোচনা হল৷ ওইসময় বাবার দর্শন, সংঘটন, তাঁর কর্মপদ্ধতির অভিনবত্ব, সর্র্বেপরি বাবার বিরাট ব্যষ্টিত্ব ইত্যাদির কথা শুণে সবাই খুবই অভিভূত হলেন৷ ডঃ উমা চট্টোপাধ্যায় তখনই সাধনা পদ্ধতি শিখতে চাইলেন, কিন্তু নিয়মাবলীর জন্যেই আমি তাঁকে এব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারিনি৷ ডঃ ভাস্কর পুরকায়স্থ কলকাতায় ফিরেই আমাকে ফোন করলেন যে আমি সাধনা শিখতে চাই৷ তারপর ওই এপ্রিল মাসেই একটি শুভদিনের সুপ্রভাতে তিনি আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতি শিখলেন৷ তারপর থেকে রবিবারগুলোতে প্রায়ই  ধর্মচক্রে যোগ দিতে তিলজলাস্থিত ধ্যানমন্দিরে আসতেন৷ বাবার মহাপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কীর্ত্তন প্রোগ্রামেও  তিনি নিয়মিত যোগ দিতেন৷ এছাড়া তাঁর পরিচিত সমস্ত দাদা দিদিদের সুখে দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা তিনি বরাবরই করতেন৷ আমি আর ইয়ূর পক্ষ থেকে যে জার্র্নলটি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি এর প্রস্তাবকও তিনি৷ সম্প্রতিকালে তিনি তার কলেজে অশান্ত তথা সুস্থ পরিবেশের অভাব জনিত কারণে গত কয়েকমাস যাবৎ ভীষণভাবে মানসিক দিক দিয়ে বিধবস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ একদিকে অধ্যক্ষের কর্ত্তব্য, কলেজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আর অন্যদিকে সুষ্ঠু পরিবেশ তথা কর্মসংসৃকতির অভাব তাঁর মানসিক শান্তি ও রাতের সুনিদ্রা কেড়ে নিয়েছিল৷ প্রায়ই তিনি অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তাফা দেওয়ার কথা ভাবতেন৷ আমাকে প্রায়ই বলতেন আপনারা কলকাতায় কোথাও একটা কলেজ করুন, আমি সেখানে মনের মতো করে কিছু কাজ করতে চাই৷ তিনি কিছু করতে চাইতেন কিন্তু সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবে তাঁর ইচ্ছে তার স্বপ্ণেই রয়ে গেলো৷

তিনি গ্যাংটক কলেজ থেকে চাকুরী ছেড়ে কলকাতা চলে এসেছিলেন অনেক আশা নিয়ে, আরও  বড় কাজ করতে, আরও বেশি কাজ করতে ৷ কিন্তু কলকাতার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে  নৈরাজ্য তাঁর স্বপ্ণকে চিরনিদ্রায় শায়িত করে দিয়েছে৷ গত ২৬শে মে ২০১৮ রাত প্রায় ১টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷ প্রকৃতপক্ষে ভাস্করবাবুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, অশুভ পরিবেশের প্রচণ্ড চাপ তাঁকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে৷ গত ২১শে মে তাদের বাড়ীতেই তার সঙ্গে আমাার শেষ দেখা ৷ তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল সপরিবারে আনন্দনগর পরিদর্শন করার৷ এবারের ধর্মমহাসম্মেলনে একান্তভাবেই তিনি আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নানা কারণে তাঁর এই শুভ ইচ্ছা পূর্ণ হ’ল না৷ পরমপিতার অসীম কৃপায় ভাস্কর পুরকায়স্থের অমর আত্ম  উত্তরোত্তর  প্রসার লাভ করুক--- এটাই আমাদের সকলের আন্তরিক কামনা৷