আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহে দেশের গণ্ডীকে মানা হয় না অর্থাৎ যেকোন দেশের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে যেকোন দেশের মেয়ে বা ছেলের বিয়ে হতে পারে৷ বাবা যে বিশ্বৈকতাবাদের কথা বলেছেন বিবাহ ব্যবস্থাকেও তার অন্যতম সোপান হিসাবে ব্যবহার করেছেন৷
এই বিবাহ ব্যবস্থায় ধর্মমতের কোন গোঁড়ামি নেই৷ যেকোন ধর্মাবলম্বী অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করতে পারেন৷ আনন্দমূর্ত্তি বলেছেন যে ‘‘মানবসমাজ এক ও অবিভাজ্য’’৷ বিবাহব্যবস্থা যাতে সেই অবিভাজ্য মানবসমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে সেদিকে তিনি নজর দিয়েছেন৷
এই বিবাহ ব্যবস্থায় জাত–পাতেরও বিচার করা হয় না৷ ‘‘অভিভাবকগণ পু––কন্যার বিবাহদান কালে দেশ–জাতি বিচার করবেন না বটে কিন্তু পাত্র–পাত্রীর গুণাগুণ অবশ্যই বিচার করবেন৷’’
আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে বিবাহ দেবার দরকার হয় না৷ এই বিবাহ ব্যবস্থায় আনন্দমার্গের আচার্যগণই পৌরোহিত্য করেন৷ মহিলা আচার্যারাও বিবাহ ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেন৷ একজন পাত্রপক্ষে অন্যজন পাত্রী পক্ষের হয়ে পৌরোহিত্য করবেন৷ পাত্রী পক্ষের হয়ে কোন মহিলা আচার্যা বিবাহ দেবেন৷ যদি কোন বিবাহে আচার্যা উপস্থিত না থাকেন তবে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ এই কাজ করতে পারেন৷
‘‘নিজের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝে বিবাহ সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসা উচিত৷ এই বিবাহ ব্যবস্থায় কাউকেই চাপ দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়৷ বিবাহ ধর্মসাধনার প্রতিবন্ধক নয়৷ বিবাহ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান৷’’
আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থা অনুযায়ী পণ দেওয়া ও নেওয়া সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়৷ এই বিবাহ ব্যবস্থায় ধার করে’ নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো স্বীকার করা হয় না৷
‘‘পণপ্রথা সামাজিক অবিচারের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত.....আমাদের ছেলেমেয়েরা চাল–ডাল, নুন–তেল বা গোরু–ছাগল নয় যে তাদের নিয়ে হাটে বাজারে দর কষাকষি চলবে৷’’
সংসৃক্ত বুঝুক না বুঝুক জোর করে’ এখানে বর কনেকে সংসৃক্ত ভাষায় মন্ত্রপাঠ করতে হয় না৷ নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই শপথ পাঠ করতে পারেন৷ যেমন ভাষা বাংলা হলে বলবেন ‘‘আমি আজ থেকে তার মানসিক শান্তি রক্ষায় ও মানসিক উন্নতি বিধানে সর্বপ্রকার সচেষ্ট থাকব’’৷
এই বিবাহ ব্যবস্থায় অচেতন অগ্ণিকে সাক্ষী রেখে ধর্মপত্নী গ্রহণ করতে হয় না৷ পরমব্রহ্মের নামে শপথ করতে হয়৷ যেমন ‘‘আমি পরম ব্রহ্ম তথা মার্গগুরুদেবের নামে শপথ করে বলছি শ্রীমতী.....আমি স্বেচ্ছায় স্ত্রীরূপে গ্রহণ করছি’’৷
সাধারণতঃ বিবাহ ব্যবস্থায় কনের কোন ভূমিকা থাকে না৷ আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ ব্যবস্থায় বরকেও যেমন শপথ গ্রহণ করতে হয় তেমনি কনেকেও মাতৃভাষাতে শপথ গ্রহণ করতে হয়৷ যেমন ‘‘আমি পরমব্রহ্ম তথা মার্গগুরুদেবের নামে শপথ করে বলছি, আমি..... কে স্বেচ্ছায় স্বামীরূপে গ্রহণ করছি’’৷
আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থায় নিমন্ত্রিতরা কেবল নির্বাক দর্শক নন৷ তাঁদেরও ভূমিকা রয়েছে৷ নিমন্ত্রিতদেরও শপথ নিতে হয়৷ যেমন ‘‘পরমব্রহ্ম তথা মার্গগুরুদেবের নামে শপথ করে বলছি, আমরা এই বিবাহে সাক্ষী রইলুম৷ করুণাময় ব্রহ্মের কৃপায় আমরা যেন এই নবদম্পতির সর্বাত্মক উন্নতিবিধানে যথাযথভাবে সাহায্য করতে পারি৷’’
আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থায় কপালে সিঁদুর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়৷ তবে ‘‘বর ইচ্ছা করলে বধূর সিঁথিতে সিঁদুর দেবে৷ বধূও ইচ্ছা করলে বরের ত্রিকুটিতে সিঁদুরের টিপ দিতে পারে৷’’
আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থায় বিবাহের পূর্বে সঙ্গীত, কীর্তন ও সাধনা করে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ রচনা করা হয়৷ তাতে পাত্র–পাত্রীসহ নিমন্ত্রিতরাও অংশগ্রহণ করেন বা করতে পারেন৷
এই বিবাহ ব্যবস্থায় পাত্রীর পিতা পাত্রীকে সম্প্রদান করেন না৷ আনন্দমূর্ত্তি বলেছেন ‘‘ এ ব্যবস্থা নারীর পক্ষে সম্মানহানিকর৷ নারী কি চাল–ডাল–নুন–তেল যে তাকে তুলে নিয়ে অন্যের হাতে সমর্পন করলুম? নারী কি মুরগী বা ঢ্যাঁড়শ যে তাকে বস্তাবন্দী করে’ তুলে নিয়ে আর কাউকে বেচলুম বা দান করলুম? এ ব্যবস্থা নারীর পক্ষে অবমাননাকর তো বটেই–এতে মানুষ জাতির মর্যাদাও ভূলুণ্ঠিত হয়৷’’
- Log in to post comments