আমার বাঙলা

লেখক
একর্ষি

প্রথম-পর্ব

প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর রচিত বাংলা ও বাঙালী গ্রন্থে লিখেছেন---‘‘আমরা পৃথিবীর--পৃথিবী আমাদের দেশ৷ আরো ভালোভাবে বলতে গেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই আমাদের দেশ৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোণে পৃথিবী নামে যে ছোট গ্রহটা আছে, সেই পৃথিবীর এক কোণে বাঙালী নামে জনগোষ্ঠী আছে৷’’ পৃথিবীর সেই কোণটা আমার বাঙলা---বাঙালীস্তান৷ বাঙালীস্তানের কথা শোনাবো সবাইকে ডেকে ডেকে৷

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাইনা আর৷ ও আমার দেশের মাটি, তোমারে ‘পরে ঠেকাই মাথা৷ তোমাতে বিশ্বময়ীর,তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচলপাতা৷ তাই, আমি বাঙলার গান গাই৷ পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে আনুমানিক দশলক্ষ বছর আগে৷ আধুনিক মানুষের আসাটা আনুমানিক পনের হাজার বছর আগে৷ মানুষের সভ্যতার ঊষালগ্ণটি মোটামুটি দশহাজার বছর আগের৷ আর সভ্যতার বিকাশ বা উল্লম্ফন শুরু হয় সাত হাজার বছর পূর্বে সদাশিবের হাত ধরে৷ নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর বুকে এ সময়ে মানুষ নামক জীবপ্রজাতির বৈচিত্র্যটা ছিল নরগোষ্ঠী বা ‘রেস ভিত্তিক৷ জগতে রেসের মূল ধারা চারটি ---১. নিগ্রো , ২. অষ্ট্রিক, ৩.মঙ্গোলীয় ও ৪. আর্য ৷ এদের যাত্রা শুরু হয় এক একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলক অঞ্চল জুড়ে৷ প্রকৃতিও রেস্গুলোর চেহারায় , গায়ের রঙে, কথাবার্তায়, হাবভাবে বিচিত্র ভৌগোলিক পরিচয়ে রাঙিয়ে দেয়৷ কিন্তু খাদ্য, নিরাপদ আশ্রয়, মানব মনের স্বভাবগত অতুষ্টি ও কিছুটা দখলদারী মনের তাড়নায় কেউই কোথাও স্থিতু হয়ে থাকেনি ৷ এরা ছড়িয়ে পড়াছিল পৃথিবীময়৷ ফলে বিভিন্ন রেস পরস্পরের সংস্পর্শে আসে৷ হাজার হাজার বছর ধরে চলে ঘাত-প্রতিঘাত,পরিস্থিতির চাপে---কখনো প্রয়োজনের তাগিদে চলে মেলামেশা ৷ এক একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল কেন্দ্রিক উদ্ভব হয় নোতুন নোতুন মানব গোষ্ঠীর৷ নৃতাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন রেসের মিলনে ( নরগোষ্ঠীর মিলনে) সৃষ্ট এই নব মানবগোষ্টীদের নাম দিলেন ‘এথিক গ্রুপ’ বা জনগোষ্ঠী৷ স্থানগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জনগোষ্ঠিগুলোর নামকরণও হয়ে যায়৷ ‘রেস’-এর এই ‘এথিকগ্রুপ এ রূপান্তরণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হিসেবে বলা যায়--- (১) ভৌগোলিক নৈকট্য--- অর্থাৎ বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মানুষের কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে সুদীর্ঘকালীন অবস্থান এবং সহ-অবস্থান৷ এই ভৌমিক অবস্থানগত শর্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে --- সূর্যরশ্মির পতন কোণ৷ সূর্যরশ্মির মধ্যে থাকা ‘ আল্ট্রাভায়লেট রে ও মানুষের ত্বকের মধ্যে থাকা ‘মেলানিন নামক রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে তার মিথষ্ক্রিয়া৷ অবস্থান ভেদে পতনকোণের পার্থক্যে এটা পালটে যায়৷ (২) জীবনরক্ষা ও প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ লড়াই৷ (৩) ক্ষত্রিয়দের পারস্পারিক লড়াই, জয়-পরাজয় ও রাজ্যবিস্তার৷ (৪) ধর্মীয় সম্পর্কের আন্তরিক আকর্ষণ৷ (৫) ব্যবসা বাণিজ্য ও পারস্পরিক যোগাযোগ৷ (৬) ভাষা-সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান৷ (৭) বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি৷ এই সব শর্তগুলোর সামবায়িক সহাবস্থানে উদ্ভব হয়েছে আজকের পৃথিবীর জনগোষ্ঠীগুলো৷

নৃবিজ্ঞানীরা আসরে নামলেন, জানালেন ‘জাতিসত্তা’ (এথিসিটি) নির্ণয়ে বিচার্য হচ্ছে---১. মাথার আকৃতি (গ্রেসেলের পরিমাপ), ২. মুখের গঠন, ৩. দেহের দৈর্ঘ্য, ৪. গায়ের রঙ-ত্বক, ৫. নাকের আকার, ৬. চোখের রঙ ও বৈশিষ্ট্য, ৭. চুলের রঙ ও বৈশিষ্ট্য৷ এই সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীর সামূহিক মানসিক প্রবণতা৷ সুতরাং নৃবিজ্ঞানের বিচারে ও সাধারণ মানসিক প্রবণতার বিচারে ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি একটা স্বতন্ত্র ‘জাতিসত্তা, একটা এথিক-গ্রুপ,একটা জনগোষ্ঠী৷ পৃথিবীতে ‘জাতিসত্তার’ উদ্ভব আজ থেকে মোটামুটী সাত-আট হাজার বছর আগে থেকে৷ তবে আধুনিক পৃথিবীর অনেক জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি এখন থেকে আনুমানিক আড়াই হাজার---সাড়ে তিন হাজার বছরের কিছু আগে পড়ে৷

পৃথিবীর প্রাকৃতিক মানচিত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটা ‘বিভিন্ন গিরি বেষ্টিত নদীমেখলা অঞ্চল’ আছে৷ ভৌগোলিক পরিভাষায় প্রাচীন সংস্কৃতে একে বলা হয় ‘মহাসংস্থান’ বা ‘মহাভূমি’৷ এই মহাসংস্থানের চৌহদ্দি হচ্ছে--- উত্তরে দুর্ভেদ্য হিমালয় দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর - চিল্কা হ্রদ---এর উপকূল সীমা,---পূর্বে নাফনদীর মোহনা থেকে মহানদীর মোহনা পশ্চিমে--- বিন্দ্যপর্বতের শাখা ‘রামগড়পাহাড়--শোন নদী’পূর্বে আরাকান ইয়োমা আর মধ্যাংশে বহমানা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও নদী মেখলা দামোদর সহ রাঢ়ের নদীগুলি বাহিত পললভৌম দেশ এক বিশেষ ভৌগোলিক বাতাবরণে গড়ে ওঠা স্বাতন্ত্র্য-চিহ্ণিত ও স্বাতন্ত্র্য-সৃষ্টিকারী বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভূভাগ৷ অনেক হাজার বছর ধরে (প্রায় ৫০০০ বৎসরেরও অনেক বেশী সময় ধরে) এই মহাভূমি পৃথিবীর কোথাও ‘বঙ্গ’, ‘বাঙলা’, ‘বাঙ্গালা’,‘বঙ্গাল’- ‘বাঙ্গালা’ --- ‘বাঙ্গালাইটিস’, ‘বাঙ্গাল’, আবার কোথাও ‘বেনাল নামে পরিচিত হয়ে আসছে৷ তবে আধুনিককালে বর্তমান সামাজিক--- রাজনৈতিক -অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার-এর ভাবনা অনুযায়ী, শরৎ-সুরাবর্দী ফরমুলার অনুসরণে ও কাজাকিস্তান- তুর্কমেনিস্তান---আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান- তামিলনাডু (নাডু মানে দেশ---তামিলদের বাসভূমি) ইত্যাদি পৃথিবীর নানান দেশের বাসভূমির নামকরণের দৃষ্টান্তে আমাদের বিশিষ্ট মহাভূমির পরিচয় হতে চলেছে ‘বাঙালীস্তান’৷ আর এই মহাসংস্থানের ভূমিপুত্রদের তথা বাঙালীস্তানের অধিবাদীদের একটাই পরিচয়, তা হ’ল ‘বাঙালী’৷ যুগ-যুগান্তর ধরে এখানকার অধিবাসীরা এই বাঙালী নামেই পরিচিতি পেয়ে আসছে অর্থাৎ আমরা বাঙালীরা হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের এই বাসভূমি মহাসংস্থান---বাঙালীস্তানেই বসবাস করে আসছি৷ বাঙালী কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত গাইলেন--- ‘‘আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থে---বরদ বঙ্গে/বাম হাতে যার কম্লার ফুল, ডাহিনে মধুক মালা,/ভালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট, কিরণে ভুবন আলা/কোল-ভরা যার কনক ধান্য, বুক ভরা যার স্নেহ,/ চরণে পদ্ম, অতসি অপরজিতায় ভূষিত দেহ,/সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ-ভঙ্গে,/আমরা বাঙালী বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে৷’’                        (চলবে)