প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া৷* আধ্যাত্মিক প্রগতি তিনটি তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল–প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ, সেবা৷ ‘প্রণিপাত’ মানে এক অদ্বিতীয় শাশ্বত সত্তা পরমপুরুষের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ৷ এক্ষেত্রে সাধকের মনোভাব হচ্ছে এই যে বিশ্বের যা কিছু সবই পরমপুরুষের, আমার বলতে কিছু নেই৷ এটা হ’ল প্রণিপাত৷ আর যার অহংৰোধ রয়েছে, যে ভাবছে তার বিদ্যা–ৰুদ্ধি, ধন–সম্পত্তি বা অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তার বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি, সে সবচেয়ে ৰড় মূর্খ৷
কোন কোন মানুষ তার শিক্ষা–দীক্ষা, ৰুদ্ধি–বৃত্তি, সৌভাগ্য নিয়ে খুব ৰড়াই করে কিন্তু এই পৃথিবীর কোন কিছুই তো চিরন্তন নয়৷ কাজেই যে মানুষ কোন পার্থিব জিনিস নিয়ে ৰড়াই করে সে তো মূর্খ৷ সব চেয়ে খারাপ মানসিক ৰন্ধন হচ্ছে মিথ্যা অহংকার, কারণ এই বিশ্বের সব কিছুই পরমপুরুষের, আমার বলতে কিছুই নেই৷ তাই পরমপুরুষের কাছে মানুষের ষোল আনা আত্মসমর্পণ করা উচিত৷ মানসিক অগ্রগতির জন্যে এটা হ’ল এক অপরিহার্য সর্ত্ত৷
যদি সত্যি সত্যি জগতের সেবা করতে চাও তবে পরমপুরুষের পাদমূলে আত্মসমর্পণ করতেই হবে৷ অর্থাৎ সেই শাশ্বত সত্তা পরমপুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হ’ল প্রণিপাত৷ এই সৃষ্ট জগতের সত্যিকারের মালিক হলেন পরমপুরুষ৷ এখানে যা কিছু কর্মধারা সবই তাঁর৷ আমরা সেই পরমপুরুষের মাধ্যম মাত্র৷ আমাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যদি সেই কাজটা আমি না করি তিনি অন্যকে দিয়ে তা করিয়ে নেবেন৷ তাই কোন কাজ করার আগে আমাকে অতি অবশ্যই এই ভাবনা নিতে হবে যে, পরমপুরুষ কৃপা করে আমার মাধ্যমে তা করিয়ে নিচ্ছেন৷
জীবিতকালে ষাঁড়কে সচরাচর দেখে থাকবে মাঝে মাঝে সে গর্জন করে বলছে, ‘হম্ম’ অর্থাৎ আমি....আমি....আমি৷ কিন্তু তার মৃত্যুর পর তারই চামড়ার সূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে তৈরী ধুনুরী থেকে ধ্বনি বেরিয়ে আসছে কেবল তু....তু....তু (তুমি....তুমি....তুমি)৷ তাই সর্বদাই মনে রাখতে হবে, আমি কোন কিছুই করছি না....স্বয়ং পরমপুরুষই সব কিছু করে চলেছেন৷ আর এসব করার সময় ব্যষ্টি সত্তা হিসেবে মানুষের মায়াজালে জড়িয়ে পড়া উচিত নয়৷ কারো পক্ষে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, পদমর্যাদা, সৌন্দর্য, সম্মান, বিত্ত, অর্জিত জ্ঞান কোন কিছুর জন্যেই অহংকার করা চলবে না৷ সর্বদাই মনে রাখতে হবে–এই সব কিছুর মালিক হলেন পরমপুরুষ, আমার বলতে কিছুই নেই৷
‘পরিপ্রশ্ণ’ বলতে সেই সমস্ত প্রশ্ণকে ৰোঝায় যার উত্তর জেনে মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়৷ পাণ্ডিত্য জাহির করলে বা এই ধরনের প্রশ্ণের জন্যে প্রশ্ণ করলে মানুষের সময় ও শক্তির অযথা অপচয় ঘটে থাকে৷ ওগুলো একেবারে বাজে জিনিস৷ পরিপ্রশ্ণ ছাড়া অন্য কোন প্রশ্ণ থাকা উচিত নয়৷ পরিপ্রশ্ণ ব্যতিরেকে অন্য কিছু প্রশ্ণ করলে তাতে মানুষের শুধু সময় ও শক্তির অপচয় হয়৷
‘সেবা’ মানে নিঃস্বার্থ সেবা৷ যথার্থ সেবা তখনই সম্ভব যেখানে প্রতিদানে কোন কিছু পাওয়ার অভিলাষ থাকে না৷ যেখানে কোন কিছু দিতে গিয়ে কোন কিছু পাবার বাসনা থাকে তাকে সেবা বলব না–বলব ব্যবসায়৷ যেখানে দেওয়া–নেওয়ার প্রশ্ণ সেটাকে ব্যবসায় বলে৷ অনেক সময় অনেক সংবাদপত্রের স্তম্ভে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে–/অমুক সাল থেকে আপনাদের সেবায় নিয়োজিত৷* –না, এটা সেবা নয়, এটা ব্যবসা কারণ এক্ষেত্রে বিক্রেতা কিছু না নিয়ে কিছু দিচ্ছে না৷ সেবার ক্ষেত্রে দেওয়াটাই ৰড় কথা, নেওয়ার প্রশ্ণ ওঠে না৷ যদি কেউ কিছু দান করে আর মনের মধ্যে ভাবনা থাকে যে প্রতিদানে কিছু দিলেও নোব না৷ সেটাই হ’ল সেবার সার কথা৷
একটা শব্দ আছে যা প্রায়শই ভক্তরা বলে থাকেন তা হ’ল প্রপত্তি৷ ‘প্রপত্তি’ মানে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ৷ অর্থাৎ ভাবটা এই যে সেই চরম দৈবী সত্তা পরমাত্মাই সব কিছু করছেন, মানুষ কিছু করছে না৷ পরমপুরুষের ইচ্ছাতেই সব কিছু হচ্ছে৷ পক্ষান্তরে ‘অপ্রপত্তি’ মানে সেই ধরনের মানসিকতা যেখানে মানুষ ভাবছে যে ব্যষ্টি মানুষই সব কিছু করছে, পরমপুরুষ করছেন না৷
প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ, সেবা–এই তিনটি তত্ত্বকে মেনে চললে মানুষের আধ্যাত্মিক প্রগতি হবেই৷ এছাড়া অন্য কোন কিছু তোমার উপকারে আসবে না৷ মনে রেখো, অতি স্বল্পকালের জন্যেই তুমি এই পৃথিবীতে এসেছ৷ তাই তোমার সময় ও সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করো, মনের মধ্যে যথার্থ সেবার মনোভাব পোষণ করে জগতের সেবা করে যাও জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সকল স্তরে সর্বাত্মক সেবার কাজ চালিয়ে যাও৷
(পটনা, ১০ই অগাষ্ট, ১৯৭৮)