অনেক পুরোনো দিনের কথা | চলছে ব্রিটিশ জমানা ৷ এমনই একদিনে আলিপুরে চিড়িয়াখানার সামনে কলকাতা কর্পোরেশনের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ব্রাডফোর্ড লেসসি পড়েছেন বড্ড মুশকিলে ৷ ওই ধোপ-দুরস্ত সাহেবটি তার সঙ্গে থাকা মিস্ত্রিদের কাজ বোঝাতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলেন ৷
আর দূর থেকে সেটাই লক্ষ্য করেছিলেন এক বাঙালি যুবক ৷ যুবকটি সাহস করে এগিয়ে গেলেন লেসসি সাহেবের দিকে ৷ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিলেন তিনি কি চান আর সেটাই মিস্ত্রিদের বলে বুঝিয়ে দিলেন যুবকটি ৷ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কর্পোরেশনের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ৷ বুঝলেন ওই যুবককে দিয়ে কাজ হবে ৷ তৎক্ষনাৎ সাহেব যুবকটির দিকে নতুন এক কাজের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ৷ সাহেব জানতে চাইলেন পলতায় জল প্রকল্প নির্মাণ কাজের দায়িত্ব সে নিতে পারবে কি না ৷ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় দিলেন ২৪ ঘণ্টা ৷ রাজী থাকলে পরের দিন কর্পোরেশন অফিসে সরাসরি এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন ৷ পকেট শূন্য থাকলেও এবং সে যুগের তুলনায় কাজটি কঠিন হলেও যুবকটির মনে হয়েছিল যদি অন্য কেউ ওই কাজ করতে সক্ষম হন তবে তিনিও পারবেন ৷ তাছাড়া তিনি তো কলম পেশা কেরানির বদলে এক উদ্যোগী বাঙালি হয়ে উঠতে চান ৷ ফলে অমন কঠিন কাজের দায়িত্বটা সেদিন জীবনের একটা সুযোগ হিসেবেই দেখলেন ৷ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ৷ সেদিনের সেই যুবকটি হলেন স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি ৷ আর ওইদিনের ঘটনাই এই বঙ্গ সন্তান শিল্পপতির কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলেই মনে করা হয় |
শুরু হল রাজেনের জীবনের নতুন অধ্যায় | কলকাতা তথা সারা বাংলায় ভগীরথ হয়ে নব জলধারার সঞ্চার করলেন রাজেন্দ্রনাথ। দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার, অথচ কি নিপুণ ভাবে করছেন কাজ। প্রতিটি ইঞ্চিতে কড়া নজর। দেখে লেসলি সাহেব নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেন যোগ্য লোককে খুঁজে বের করার জন্য। আর রাজেন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করলেন সরকারের কাছে। কলকাতা থেকে পলতা চল্লিশ ইঞ্চি ব্যাসের জলের পাইপ পাতার কাজের বরাত পেলেন তিনি। তার নাম ছড়াল সারা দেশে।
১৮৫৪ সালের ২৩জুন বসিরহাটের ভ্যাবলা গ্রামে জন্ম হয় রাজেনের৷ কিন্তু মাত্র ছয় বছরের মাথায় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়৷ বহু বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে শৈশব কৈশোর কাটালেও অবশেষে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ৷ সেই সময় শিবপুর বিই কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাঠ চলত প্রেসিডেন্সি কলেজেই ৷ তিন বছর পড়াশোনা করার পর স্বাস্থ্যের কারণে মূল পরীক্ষায় আর তাঁর বসা হয়নি৷ যদিও তখনই চাকরির সুযোগ ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন ব্যবসা করবেন বলে জেদ ধরেছেন এই বঙ্গ সন্তানটি৷ এটা অবশ্যই ছিল বাঙালির জন্য ব্যতিক্রমী ইচ্ছা৷ তারপরই একদিন আলিপুরে স্যার ব্রাডফোর্ড লেসসির সঙ্গে দেখা৷ আর পলতার জল প্রকল্পের হাত ধরে তাঁর ব্যবসায় অভিষেক হয়ে যায়৷ তারপর থেকেই ধীরে ধীরে বাণিজ্যের দুনিয়ায় রাজেনের সাম্রাজ্য বিস্তার চলতে থাকে ৷
আগ্রা, এলাহাবাদ, মীরাট, নৈনীতাল, বেনারস এইরকম নানা শহরের জলপ্রকল্প আর পাইপ লাইনের কাজ পেলেন তিনি। তাঁর হাত ধরে খরা কবলিত বা পার্বত্য এলাকায় বাহিত হল জলধারা। সকলে কুর্নিশ জানালো তাঁর কারিগরি দক্ষতাকে।
তারপর চারদিকে তাঁর জয়জয়কার। বিভিন্ন ইংরেজ আসেন তাঁর সাথে যৌথ ব্যবসা করার আর্জি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মার্টিন সাহেবের সাথে খুললেন যৌথ সংস্থা মার্টিন অ্যান্ড কোং। এরপর তিনি জলের লাইনের কাজ ছেড়ে হাত দিতে চাইলেন স্থাপত্য শিল্পের কাজে। বড় বড় অট্টালিকা, সুন্দর সুন্দর তাক লাগানো ডিজাইন বানানো এযে তাঁর কতো দিনের স্বপ্ন। লোকে দাঁড়িয়ে দেখবে তাঁর কীর্তি, প্রশংসা করবে, তবেই না সার্থক তাঁর কাজ। এই কাজের মাধ্যমেই বেঁচে থাকতে চান তিনি।
সুযোগ এল হঠাৎ করেই। বড়লাট লর্ড কার্জন রানী ভিক্টোরিয়ার নামে এক সৌধ বানাতে চান কলকাতায়। এমন সৌধ যেন ইংরেজদের রীতির সঙ্গে অনুপম আভিজাত্যে ঝলমল করে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্থপতি উইলিয়াম এমারসনকে অনুরোধ করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ করার। এমারসন দরপত্র সহ নকশা চান। বিভিন্ন নামী দামী বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে নকশা জমা দিলেন রাজেন মুখোপাধ্যায়। দেখে তাক লেগে গেলো এমারসনের।
তাঁর হাতেই দিলেন নির্মাণের ভার। কলকাতার বুকে গড়ে উঠলো বেলজিয়াম মার্বেলে তৈরি অপরূপ এক সৌধ। সামনে ব্রিটিশের প্রতীক সিংহ। আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল প্রাসাদ। চমক দিলেন শেষে। সৌধের মাথায় স্থাপন করলেন এক ছোট্ট ঘূর্ণায়মান পরী। অবাক বিস্ময়ে সবাই প্রত্যক্ষ করলো কলকাতার তাজমহল। কি অপরূপ সৌন্দর্য।
কপাল খুলে গেল তাঁর। এতদিনের স্বপ্ন সফল হল। বাংলা ও কলকাতা জুড়ে একের পর এক বিখ্যাত স্থাপত্যের কাণ্ডারি হয়ে রইলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পনায় গড়ে উঠলো মহীশূর প্যালেস, টিপু সুলতান মসজিদ, বেলুড় মঠ, এসপ্ল্যানেড ম্যানসন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, বিধানসভা ভবন, ত্রিপুরা রাজবাড়ি, ইমামবারার মতো বিখ্যাত স্থাপত্য। আলাদা আলাদা ঘরানার স্থাপত্যের প্রতিটি তিনি ফুটিয়ে তুললেন অসাধারণ দক্ষতায়। কিন্তু তিনি এতেও সন্তুষ্ট নন। তিনি গ্রেট রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
শুধু স্থাপত্য না, কারিগরি বিদ্যাতেও তিনি দেখাতে চান তাঁর প্রতিভা। তাই গঙ্গার ওপর যখন হাওড়া ব্রিজ গড়ার পরিকল্পনা হচ্ছে তার নকশাও করলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পনায় নির্মিত হল এক বিস্ময়, এশিয়ার প্রথম বৃহৎ ঝুলন্ত সেতু। আজও যা বহন করে চলেছে বাংলার সম্পর্কের সূত্র। ব্রিটিশ তাঁর কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে স্যার উপাধি প্রদান করে।
এর মাঝেই মার্টিন সাহেবের মৃত্যু হওয়ায় মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির তিনিই একছত্র মালিক। হাওড়া আমতা রেলপথের কাজ হাতে নিয়েছেন। অজানা গ্রামকে জুড়েছেন শহরের সাথে। সবুজ মাঠের বুক চিরে ছুটেছে মার্টিন রেল। রানাঘাট কৃষ্ণনগর, আদ্রা বখতিয়ারপুর, দিল্লি সাহারানপুর, বারাসত বসিরহাটের রেলপথও তাঁর হাতেই তৈরি।
শুধু ইঞ্জিনিয়ার হিসাবেই নয়, তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের পর হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সফল বৃহৎ শিল্পপতি। মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি শুধু না, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি, ইস্কো, স্টিল করপরেশান অথোরিটি অফ ইন্ডিয়ার মতো বড় বড় কোম্পানির কর্ণধার ছিলেন তিনি।
বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি শুধু কেরানী হতে জন্মায় না। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উচ্চাশা আর কাজের প্রতি একগ্রতা থাকলে সব বাধা দূর করে নিঃস্ব অবস্থা থেকে এভাবেও মাথা তুলে দাঁড়ানো যায়।
স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জিকে আমাদের প্রণাম |
© অহর্নিশ
তথ্য : বহুমাত্রিক (অভিজিৎ সেনগুপ্ত)
বাংলার ইতিহাস জানতে চান ? যদি প্রকৃত ইতিহাস জানতে চান তাহলে অবশ্যই পড়ুন ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই "বাঙ্গালার ইতিহাস" । বাংলার ইতিহাস নিয়ে এইরকম গবেষণামূলক বই একটিও নেই ।
- Log in to post comments