গয়া-মুগলসরাই জংশনের ব্যস্ততম সাসারাম রেল স্টেশন। এই স্টেশনের একটি বিশেষত্ব রয়েছে। এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের অনেকটা অংশ জুড়ে সকাল-সন্ধ্যা পড়াশোনা করেন বহু পড়ুয়া।সকালের দু’ঘণ্টা এবং সন্ধ্যায় দু’ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে বসেই পড়াশোনা করেন প্রায় ১২০০ পড়ুয়া।২০০২-২০০৩ সালের দিকে প্রথমে কয়েকজন ছাত্র স্টেশনে এসে পড়াশোনা শুরু করে। এরা মূলত প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। যেখানে বিদ্যুত্ পৌঁছয়নি এবং মোটা টাকা দিয়ে কোচিং সেন্টারে পড়ার ক্ষমতাও যাদের নেই তারাই স্কুল-কলেজের পড়া সেরে চাকরির জন্য এখানে এসে নিজেদের তৈরি করেন। সিনিয়ররা এখানে জুনিয়রদের সাহায্য করেন কোন পদ্ধতিতে এগিয়ে গেলে সুবিধা হবে বলে দেন। তাই এই সংখ্যাটা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। অনেকে তো এই স্টেশনের আলোয় সারারাত পড়বে বলে স্টেশনেই থেকে যান। এই সমস্ত পড়ুয়াদের সাহায্যে এগিয়ে এসে পটনা রেল পুলিশের সুপারিন্টেডেন্ট জিতেন্দ্র মিশ্র বেশ অভিনব একটা ব্যবস্থা করে দেন। পড়ুয়াদের জন্য তিনি নির্দিষ্ট পরিচয়পত্রেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই পরিচয়পত্র নিয়ে বিনা বাধায় ওই পড়ুয়ায়া প্ল্যাটফর্মে পড়াশোনা করতে পারেন। মোটকথা যেটা বলতে চেয়েছিলাম শিক্ষা ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিদিন প্রতিপদে আমাদের বাংলা পিছিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাংলা থেকে দুই দশক আগেও ঢের পিছিয়ে থাকা বিহার আজ গোটা ভারতবর্ষকে শিক্ষা ক্ষেত্রে পথ দেখাচ্ছে। বিহারী খান স্যারের অনলাইন কোচিং এর ফলোয়ার আজ প্রায় 2 কোটির বেশি ভারতীয়। ভারত বছরে ১০০ জন আইপিএস, আইএস পেলে তার সবথেকে বেশি অংশটাই বিহারের। এক আজব জাদুককাঠিতে বিহারের শিক্ষা ক্ষেত্রে নকশা বদলে গিয়েছে। কারণ সেখানকার শিক্ষা মন্ত্রী চুরি করে না। মুখ্যমন্ত্রী চোরদের নিরাপত্তা দেয় না। সাংবাদিক মলয় দাসের একটা লেখা পড়ছিলাম, দুর্দান্ত লিখেছেন ভদ্রলোক। বাঙালির উৎসব প্রীতি এবং ভিক্ষার দানে মেতে থাকার আনন্দ বাঙালিকে আজ মাটিতে আছড়ে ফেলছে। বেশিদিন নেই যেদিন বাঙালি তার মেধা সম্পূর্ন ত্যাগ করে বিহার কর্ণাটকের ঘরে ঘরে শ্রম ফেরি করতে বেরোবে। শিক্ষা সমাজের মেরুদন্ড তৈরি করে। সেই মেরুদন্ড যখন ভেঙে দেওয়া হয়, পাড়ার গুন্ডা মস্তাদের পুনর্বাসনের নামে যখন শিক্ষক বানানো হয়। তখন সেই সমাজ নিম্নগামী, রুচিহীন, ভঙ্গুর সমাজে পরিণত হবে এটাই অতি সাধারণ বিষয়। Malay Das এর লেখাটা সঙ্গে দিলাম পড়ে দেখতে পারেন। বিহার একসময় তাচ্ছিল্যের পাত্র ছিল। তাচ্ছিল্যের কারণও ছিল। লালুজীর মেয়ে ডাক্তারি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে দিল্লিতে পড়তে গেল, এবং ফেল করলো। সেটা বুঝিয়ে দিল শিক্ষাব্যবস্থার কি হাল। শিক্ষাহীন বিহারে ছিল জাতপাতের রাজনীতি, মাফিয়া রাজ। তাদেরকে শিক্ষা না দিয়ে লড়াই লাগিয়ে দেওয়া হত অন্যদের সাথে। বাইরের কেউ বিহারে চাকরির পরীক্ষা দিতে যেতে পারতো না। স্টেশনের বাইরে বেরোতে দেওয়া হতো না। সারা দেশ হাসতো বিহারকে নিয়ে, লোক হাসা-হাসি করতো লালুজীকে নিয়ে। বিহারের নতুন জাগরণ হলো নীতিশ কুমারের হাত ধরে। পরীক্ষায় টোকাটুকি বন্ধ করলেন। পাশের হার অনেক কমে গেল। তিনি অটল রইলেন। কোয়ান্টিটি নয় জোর দিলেন কোয়ালিটির ওপর। যে মদ থেকে প্রচুর রাজস্ব আসতো, সেই মদ বন্ধ করলেন রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য। কড়া হাতে দমন করলেন জাতপাতের রাজনীতি। দলিত আর রণবীর সেনার লড়াই, রক্তপাত বন্ধ হল। নতুন বিহারের অঙ্কুরোদগম হল। মানসিকতা পরিবর্তন হল বিহারের। হাত পাতা বা গা-জোয়ারি করে নয়, নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে শিখল সর্বভারতীয় চাকরি।
দু'টি ঘটনা আমার নিজের দেখা। প্রথমটি কনকনে এক শীতের ভোরে গয়া বাসস্ট্যান্ড; চায়ের দোকান। বৃদ্ধ চা ওয়ালার কষ্ট শুনে স্থানীয় একজন পরামর্শ দিলেন, ছেলেকে তো দোকানে বসাতে পারো। ফুঁসে উঠলো দোকানদার। আপনাদের ছেলে গভমেন্ট নকরি করবে, আমার ছেলে চা বেচবে? আমি ছেলেকে আইপিএসের কোচিংএ ভর্তি করিয়েছি। ও অফিসার বনবে বাবু। অবাক হয়েছিলাম। এক চা'ওয়ালাও এইভাবে ভাবতে পারে!! আর একবার আমাদের স্কুলে একটা গ্রুপ'ডি পরীক্ষার সিট পড়েছিল। বিহার ইউপি থেকে দলে দলে ছেলে এসেছিল পরীক্ষা দিতে। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে এসে, প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পরীক্ষা দিয়ে গেছিল।বলেছিল যেখানে যে চাকরির বিজ্ঞাপন বেরোয়, ওরা ফর্ম ফিল আপ করে। চাকরির জন্য সব কষ্ট সহ্য করতে রাজি তারা।....এরপর দেখেছিলাম একটা খবর। বিহারের সাসারাম প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন বিকেলে জড়ো হয় কয়েকশো ছেলে। গ্রামে তাদের পাওয়ার থাকে না। প্ল্যাটফর্মে ইন্টারনেটের সুবিধা আর কারেন্ট দুই'ই পাওয়া যায়। সেই সুযোগ নিয়ে তারা স্টাডি করে জিআই, জিকে, কারেন্ট টপিক, অংক, ইংরাজি। লক্ষ্য একটাই সরকারি চাকরি পেতে হবে। সারা ভারত অবাক হয়ে দেখেছিল সেই ছবি। চাকরি পাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক যুব সমাজ। আবার গতকাল ভাইরাল হয়েছে একটি ছবি। পাটনার গঙ্গার তীরে সপ্তাহের শেষে জমায়েত হয়েছে বহু যুবক। রেলের চাকরির ফ্রি কোচিং আর টিপস দেওয়া হচ্ছে সেখানে। সেই কোচিং নিতে গঙ্গার তীর ভরে গেছে। এবার আমাদের দিকে যদি তাকাই। গর্বিত বাঙালি জাতি। আমরাও ভিড় করি, তবে মেলায়, পুজোয়, মিছিলে, উৎসবে। চাকরির প্রতি আমাদের আগ্রহ কম। আমরা ক্লাব, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রি নেট পেলে পাবজি খেলি, রিল বানাই, ফেসবুক করি, সিনেমা দেখি। দিনের শেষে বলি ওরা মাউরা, গুঠখা, খোট্টারা আমাদের সব দখল করে নিল। তারপর ভিড় করি বেকার'ভাতার লাইনে। ফলে যা হবার তাই হয়, আমরা মাটি কুপিয়ে ১০০ দিনের কাজে সেরা হই, আর ওরা আইএএস, আইপিএস হয়। একটা পিছিয়ে পড়া রাজ্য নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াচ্ছে, প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যাচ্ছে, আমরা কি শিখছি কিছু ? নাকি ইতিহাস আর আত্মগরিমায় আজও তৃপ্তির চোঁয়া ঢেঁকুর তুলেই যাচ্ছি? মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। তাহলেই ভিক্ষা দিয়ে, প্রাদেশিকতার জিগির তুলে, জাতপাত দিয়ে মাতিয়ে রাখা যাবে না আর। এই ছবি, এই ঘটনাগুলো কি একটুও ভাবায় না! বাঙালির এই জড়ত্ব কি ঘুচবে না! জানি না এ কোন অন্ধকার সময়!
(সংগৃহীত)
- Log in to post comments