অগ্ণিযুগের বীর শহীদ ক্ষুদিরাম স্বদেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের চিরকালীন বহ্ণিশিখা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

‘‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী৷৷’’

এই গানটি শুণলে বাঙালী মাত্রেরই ধমনী-শিরা দিয়ে বয়ে যায় উষ্ণ শোণিতের দুরন্ত প্রবাহ, স্নায়ুতন্ত্রীতে জেগে ওঠে এক উদ্বেলিত শিহরণ, স্বদেশপ্রেমের উদ্দাম নির্ঝরিণী ধারায় হৃদয় মন হয় আপ্লুত৷ এই গানটির সঙ্গে শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর নাম ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়ে সমার্থক হয়ে উঠেছে৷ চোখের সামনে মূর্ত্ত হয়ে ওঠে ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত বালক ক্ষুদিরামের হাসতে হাসতে ‘বন্দেমাতরম্’ ধবনির সঙ্গে ফাঁসির দড়িকে চুম্বন ও আলিঙ্গন করার অপরূপ ছবি৷ ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জেলা মেদিনীপুরের হবিবপুরে৷ পিতার নাম ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও মাতা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী৷ লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা অপরূপার পর দুই পুত্রের অকাল মৃত্যু ঘটে৷ ফলে পরবর্তী পুত্রের জন্মের পর তিনি কন্যা অপরূপার কাছে তিন মুঠো ক্ষুদের বিনিময়ে নবজাতককে বিক্রি করে দেন৷ সেই কারণে শিশুর নাম রাখা হয় ক্ষুদিরাম৷ কিন্তু এমনই ভাগ্য যে, মাত্র ছয় বছর বয়সে ক্ষুদিরাম মাতা ও পিাতাকে ছয় মাসের ব্যবধানে চিরদিনের মত হারান৷ ফলে তাঁকে অগ্রজা অপরূপা ও ভগ্ণীপতি অমৃতলাল রায়ের আশ্রয়েই প্রতিপালিত হতে হয়৷ ক্ষুদিরাম প্রথমে গ্রামের পাঠশালার পর তমলুকের হ্যামিলটন সুকল ও শেষে মেদিনীপুর কলেজিয়েট সুকলে লেখাপড়া করেন৷

ছোটবেলা থেকেই ক্ষুদিরাম ছিলেন ছটফটে, ডানপিটে, একরোখা, অসমসাহসী ও পরোপকারী  স্বভাবের৷ লেখাপড়ার থেকে গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, লাঠিখেলা, ব্যায়াম অনুশীলন, অন্যের কষ্ট লাঘবের জন্যে যথাসাধ্য করার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশী৷ তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই পরবর্তী জীবনে বিপদসংকূল পথে এগিয়ে চলার ভিত গড়ে দিয়েছিল৷ মেদিনীপুর কলেজিয়েট সুকলে পড়ার সময় কিশোর ক্ষুদিরামের মনে ইংরেজ শাসকবর্গের অত্যাচার ও নিপীড়নে বাঙালী তথা ভারতবাসীর কষ্ট গভীর ছাপ ফেলতে থাকে৷ তিনিও ক্রমশঃ স্বদেশী আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন৷ এইসময় আসে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ৷ লর্ড কার্জনের বাঙলা ভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালী প্রতিবাদে গর্জে ওঠে৷ বিদেশী পণ্য সামগ্রী ও বস্ত্র বর্জন, পিকেটিং, স্বদেশী আন্দোলনের জন্য গুপ্ত সমিতিগুলির সভা-সমিতিতে যোগদান ও যুব সম্প্রদায়কে সংঘটিত করার জন্যে ক্ষুদিরাম আত্মনিয়োগ করেন৷ মেদিনীপুর কলেজিয়েট সুকলের প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত রাজনারায়ণ বসুর ভাইপো সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের দক্ষ সংঘটক৷  তাঁদেরই নেতৃত্বে পরিচালিত ‘আনন্দমঠ’ নামক গুপ্ত সমিতির সদস্য হিসেবে যোগদান করে এক হাতে গীতা ও অন্য হাতে তরবারি নিয়ে দেশমাতৃকার সেবার গুপ্তমন্ত্রে দীক্ষিত হন৷ সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্গম পথে পদচারণা৷ সংঘটনের কাজে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, কলকাতা ও অন্যান্য জায়গায় তিনি ঘুরে ঘুরে গুপ্তসমিতিগুলির মধ্যে যোগসূত্র রচনা করতে লাগলেন৷ এই সময় অরবিন্দ ঘোষ, বারীণ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দের জ্বালাময়ী ও উদ্দীপক ভাষণে তিনি হয়েছিলেন আরও অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত৷ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে ঘিরে যে দুর্বার বিদ্রোহ সংঘটিত হয় সেই বিপ্লবের দাবানল ক্রমশ বাঙলার সীমানা পেরিয়ে অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে৷ এর সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনকারীদের ওপর ব্রিটিশ শাসককুলের অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রাও বাড়তে থাকে৷ ইংরেজদের সাথে যুক্ত হয় স্বদেশী পুলিশ ও গোয়েন্দা আধিকারিকরাও৷ অপরদিকে সশস্ত্র বিপ্লবী দলও এই সব অত্যাচারীদের শাস্তি দিতে বোমা, পিস্তল ও অন্যান্য আগ্ণেয়াস্ত্র নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর ওপর চড়াও হয়৷ এই পরিস্থিতিতে ১৯০৮ সালের ১৮ই এপ্রিল ঊধর্বতন নেতৃত্বের আহ্বানে কলকাতার মানিকতলায় অন্যতম মাতৃমুক্তি-সংগ্রাম-সৈনিক প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে মিলিত হন তৎকালীন কুখ্যাত ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ডকে চরম শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে৷ এই কিংসফোর্ড তখন মজঃফরপুরে কর্মরত ছিলেন৷ তিনি বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাধারণ নাগরিকদের ওপরে অকথ্য অত্যাচার ও বিচারের প্রহসনের নায়ক ছিলেন৷ প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু কলকাতা থেকে মজঃফুরপুরে এসে কিংসফোর্ডের গতিবিধির ওপরে নজর রাখা শুরু করেন৷ কিংসফোর্ড প্রতিদিন ইউরোপীয়ান ক্লাব থেকে রাত্রিবেলায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফিটন গাড়ী চড়ে বাসস্থানে ফিরে যেতেন৷ ক্রমে এগিয়ে এল সেই ব্রাহ্ম মুহূর্ত্ত---১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল৷ যথাসময়ে দুই নির্ভীক মুক্তি যুদ্ধের অক্লান্ত সৈনিক অপেক্ষা করতে লাগলেন পথের ধারের গাছের আড়ালে৷ ফিটন গাড়ীর শব্দ ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে লাগল---বিপ্লবীদ্বয়ও অস্ত্র হাতে তৈরী৷ ওই তো ফিটন গাড়ী এসেছে নাগালের মধ্যে---মাহেন্দ্রক্ষণ! অব্যর্থ নিশানায় আছড়ে পড়ল বোমা৷ বিকট শব্দ---আর্তনাদ---বারুদের ধোঁয়ার কটু গন্ধে ভরে গেল চতুর্দিক৷ কিন্তু সৌভাগ্য কিংসফোর্ডের, দুর্ভাগ্য বিপ্লবীদের৷ সেই দিন একই সময়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে যে ফিটন গাড়ী তার যাত্রী ছিলেন মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা৷ তাই বোমার লক্ষ্য অবর্থ হলেও কিংসফোর্ডের পরিবর্তে মারা যান দুই ইংরেজ মহিলা৷

লক্ষভেদ হয়েছে মনে করে তাঁরা দুই দিকে পালাতে থাকেন৷ ইতোমধ্যে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনীর তৎপরতায় মজঃফরপুর ও সন্নিহিত এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও নজরদারি শুরু হয়৷ যার ফলে ১লা মে মোকামা ঘাট ষ্টেশনে প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার আগে বিপ্লবী দলের গুপ্ত নির্দেশ মত নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন৷ অপরদিকে রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুদিরাম ওয়েইনী ষ্টেশনে এসে উপস্থিত হন৷ সেখানেই ওঁত পেতে থাকা গোয়েন্দাদের হাতে তিনি ধরা পড়েন৷ ধরা পড়ার আগে ধস্তাধস্তিতে রিভলবার মাটিতে পড়ে যাওয়ায় ক্ষুদিরাম গুলি চালাতে পারেননি, ফলে গ্রেফ্তার হতে বাধ্য হন৷ ১৯০৮ সালের ৭ই জুন মজঃফরপুরের অতিরিক্ত সেশন জজ ক্ষুদিরামকে ফাঁসির রায় শোনান৷ পরবর্তী পর্যায়ে হাইকোর্টও সেই রায় বহাল রাখে৷ শেষ পর্যন্ত ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট মঙ্গলবার সকাল ৬-টায় মজঃফরপুর কারাগারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর হয়৷ দেশের মুক্তি সংগ্রামে ফাঁসির মঞ্চে উঠে ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র উচ্চারণে তরুণ বিপ্লবীর কণ্ঠ একটুও কাঁপেনি৷ বরং শোণা যায় মৃত্যুর পূর্বে তিনি এতটাই উৎফুল্ল মেজাজে ছিলেন যে তাঁর শরীরের ওজন বেড়ে যায়৷

কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেও ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়নি৷ নিজ লক্ষ্যে অবিচল, কর্তব্যনিষ্ঠায় চূড়ান্ত দৃঢ়তা, দেশমাতৃকার চরণে আত্মোৎসর্গে সমুজ্জ্বল, সেবা ও ত্যাগের আদর্শে সদা তৎপর, ভারতের মুক্তি সংগ্রামের প্রথম তরুণ শহীদ ক্ষুদিরামের জীবন ও কর্ম বাঙলার লক্ষ লক্ষ তরুণ-যুবার -অন্তরে দেশপ্রেমের প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করে দিতে সমর্থ হয়েছিল৷ এরপর বাঙলা ও অন্যান্য রাজ্যের হাজার হাজার যুবা-কিশোর-তরুণ-তরুণী স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাসক ও শোষক ইংরেজদের অকথ্য অত্যাচার, গুলি-ফাঁসি-কারাবরণ ও অপরাপর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই আগষ্ট মাসেরই ১৫ তারিখে (১৮৭২ সাল) ভারত ও বাঙলার কৃতী সন্তান শ্রী অরবিন্দ ঘোষের জন্ম৷ তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন স্বদেশী আন্দেলনের ধারক ও বাহক৷ পরবর্তীকালে তিনি পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক মার্গের অনুসারী হয়ে পণ্ডিচেরীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ও ঋষি অরবিন্দ নামে পরিচিত হন৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম পর্যায়ে ১৯৪২ সনের ৯ই আগষ্ট ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সূচনা হয় ও এই আগষ্ট মাসেই (১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট) ভারত স্বাধীনতা লাভ করে৷ সুতরাং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আগষ্ট মাসের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ৷

যাইহোক, বহু আত্মত্যাগ, অত্যাচার, উৎপীড়ন ও প্রাণের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও দেশ ভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর রক্তে ভারতের মাটি রাঙা হয়ে গিয়েছিল৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে বাঙালী বিপ্লবীর দল সকলের চেয়ে বেশী বুকের রক্ত ঝরিয়েছে, ফাঁসি-গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছে, আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছে, অত্যাচার, নিপীড়নের শিকার হয়েছে---স্বাধীন ভারতে তাঁরাই পেয়েছে সবচেয়ে বেশী উপেক্ষা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও শোষণ-যন্ত্রণা৷ দেশভাগের কারণে উদ্ভূত উদ্বাস্তু সমস্যার ক্ষেত্রে পশ্চিম ভারতের পঞ্জাবে যে দ্রুততা ও সহানুভূতির সঙ্গে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে---পূর্ব ভারতের বাঙালীদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে বিস্তর৷ বাঙালী উদ্বাস্তুরা দশকের পর দশক থেকে গেছেন অবহেলিত, বঞ্চিত ও অমানুুষিক যন্ত্রণাময় পরিবেশে৷ এছাড়া সার্বিকভাবে বাঙালী জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পূর্বে ইংরেজ শাসনে যেমন শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছিল---স্বাধীনোত্তর কালেও একইভাবে হিন্দী বলয়ের বাদামী-আগ্রাসনের শিকার হয়েছে৷ বাঙলার ভূমিকে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত করে বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে৷ সেই সব রাজ্যে বাঙলা তথা বাঙালীর জাতি সত্ত্বা, ভাষা-সংসৃকতি বিকাশের সুযোগ না থাকার ফলে তারা নিজের মাতৃভাষা ভুলে যেতে বসেছে৷ বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় সংসৃকতির দিক থেকেও বাঙালীরা হচ্ছে অবদমিত ও আর্থ-সামাজিক তথা মানস-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষিত৷ বাঙালী আজ মাতৃভাষাহীন, মাতৃভূমিহীন, জাতিসত্ত্বাহীন উপেক্ষিত ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত৷

উপর্যুক্ত কারণগুলির ফলশ্রুতিতে অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর, ঝাড়খণ্ডে বাঙালীরা নিজ ভূমে পরবাসী, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত৷ শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রাজ্যে তাদের আদি বাস ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হলেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারীগুলির বিমাতৃসুলভ আচরণে আর তথাকথিত স্থানীয়দের (অহমিয়া, মণিপুরী, ত্রিপুরী ইত্যাদি) আগ্রাসনে স্বভূমি থেকে বিতাড়িত৷ বর্তমানে অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর দৌলতে প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালী বিতাড়নের আশঙ্কায় প্রহর গুণছেন---তাদের ভবিষ্যত এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত৷ এমতাবস্থায় বাঙালীদের নিজস্ব জাতিসত্তা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার রক্ষাকল্পে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই৷ এখনও যে সব বাঙালী নিজেদের সুরক্ষিত ভাবছেন---তাঁরাও চিরকাল নিশ্চিন্তে থাকবেন, তার কোনও নিশ্চিততা নেই৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংঘটন থেকে সব রাজ্যেই নাগরিকপঞ্জীর দাবী তোলা হচ্ছে---যার ফলে একমাত্র ভুক্তভোগী হওয়ার সম্ভাবনা বাঙালীদেরই৷ শহীদ ক্ষুদিরাম ও অন্যান্য বীর বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, দেশ ও স্বজাতির প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠা ও সেবার আদর্শকে সামনে রেখে সর্বস্তরের বাঙালীর সংঘবদ্ধ হয়ে সংগ্রামের সংকল্প নেওয়ার সময় এসেছে৷  কবির ভাষায়---

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান

আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান?

বীর বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মাষ্টারদা সূর্য সেন, অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী বসু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মত্যাগ, জীবনাদর্শ, কর্তব্যনিষ্ঠা, মানবসেবা ও দেশপ্রেমের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাঙালী কি এখনও সংগ্রাম বিমুখ হয়ে থাকবে? সত্য সত্যই আজ নিজেদের ভাষা-ভূমি-সংসৃকতি-জাতিসত্তা রক্ষার স্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক ও শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে অগ্ণিযুগের বীর সৈনিকদের সর্বস্ব ত্যাগের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালীদের সংকল্প গ্রহণ করতেই হবে৷ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ নয়---শুধুমাত্র বাঙালী, এই পরিচয়ে অখণ্ড বাঙলার মৈত্রী ও ভালবাসার সংসৃকতিকে অক্ষুণ্ণ্ রেখে দেশের সকল বাঙালীকে সংঘটিত সংগ্রামের দ্বারা স্বভাষা, স্বজাত্যভিমান, স্বাধিকারযুক্ত, শোষণমুক্ত স্বভূমি ‘বাঙালীস্তান’ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে---বাঙালীর সামনে এছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই৷ পরিশেষে স্মরণ করি সত্যদ্রষ্টা কবির অভয়বাণী---

উদয়ের পথে শুণি কার বাণী

ভয় নাই, ওরে ভয় নাই

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই৷