আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরেই বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

বাঙলার বুকে চলা ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদী শোষণের কবল থেকে বাঁচিয়ে বাংলা ও বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংঘটন ---বাঙালী ছাত্র-যুব সমাজ একদা যে বাঙলা ভারতে তো বটেই গোটা পৃথিবীতে, জীবনধারার সবক্ষেত্রেই উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত করে আসছিল, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শোষনের নিষ্পেষণে সেই বাঙলা আজ চরম দীনতায় ভুগছে৷ সামাজিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংসৃকতিক-শিক্ষাব্যবস্থা সর্বস্তরে পুঁজিবাদ তার মানবতা বিরোধী মুনাফাবাদী আগ্রাসন চালাচ্ছে৷ বর্তমান পুঁজিবাদ তার এই আগ্রাসন চালাতে এক অভিনব কুপন্থা অবলম্বন করেছে৷ প্রাউটের মতে একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংসৃকতির উপর অন্য নিম্নস্তরের ভাষা-সংসৃকতির জোর করে চাপিয়ে দিলে স্বাভাবিকভাবেই সেই জনগোষ্ঠী মানসিকভাবে পরাধীনতার শিকার হয়৷ এই মানসিক পরাধীনতার সুযোগ নিয়েই সেই জনগোষ্ঠীর উপর চলে চরম আর্থিক শোষণ, অর্থনৈতিক লুটপাট৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীর উন্নত মাতৃভাষা বাংলা ভাষা ও সুউচ্চমানসম্পন্না বাংলা সংসৃকতিকে অবরুদ্ধ করে সুকৌশলে অবনত হিন্দী ভাষা ও সংসৃকতির সূচিকাভরণ (ইনজেক্ট) করে  বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর মানসিক শোষণের মাধ্যমে বাঙলার  উপর চালানো হচ্ছে অবাধ অর্থনৈতিক শোষণ৷ সমাজের বিরাট দুই অংশ ছাত্র  ও যুব সমাজকে অর্থনৈতিক শোষণের ব্যাপারে অজ্ঞ ও অসচেতন করে রাখানোর জন্যে ভোগমুখী, নিম্নগামী হিন্দী গান-সিনেমা থেকে শুরু করে সর্বত্র হিন্দীর রমরমা বাজারে চালাচ্ছে পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ৷

সংবিধান স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও বাঙলার সরকারী বেসরকারী ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যিক না করে বাঙালীদের মাতৃভাষায় পরিষেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে৷ ‘হিন্দী রাষ্ট্রভাষা’---এই মিথ্যে প্রচার করে , বাঙলার কেন্দ্রীয় দফতর (রেল-ব্যাঙ্ক-বিমান ইত্যাদি) গুলিতে হিন্দী পরিষেবা বাধ্য করার ফলে একদিকে যেমন সাধারণ বাঙালীদের বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, অপরদিকে সহজেই সংশ্লিষ্ট দফতরে বাঙালী যুবক-যুবতীদের বাদ দিয়ে হিন্দীভাষী কর্মচারী নিয়োগ করা হচ্ছে! অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রাধীন সংসদীয় ভাষা কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে এই মর্মে যে, কেন্দ্রীয় দফতরের চাকরির প্রবেশিকা পরীক্ষাতেও হিন্দী ভাষার পরীক্ষা আবশ্যিক করতে হবে! কেন? এই প্রশ্ণের আমরা উত্তর চাই৷ বাঙলা সহ আরও অন্যান্য অহিন্দিভাষী রাজ্যের করের অর্থে কেন্দ্র বা দিল্লি চলে,দিল্লির এই চাপানো আগ্রাসী নীতি কেন মেনে নেব আমরা?  পুঁজিবাদের দোসর হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ রাজনৈতিকভাবে তার রাষ্ট্রিক শক্তি জারি করে হিন্দী চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বাঙালীদের শোষণ করা আমরা মেনে নিতে পারি না৷ বরং তা করলে অন্যায় করা হবে৷ অবাঙালী ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে বর্তমান রাজ্য সরকারও হিন্দী তোষণে কম যাচ্ছে না৷ বাঙলায় রাজ্য সরকারী হোক বা কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, এদের মাইনে হয় বাঙালীদের করের টাকাতেই৷ বাঙালীদের করের টাকা বাঙালী কর্মচারীদের মাধ্যমে বাঙলাতেই খরচ হলে আখেরে বাঙলারই লাভ হবে, বাঙলার অর্থনীতি পুষ্ট হবে৷

এবারে দেখা যাক ব্যবসা-বাণিজ্যে অবাঙালী বেনিয়াদের মুনাফারাজের ইতিবৃত্ত৷ প্রকৃতি অকৃপণ হস্তে বাঙলাকে প্রাকৃতিক (ভূমিজ-খনিজ-বনজ-জলজ) সম্পদে পরিপূর্ণ করার পরেও কেন বাঙলার মানুষদের চরম অর্থকষ্টে দৈনদশা পোহাতে হচ্ছে? কেন বাঙলার শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে? উত্তরটি আমাদের চোখের সামনে থাকলেও হিন্দীর গোবলয়ের ভোগমুখী উন্মাত্ত ফূর্তিতে বুঁদ হতে হতে  খুব সহজে শোষিত বাঙালীদের স্বাভাবিক চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে৷ আর ওদিকে বাঙলার কাঁচামাল বাঙলার বাইরে পাঠিয়ে সেখানে তা শিল্পজাত পণ্যে পরিণত হয়ে তা আবার বাঙলায় বাজারজাত অর্থাৎ বিক্রি করে লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে অবাঙালী বেনিয়ারা৷ একদিকে কাঁচামাল শিল্পজাতপণ্যে পরিণত হচ্ছে বাঙলার বাইরের যে কারখানাগুলিতে, সেখানে কাজের সুযোগ হচ্ছে  অবাঙালী ছেলেমেয়েদের৷ বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে কাদের? হতভাগ্য বাঙলার ছেলে-মেয়েদের৷ আর একদিকে, উৎপাদিত সেই শিল্পপণ্য বাঙলায় ফিরে এসে বিক্রি করে বাঙালীর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা বাঙলার বাইরে পাচার করে চলেছে অবাঙালী বেনিয়াগোষ্ঠী৷ প্রতিনিয়ত অর্থের এই বহিঃস্রোতে ধসে পড়ছে বাঙলার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো৷ এছাড়াও চক্রান্ত করে সর্বভারতীয় স্তরে বাঙালীদের দাবার বোরে করে রাখার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের প্রশাসনিক স্তরে লাগাতার অবাঙালী হিন্দিভাষী কর্মচারী নিয়োগ করে চলেছে৷ রাজ্য সরকার কে এটা মাথায় রাখতে হবে প্রশাসনিক হোক বা সরকারী-বেসরকারী দফতরে কোন অবাঙালী নিয়োগ করা চলবে না৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই ফ্যাসিস্ট হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের চরম নিষ্পেষণে বাঙলার ছাত্র-যুব সমাজের বিরাট অংশ আজ দিশেহারা৷ খোদ কলকাতাতেই বাসে---ট্রেনে, চলতে ফিরতে বাঙালী যুবক-যুবতী হিন্দীতে কথা বলে আত্মতৃপ্তি ঢেকুর তোলার ছবি হামেসাই চোখে পড়ে৷ এছাড়া বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-ক্ষুদিরাম-নেতাজীর মতন মহান মনীষীদের উত্তরসূরী বর্তমান বাঙলার যুবদের মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপ করে গর্ব বোধ করতে দেখা যাচ্ছে! দোষ পুরোপুরি কখনোই তাদের ঘাড়ে চাপানো যায় না, যাবেও না৷ তা করা হলে অন্যায় হবে৷ দোষ সমাজের দায়ভার যাঁদের কাঁধে সেই তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের৷ অর্থ আর ভোটের লোভে অন্যায়ের কাছে তাদের মাথানত করার খেসারত দিতে হচ্ছে বাঙলার ছাত্র-যুব সমাজকে৷ বাংলা ও বাঙালীর উপর চলা এই শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে চুরমার করে নিজে বাঁচো ও অপরকে বাঁচাও’ নীতি নিয়ে চলা বাঙলার আর্থ-সামাজিক শ্রীবৃদ্ধি-উন্নতকামী তথাকথিত রাজনৈতিক ছত্রছায়ামুক্ত ‘বাঙালী ছাত্রযুব সমাজ’ সংঘটনের ‘শোষণ বিরোধী’ লড়াইয়ে সামিল হোন৷ পরিশেষে বলি-অনেকে মনে করতে পারেন এই সংঘটন সাম্প্রদায়িক৷ তা একেবারেই ভুল ধারণা৷ আমরা মনে করি বাঙলার আর্থ-সামাজিক-সাংসৃকতিক উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছানোর পথ ধরেই বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের মুক্তি প্রদানের পথ প্রশস্ত করার মধ্যে দিয়েই বিশ্বৈকতাবাদে পৌঁছানো সম্ভব৷