আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ ব্যবস্থা

লেখক
আচার্য মন্ত্রেশ্বরানন্দ অবধূত

আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহে দেশের গণ্ডীকে মানা হয় না অর্থাৎ যেকোন দেশের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে যেকোন দেশের মেয়ে বা ছেলের বিয়ে হতে পারে৷  বাবা যে বিশ্বৈকতাবাদের কথা বলেছেন বিবাহ ব্যবস্থাকেও তার অন্যতম সোপান হিসাবে ব্যবহার করেছেন৷

এই বিবাহ ব্যবস্থায় ধর্মমতের কোন গোঁড়ামি নেই৷ যেকোন ধর্মাবলম্বী অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করতে পারেন৷ আনন্দমূর্ত্তি বলেছেন যে ‘‘মানবসমাজ এক ও অবিভাজ্য’’৷ বিবাহব্যবস্থা যাতে সেই অবিভাজ্য মানবসমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে সেদিকে তিনি নজর দিয়েছেন৷

এই বিবাহ ব্যবস্থায় জাত–পাতেরও বিচার করা হয় না৷ ‘‘অভিভাবকগণ পু––কন্যার বিবাহদান কালে দেশ–জাতি বিচার করবেন না বটে কিন্তু পাত্র–পাত্রীর গুণাগুণ অবশ্যই বিচার করবেন৷’’

আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে বিবাহ দেবার দরকার হয় না৷ এই বিবাহ ব্যবস্থায় আনন্দমার্গের আচার্যগণই পৌরোহিত্য করেন৷ মহিলা আচার্যারাও বিবাহ ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেন৷ একজন পাত্রপক্ষে অন্যজন পাত্রী পক্ষের হয়ে পৌরোহিত্য করবেন৷ পাত্রী পক্ষের হয়ে কোন মহিলা আচার্যা বিবাহ দেবেন৷ যদি কোন বিবাহে আচার্যা উপস্থিত না থাকেন তবে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ এই কাজ করতে পারেন৷

‘‘নিজের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝে বিবাহ সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসা উচিত৷ এই বিবাহ ব্যবস্থায় কাউকেই চাপ দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়৷ বিবাহ ধর্মসাধনার প্রতিবন্ধক নয়৷ বিবাহ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান৷’’

আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থা অনুযায়ী পণ দেওয়া ও নেওয়া সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়৷ এই বিবাহ ব্যবস্থায় ধার করে’ নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো স্বীকার করা হয় না৷

‘‘পণপ্রথা সামাজিক অবিচারের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত.....আমাদের ছেলেমেয়েরা চাল–ডাল, নুন–তেল বা গোরু–ছাগল নয় যে তাদের নিয়ে হাটে বাজারে দর কষাকষি চলবে৷’’

সংসৃক্ত বুঝুক না বুঝুক জোর করে’ এখানে বর কনেকে সংসৃক্ত ভাষায় মন্ত্রপাঠ করতে হয় না৷ নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই শপথ পাঠ করতে পারেন৷ যেমন ভাষা বাংলা হলে বলবেন ‘‘আমি আজ থেকে তার মানসিক শান্তি রক্ষায় ও মানসিক উন্নতি বিধানে সর্বপ্রকার সচেষ্ট থাকব’’৷

এই বিবাহ ব্যবস্থায় অচেতন অগ্ণিকে সাক্ষী রেখে ধর্মপত্নী গ্রহণ করতে হয় না৷ পরমব্রহ্মের নামে শপথ করতে হয়৷ যেমন ‘‘আমি পরম ব্রহ্ম তথা মার্গগুরুদেবের নামে শপথ করে বলছি শ্রীমতী.....আমি স্বেচ্ছায় স্ত্রীরূপে গ্রহণ করছি’’৷

সাধারণতঃ বিবাহ ব্যবস্থায় কনের কোন ভূমিকা থাকে না৷ আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ ব্যবস্থায় বরকেও যেমন শপথ গ্রহণ করতে হয় তেমনি কনেকেও মাতৃভাষাতে শপথ গ্রহণ করতে হয়৷ যেমন ‘‘আমি পরমব্রহ্ম তথা মার্গগুরুদেবের নামে শপথ করে বলছি, আমি..... কে স্বেচ্ছায় স্বামীরূপে গ্রহণ করছি’’৷

আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থায় নিমন্ত্রিতরা কেবল নির্বাক দর্শক নন৷ তাঁদেরও ভূমিকা রয়েছে৷ নিমন্ত্রিতদেরও শপথ নিতে হয়৷ যেমন ‘‘পরমব্রহ্ম তথা মার্গগুরুদেবের নামে শপথ করে বলছি, আমরা এই বিবাহে সাক্ষী রইলুম৷ করুণাময় ব্রহ্মের কৃপায় আমরা যেন এই নবদম্পতির সর্বাত্মক উন্নতিবিধানে যথাযথভাবে সাহায্য করতে পারি৷’’

আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থায়  কপালে সিঁদুর দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়৷ তবে ‘‘বর ইচ্ছা করলে বধূর সিঁথিতে সিঁদুর দেবে৷ বধূও ইচ্ছা করলে বরের ত্রিকুটিতে সিঁদুরের টিপ দিতে পারে৷’’

আনন্দমার্গের বিবাহ ব্যবস্থায় বিবাহের পূর্বে সঙ্গীত, কীর্তন ও সাধনা করে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ রচনা করা হয়৷ তাতে পাত্র–পাত্রীসহ নিমন্ত্রিতরাও অংশগ্রহণ করেন বা করতে পারেন৷

এই বিবাহ ব্যবস্থায় পাত্রীর পিতা পাত্রীকে সম্প্রদান করেন না৷ আনন্দমূর্ত্তি বলেছেন ‘‘ এ ব্যবস্থা নারীর পক্ষে সম্মানহানিকর৷ নারী কি চাল–ডাল–নুন–তেল যে তাকে তুলে নিয়ে অন্যের হাতে সমর্পন করলুম? নারী কি মুরগী বা ঢ্যাঁড়শ যে তাকে বস্তাবন্দী করে’ তুলে নিয়ে আর কাউকে বেচলুম বা দান করলুম? এ ব্যবস্থা নারীর পক্ষে অবমাননাকর তো বটেই–এতে মানুষ জাতির মর্যাদাও ভূলুণ্ঠিত হয়৷’’