আনন্দনগর বিশ্বের পথ নির্দেশক

লেখক
পথির বর

শাসকের রক্তচক্ষুর কাছে মাথা নত করে নয়, রাজশক্তির দয়া-দাক্ষিণ্যে নয়, নেতা মন্ত্রীদের তোয়াজ তোষামোদ করে নয়, জামালপুরের ছোট্ট একটা রেল কোয়ার্টার্স থেকে আনন্দমার্গ বিশ্ব সংঘটন হয়ে ওঠার পিছনে আছে বহু কর্মীর ত্যাগ তিতিক্ষা আত্মত্যাগের ইতিহাস৷ দুর্জয় সাহসে ভর করে সমস্ত বাধা-বিপত্তি দু’পায়ে দলে এগিয়ে চলার ইতিহাস৷

১৯৬৭ সাল, বাঙলার ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ৷ কংগ্রেস দলের ভাঙনকে সহায় করে বাঙলার রাজনীতিতে জড়বাদী কমিউনিষ্টদের উত্থান৷ খণ্ডিত কংগ্রেসের এক অংশের সঙ্গে জোট বেঁধে প্রতিষ্ঠিত হ’ল যুক্তফ্রণ্ট সরকার৷ বিরোধী অবস্থানে থেকে যে কমিউনিষ্টরা এত দিন উন্নয়নের বুলি কপচে গেছে, যুক্তফ্রণ্ট সরকারে তারা কোনও উন্নয়নমুখী দপ্তর চায়নি, রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করতে স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হ’ল জ্যোতি বসু৷

ঠিক ওই সময় পুরুলিয়ার আনন্দনগরে শুরু হয়েছে উন্নয়ন যজ্ঞ৷ তার কিছু আগে বাবা জামালপুর ছেড়ে চলে এসেছেন আনন্দনগরে৷ অবর্ণনীয় দুঃখ, দারিদ্রের মধ্যে জীবন যাপন করতো অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা আশপাশের গ্রামের মানুষগুলো৷ আনন্দমার্গের উন্নয়ন কর্ম তাদের বুকে আশা জাগাল, মুখে হাসি ফুটলো, নতুন জীবনের স্বপ্ণ দেখলো তারা আনন্দমার্গকে আশ্রয় করে৷ মানুষের দুঃখ-দারিদ্র অভাব -অনটন যাদের রাজনীতির পুঁজি আতঙ্কিত হলো সেই কমিউনিষ্ট শাসক-ঘাতকরা৷ আনন্দমার্গকে রুখতেই হবে৷ না হলে কমিউনিষ্টদের মুখোশ খসে পড়বে৷ অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুললো মিথ্যা প্রচার করে৷ ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আনন্দনগরে ঝাঁপিয়ে পড়লো কমিউনিষ্ট গুণ্ডা বাহিনী৷ সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে নিহত হলেন পাঁচ জন সর্বত্যাগী কর্মী৷ তাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি, তাই আনন্দমার্গ আজ এক বিশ্ব সংঘটন৷ আনন্দনগর আজ বিশ্বের আলোকবর্ত্তিকা, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মাধ্যম আর কমিউনিষ্টরা ডোডো পাখির মত লুপ্ত হতে বসেছে৷ পুরাণ বর্ণিত কাহিনীতে আছে দধীচি মুনি স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেছিলেন---তাঁর অস্থি দিয়ে তৈরী ব্রজতে আসুরি শক্তিকে বিনাশের জন্যে৷ আনন্দনগরে পাঁচজন সর্বত্যাগী কর্মীর আত্মত্যাগে প্রতিহত হয় পাপ শক্তি৷ প্রতি বছর এইদিন তাই দধীচি দিবস পালন করা হয় বিশ্বের আনন্দমার্গের সমগ্র ইয়ূনিটে৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---‘‘আনন্দনগরের বিশেষ মহিমা আছে, ও সেই মহিমাটি অনেক সাধকের অনেক ত্যাগের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে৷ সাধনায়, ত্যাগে তিতিক্ষায়, সাংস্কৃতিতে আনন্দনগর গোটা বিশ্বকে পথ নির্দেশনা দিক---এটাই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত৷’’

২দধীচিদের আত্মত্যাগে মহিমান্বিত

আনন্দনগর আজ বিশ্বের আলোকবর্ত্তিকা

নিজস্ব সংবাদদাতা ঃ আগামী ৫ই মার্চ দধীচি দিবস৷ পুরুলিয়ার উঁচুনীঁচু টিলা ও বনজঙ্গলে ভরা দুর্গম অঞ্চলে আনন্দমার্গের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ দেখে ভয় পেয়েছিল অন্ধকারের জীবেরা৷ তাই আনন্দমার্গকে ধবংস করতে ১৯৬৭সালের ৫ই মার্চ তদানীন্তন কমিউনিষ্ট সরকারের ঘাতক বাহিনী আনন্দনগর আক্রমন করে পাঁচজন সন্ন্যাসীদের হত্যা করে৷ সেই থেকে প্রতিবছর সারাবিশ্বে আনন্দমার্গ দধীচি দিবস পালন করে৷ পাপশক্তির সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে, জরুরী অবস্থার অন্ধকার দূরে সরিয়ে, পাপশক্তির পরাজয় ঘটিয়ে ১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে আনন্দনগরে আসেন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ আনন্দনগর তখন আসুরি শক্তির দখল মুক্ত হয়ে নতুন করে গড়ে উঠছে৷ ধর্মমহাচক্র উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের হাজার হাজার ভক্ত মার্গী ভাই-বোনও আনন্দনগরে সমবেত হয়েছেন৷ সেই দিন ধর্মমহাসম্মেলনে পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ঘোষণা করলেন---‘‘আনন্দনগর আমাদের বিশ্বপরিব্যাপ্তির প্রাণকেন্দ্র৷ আমাদের সর্বতোভাবে একে গড়ে তুলতে হবে৷ সর্বপ্রকার ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে এর দ্রুত উত্থান হয়, ও সমগ্র বিশ্বকে এ আলোকবর্ত্তিকা দেখাতে পারে৷’’

আজ আনন্দনগর বিশ্বের আলোকবর্ত্তিকা, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মাধ্যম৷ কিন্তু এই আনন্দনগর গড়ে উঠেছে বহু সাধকের ত্যাগ, তিতিক্ষায় আত্মদানে৷ আসুরি শক্তি অন্ধকারের জীবেরা এই আলোকবর্ত্তিকাকে নির্বাপিত করতে বার বার আঘাত হেনেছে আনন্দনগরে৷ কিন্তু আনন্দনগর অনির্বাণ এক দীপশিখা৷ কোন অশুভ শক্তির পক্ষেই তাঁকে নির্বাপিত করা সম্ভব নয়৷ তার ওপর আঘাত হানতে গিয়ে সেই পাপশক্তি তার নিজের সৃষ্টি পাপের আগুনে ভস্মিভূত হয়ে গেছে৷

১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ৷ তার অনেক আগে থেকেই---১৯৬২ সাল থেকেই আনন্দনগরে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়৷ তৎপর হয়ে ওঠে পাপশক্তি৷ দুর্গম ওই অঞ্চলের উন্নয়নের ছোঁয়া সহ্য হ’ল না পাপশক্তির৷ ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে এক অংশ কম্যুনিষ্টদের সঙ্গে হাতমিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার ঘটন করে৷ আনন্দনগরের উন্নয়ন দেখে সবথেকে বেশী আতঙ্কিত হয়েছিল কম্যুনিষ্টরা৷ কারণ অভাবগ্রস্ত সমস্যা জর্জরিত মানুষই ওদের রাজনীতির মূলধন৷ স্বভাবতই আনন্দমার্গ ওদের বিষনজরের শিকার হ’ল৷ স্থানীয় সহজ সরল মানুষদের ভুল বুঝিয়ে আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে ক্ষিপ্ত করে তুললো৷ এই কাজে স্থানীয় কম্যুনিষ্ট নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় ব্লকের বিডিও যুক্ত ছিল৷ ১৯৬৭ সালে ৫ই মার্চ সেই ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে কম্যুনিষ্ট গুন্ডারা আনন্দনগর আক্রমণ করে৷ পাপশক্তির আক্রমণ রুখতে গিয়ে সেদিন পাঁচজন সন্ন্যাসী নিহত হন৷ তাঁরা হলেন ১) আচার্য অভেদানন্দ অবধূত, ২) আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, ৩) আচার্য অবোধ কুমার ব্রহ্মচারী, ৪) আচার্য প্রবোধ কুমার ব্রহ্মচারী, ৫) আচার্য ভরত কুমার ব্রহ্মচারী৷

কিন্তু সেই পাপশক্তি আজ লুপ্ত প্রায়৷ আনন্দমার্গ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের ঘরে ঘরে৷ পুরাণের গল্প অনুযায়ী মহামুনি দধীচি অসুর বিনাশে দেহত্যাগ করেছিলেন৷ আনন্দমার্গের মহান সন্ন্যাসীরাও পাপশক্তির বিনাশ করতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন৷ তাই পাপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে যাঁরা জীবন দেন তাঁদেরকে দধীচি হিসেবে শ্রদ্ধা জানানো হয়৷ তাঁদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নি৷ আনন্দনগর আজ আনন্দমার্গের বিশ্বপরিব্যাপ্তির প্রাণকেন্দ্র, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মাধ্যম, বিশ্বের আলোকবর্ত্তিকা৷