কাল বলেছিলুম যে, মানুষ কোন অবস্থাতেই পশু হতে পারে না৷ ঈশ্বরসৃষ্ট বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে একটা শাখা হ’ল মানুষ, একটা হ’ল উদ্ভিদ, আর একটা হ’ল পশু৷ পশুর মধ্যেও আবার স্তরবিন্যাস আছে, উদ্ভিদের মধ্যেও স্তরবিন্যাস আছে৷ সব উদ্ভিদ সমান নয়৷ সব পশুও সমান নয়৷ আবার মানুষেরও স্তরবিন্যাস আছে৷
‘‘সর্বে চ পশবঃ সন্তি তলবদ্ ভূতলে নরাঃ৷
তেষাং জ্ঞান প্রকাশায় বীরভাবঃ প্রকাশিতঃ
বীরভাবং সদা প্রাপ্য ক্রমেণ দেবতা ভবেৎ৷৷’’
প্রত্যেকটি মানুষ জন্মের পর কিছুকাল পশুর মতই থাকে৷ তখন তার বুদ্ধি তৈরী হয় না৷ আর যেহেতু বুদ্ধি-বিবেক তৈরী হয় না, তাই সে সব দিক দিয়ে পশুর মত৷ সেই জন্যে আমরা বলি--- শিশু অন্যায় করছে, ওকে ছেড়ে দাও, কিছু বলো না, ক্ষমা করে দাও৷ তার কারণ, বুদ্ধি-বৃত্তি কিছু জাগেনি তখনো৷ এমনকি খুব হাসির কথা, শিশু মল-মূত্র ত্যাগ করলেও ঘেন্না হয় না৷ তারপরে মানুষ যখন একটু বড় হ’ল, যখন তার বিবেক জাগল তখন সেই ছোট্ট শিশুটি তার দিদির নাম ধরে ডাকে৷ তখন শুনতে ভাল লাগে কিন্তু তার পর যখন শিশুটি বড় হয়ে যায়, তখন দিদিরও ভাল লাগে না, বাড়ীর লোকেরও ভাল লাগে না৷ তখন দিদি বলে দেন, ‘‘অন্য সময় আমাকে নাম ধরে ডাকিস, কিছু বলবো না, কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ীতে যখন যাবি, তখন দিদি বলে ডাকবি’’৷ তেমনি মানুষ যখন একটু বড় হ’ল তখন তার অপরাধকে লোকে ক্ষমাক চোখে দেখে না, উচিত নয়৷ তাই যখন তার জ্ঞান-বুদ্ধি হ’ল তখন তাকে বৈদিকী দীক্ষা দেওয়া হ’ল৷ এই দীক্ষাটার মানে হ’ল, তুমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, ‘‘হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে ঠিক রাস্তাটা দেখাও’’৷ এখন রাস্তা যখন তুমি চাইছ, তখন রাস্তা তো পাবেই৷ যেমন আমাদের গায়ী মন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘‘ওঁং ভূ ভূবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্র্গে দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং’’ অর্র্থৎ হে পরমপুরুষ, তুমি আমার বুদ্ধিবৃত্তিকে ঠিক পথে চালাও, ঠিক রাস্তায় নিয়ে চলো৷ এই বৈদিকী দীক্ষা দেওয়ার পর ধরে নিতে হবে, তার একটু আক্কেল হয়েছে৷ তখন তাকে দেওয়া হবে তান্ত্রিকী দীক্ষা অর্র্থৎ তাকে ইষ্টমন্ত্র, গুরুমন্ত্র দেওয়া হবে৷
অতঃপর মানুষটা যেন একেবারে নোতুন মানুষ হয়ে যায়৷ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার পর ঈশ্বরই ইষ্টমন্ত্রটা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন৷ কারণ তিনিই তো দীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দেন৷ তিনি হলেন গুরু৷ গুরুই ঈশ্বর, ঈশ্বরই গুরু৷
যখন সে সাধনা মার্গে আসেনি, তখন সে ছিল পশুর সমান৷ শরীরটা মানুষের চিন্তাটা পশুর, সেই সময় সেই আকুতি সহকারে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ‘‘আমাকে পশুজীবন থেকে উন্নীত করো, প্রকৃত রাস্তা দেখাও’’৷ সেই অবস্থায় সে ভগবানকে ডাকে পশুপতি বলে৷ অর্র্থৎ জীবের কাছের তখন ঈশ্বরের নাম পশুপতি, পশুর মালিক--- শিবের এক নাম পশুপতি৷
মানুষ যখন সাধনামার্গে আসে, তখন চারিদিক থেকে বাধা বিপত্তি আসে৷ বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়, বন্ধু বান্ধবেরা বাধা দেয়, নানান দিক থেকে নানাধরণের বাধা আসে ও সে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যায়৷ লড়াই করলে তো জয় হয় না, বিনা লড়াইয়ে কখনও কি কারও জয় হয়? এখন এই যে লড়াই ইে লড়াইটা করে কে? যে বীর সেই লড়াই করে৷ তখন তার আর পশুভাব থাকে না, তখন তার বীরভাব৷ তখন সে ঈশ্বরকে, পরমাত্মাকে ‘বীরেশ্বর’ বলে সম্বোধন করে বলে, ‘‘হে পরমপুরুষ, আমি বীর, তুমি বীরেশ্বর, তুমি আর পশুপতি নও’’৷
‘‘বীরভাবং সদা প্রাপ্য ক্রমেণ দেবতা ভবেৎ’’৷ কারণ, তখন তো সে আর পশু নয়৷ আর এই বীরভাবে যখন সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল অর্র্থৎ কোন পাপ, কোন অনাচারকে সহ্য করা যখন তার স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে গেল, স্বাভাবিকভাবে অন্যায় করবে না, অন্যায় সহ্য করবে না--- এটা একটা স্বভাব হয়ে গেল, ‘ক্রমেণ দেবতা ভবেৎ’৷ এই বীরভাব থেকে ধাপে ধাপে সে দেবত্ব লাভ করে, সে দেবতা হয়ে যায়৷ এই যে ভাব এর নাম দিব্যভাব৷ যে মানুষ, তার আচরণ দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে, তাকে আমরা বলি শিব্যতুল্য মানুষ, দেবতুল্য মানুষ অর্র্থৎ সে তখন ওপরে উঠছে৷ এই ওপরে উঠতে উঠতে একদিন পরমপুরুষে লীন হয়ে যায় পরমপুরুষই হয়ে যায়৷
এই হ’ল ধাপগুলো৷ এখন মানুষ মাত্রেই যে খুব উঁচুস্তরের, তা নয়৷ তবে উঁচুস্তরে ওঠবার সম্ভাবনা তার মধ্যে রয়েছে৷ এই সম্ভাবনাটার যে কাজে লগায় সে-ই দ্ধিমান যে কাজে লাগায় না সে পশুর বিচার-বুদ্ধি নেই, তাই সে বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ না করে, আধ্যাত্মিকতার পথে না যায়, তা হলে সে অবশ্যই পশুর তুল্য৷ কোন মানুষই যাতে সে ভুলটা না করে, সেজন্যে প্রতিটি সাধকের উচিত ধর্মপ্রচার করা, অন্যের মধ্যে প্রেরণা জাগিয়ে দেওয়া৷ এটা আমাদের স্বভাবধর্ম৷
(৬ নভেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সকালবেলা)