আজকের যুগে দারিদ্র্যই মানবব্জাতির বৃহত্তম সমস্যা ---- এ কথা আগেই বলা হয়েছে । আর গরিবের অবস্থার পরিবর্তনের এক উপায় হল নিজের ন্যূনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির দায়ে ও সুখ-সুবিধা লাভার্থে নিজের যোগ্যতায় ও ক্ষমতায় উপার্জন করে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পালটানো । মোটকথা উন্নয়নই হচ্ছে দারিদ্র্য মোচনের হাতিয়ার । তবে উন্নয়নের ঠিকুজি নিয়ে প্রথাগত অর্থনীতিতে মতান্তরের অন্ত নেই । এক সময় গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে উন্নয়নের সূচক ধরা হ'ত , বর্তমানে জিডিপি ( গ্রস্ ডোমেস্টিক্ প্রোডাক্ট্ ) বৃদ্ধি তার জায়গা নিয়েছে । রাষ্ট্রীয় স্তরে এর নাম দেয়া হয়েছে গ্রোথ্ বা প্রবৃদ্ধি , এবং নাগরিকদের ক্ষেত্রে এটাকেই উন্নয়ন বলে লম্ফঝম্ফ চলছে । তবে সাধারণ মানুষের কাছে এটা যে পুঁজিবাদী তথা কেন্দ্রিত অর্থনীতির একটা বিরাট ধাপ্পা তা বলার অপেক্ষা রাখে না । প্রমাণ ? তাহলে তথাকথিত উন্নয়নের প্রবক্তাদের সামনে কয়েকটা প্রশ্ন রাখা যাকঃ ---
১) টাটা-বিড়লা-গোয়েঙ্কা-আম্বানি গোষ্ঠীর মত পরার্ধপতিদের সঙ্গে দিন মজুর ,ভ্যান-চালক , রেল গাড়ির হকার দের মত দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের মাথাপিছু আয়ের গড় করে মানুষের সঠিক আয়চিত্র বা দারিদ্র্যের ভয়াবহতা কী বোঝা যায় ? ২) আবহমানকালের অর্থনীতির সুচারূ তত্ত্বগুলি গরিবদের দারিদ্র্য দূর করা বিষয়ে কোন নির্দেশনা দিয়েছে কি ? ৩) প্রথাগত অর্থনীতি জাতীয় সম্পদের পরমাণ ---তার বৃদ্ধি ও কারণের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখে । এই অর্থনীতি সর্বদা এই একই নিশানায় অনুসন্ধান চালিয়ে যায় । কিন্তু একজন মানুষ গরিব হয় কেন বা মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার দিশা নেই কেন ----- এই সহজ প্রশ্নটি এড়িয়ে যায় কেন ? ৪) চলছে অর্থনীতিতে ডারুনিয়ান ভিউ( জীববিজ্ঞানী ডারুইনের 'সার্ভাইবাল্ অব্ দ্য ফিটেষ্ট্ ' তত্ত্ব কথাটি অর্থনীতিতে মাত্রা পেয়েছে এই ভাবে--- সর্বোচ্চ মুনাফা ,সীমাহীন স্বাধীনতা লাভে যোগ্যতমেরই স্বীকৃতি) কে আঁকড়ে ধরে সিম্বায়োটিক্ ভিঊকে ( সর্বজনহিতার্থং -সর্বজনসুখার্থং ) বিসর্জন দেয়াটা কাদের তুষ্ট করতে ? ৫) বিশ্বের বিশাল সংখ্যক জনগন স্বকর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে । প্রথাগত অর্থনীতিবিদেরা তাকে 'আনুষ্ঠানিক খাত' (ইন্ফর্মাল্ সেক্টর্ ) নাম দিয়ে ( এর মধ্যে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পও রয়েছে ) মূল কাঠামোর বাইরে রেখে দেয়া সঙ্গত মনে করেছেন কাদের স্বার্থে ? আর তাঁরা অভিমতই বা দিলেন কেন -----'যত তাড়াতাড়ি এই আনুষ্ঠানিক খাত বাদ দিতে পারবে তত তাড়াতাড়ি আসবে তাদের কল্যাণময় জীবন ?'--- এটা কী অসম্ভব লজ্জার কথা নয় ? ৬) কৃষি-শিল্পের সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি অর্থনীতিতে গতি ও দ্রুতি সঞ্চার করে । কিন্তু ভারতবর্ষ কৃষি প্রধান দেশ , এখানে কৃষি- শিল্পের ভারসাম্য রচনা বা তার কোন প্রচেষ্টা হয়েছে কি ? ৭) রাজনৈতিক গণতন্ত্র মানুষকে অর্থনৈতিক অধিকার দিয়েছে না কেড়েছ? ৮) পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই তা সে পুঁজিবাদীই হোক আর মার্ক্সবাদীই হোক অর্থনীতির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে । কেন্দ্রীভবনের বৃত্তে থাকা ধনী করপোরেট গোষ্ঠী-পুঁজিপতি ছাড়া -- ওই বৃত্তের ভিতরে ঢোকা অন্যেদের সাধ্যের বাইরে । তাহলে কেন্দ্রীভূতীকৃত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় সাধারাণ মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণ কি আদৌ সম্ভব ? ৯) উপযুক্ত সংগঠনের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা ও নীতি নির্ধারণ এর উদোগ সমাজ বা রাষ্ট্র নেয়নি কেন? এটা করলে --বেকার থাকবে না , গরিব থাকবেনা , বেকারিত্ব -দারিদ্র্য নিয়ে রজনীতি করা যাবেনা ,রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা ধরার লোক খুঁজে পাওয়া যাবেনা , কর্পোরেট গোষ্ঠীর কারখানায় সস্তায় স্রমিক পাওয়া যাবেনা - বাড়ির কাজের ঝি-চাকর পাওয়া যাবেনা , জনদরদী -সমাজ সেবী-গণহিতৈষী শংসাপত্র জুটবে না , শোষণ বিরোধী জনরোষকে রুখতে সেফ্টি ভাল্ভ্ হিসেবে 'দান-দয়া-করুণা-ভিক্ষার গাজর' ঝোলান যাবে না এই ভয়েই কী ? ১০) আবহমান কালের অর্থনীতিতে মানবিকতার স্পর্শ, নৈতিক বন্ধন, আধ্যাত্মিকতাকে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কেন ? 'ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর? 'একথা বলার জায়গা থাকবেনা বলে ? মানুষের রক্ত চুষে, হাড়-মাশ চিবিয়ে খেয়ে ডুগডুগি বাজান যাবে না বলে ?
প্রশ্নে ভারাক্রান্ত করে লাভ নেই । সোজা কথাটা হল-- তথাকথিত উন্নয়নের নামে রঙিন ফানুস উড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত ও বোকা বানান হচ্ছে মাত্র। প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলো সমাধান ও বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি । অথাৎ প্রতিটি মানুষ নিজের কায়িক বা মানসিক শ্রম বা পরিষেবা দিয়ে ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করবে , এবং তা দিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজন পূর্ত্তি (খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা) ও উত্তরোত্তর ক্রমবর্ধমান সুখ-সুবিধা পাওয়ার নিশ্চিততার ( গ্যারাণ্টীর) অধকারী হবে এবং আয় বৈষম্যও কমে আসবে (মিনিমাইজ্ড্) ---এটাই হবে প্রকৃত উন্নয়ন । ( ক্রমশঃ )
- Log in to post comments