‘সর্বাজীবে সর্বসংস্থে ক্ষৃহন্তে তস্মিন্ হংসো ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রে৷
পৃথগাত্মানং প্রেরিতারঞ্চ মত্বা জুষ্টস্ততস্তেনামৃতত্৷৷’
তোমরা জান বিশ্বের সবাই পরমপুরুষের সন্তান৷ তিনিই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন৷ তিনিই সৃষ্টি করেছেন এই জগৎকে, সৃষ্টি করেছেন এই সমস্ত জীবিত প্রাণীকুলকে৷
এখন যেহেতু তিনি এই জড় জগৎকে, এই অস্থাবর অচেতন জগৎকে, সমগ্র উদ্ভিদ ও মনুষ্যসহ বিশাল প্রাণীজগৎকে সৃষ্টি করেছেন, তাই সাধারণ ক্ষুদ্ধি একথাই বলে যে এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরমপুরুষের সমস্ত সন্তানদের যৌথ সম্পত্তি৷ জাতি,ধর্মমত, জাতীয়্ অথবা ভৌতিক, শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক শক্তি নির্বিশেষে সবাইকার এটা এজ্মাইলী সম্পত্তি৷ নীচ ও হীন বৃত্তির প্রেষণায় কায়েমী স্বার্থবাহীরা প্রাণী জগতে, বিশেষ করে মানুষে মানুষে ভেদভাব সৃষ্টি করে৷ তাই যারা অপরকে শোষণ করে, অনকে ন্যায়সঙ্গত পৈতৃক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এই সৃষ্ট জগতের যাবতীয় সম্পদকে কুক্ষিগত করতে চায় তারা অবশ্যই সমাজের শত্রু, মানবতার শত্রু, সংস্কৃতিপরায়ণ ও সভ্য জগতের শত্রু৷
‘সর্বাজীবে সর্বসংস্থে বৃহন্তে৷ তাঁর সৃষ্ট জীবেরা, তাঁর স্নেহের পুত্র-কন্যারা তাঁর চারপাশে ঘুরে চলেছে৷ তারা পরমপুরুষ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে থাকতে পারে না৷ কেন না পরমপুরুষ হলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম চক্রনাভি, অন্যেরা তার চার দিকে শুধু ঘুরে চলেছে৷ যেমন ক্ষুদ্র আণবিক সংরচনায় অসংখ্য ইলেক্ট্রন তাদের কেন্দ্রবিন্দুর চারদিকে অবিরাম ঘুরে চলে তেমনি পুরুষোত্তম বা পরমপুরুষ রয়েছেন কেন্দ্রবিন্দুতে আর তাঁর সৃষ্ট অন্য সবাই তাঁর চারপাশে ঘিরে তাঁকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে, নেচে চলেছে৷ এই যে অজস্র সত্তা চক্রনাভি পরমপুরুষের চারদিকে ঘুরে চলেছে, তাদের প্রত্যেকের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাগতিক ও মানসিক আজীব ও আভোগ৷
সকলের ভৌতিক চাহিদা সমান নয়, তাই বলেছি যে ঘূর্ণমান বস্তুসমূহ, সত্তাসমূহ তাদের নিজের নিজের আভোগ হ্ম্ত্রত্ব্ব্ভপ্তব্ভপ্পগ্ নিয়ে ঘুরে চলেছে৷ তেমনি সবাইকার মানসিক এষণা, মনের আশা-আকাঙক্ষা বৃত্তি এক নয়৷ শ্লোকটিতে ‘আজীব’-শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে৷ আজীব মানে প্সন্তুন্তুব্ভহ্ম্ত্রব্ধ বা জীবিকা৷ এই আজীব সত্তার মানসিক ও ভৌতিক দুইই হতে পারে৷ এটা একটা তথ্য যে বিভিন্ন সত্তা তাদের পৃথক পৃথক ভৌতিক ও মানসিক আভোগ নিয়ে বেঁচে থাকে৷ এর মানে এই নয় যে একের জাগতিক বা মানসিক আভোগ অন্যে কেড়ে নেবে৷ যারা তা করে বা করবার চেষ্টা করে, আমার মতে তারা মানব সভ্যতার শত্রু, বিশ্বস্রষ্টার অভিশপ্ত সন্তান৷
‘সর্বাজীবে সর্বসংস্থে’৷ আপন মনের বৃত্তি-এষণা-আশা-আকাঙ্ অনুযায়ী বিভিন্ন জীব ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক আধার পেয়ে থাকে৷ এই আধার তাদের দরকার মনের আশা-আকাঙক্ষা-বাসনা পরিতৃপ্তির জন্যে৷ তাই জীবিত প্রাণীদের কেউ কেউ পেয়েছে জন্তুদেহ, কেউ বা কীট-পতঙ্গের শরীর, কেউ বা জন্মেছে গাছপালা হয়ে, আবার কেউ বা পেয়েছে মানবদেহ৷ আবার যারা মানব সংরচনা পেয়েছে তারাও তাদের অন্তর্নিহিত সংস্কারের পার্থক্যের দরুণ একে অন্যের থেকে পৃথক পৃথক৷ এই সংস্কারগত পার্থক্যের দরুণ বিশ্বের চক্রনাভি থেকে বিভিন্ন জীবিত সত্তার ব্যাসার্ধগত দূরত্বেও তারতম্য রয়েছে৷ কেউ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম কেন্দ্রবিন্দু থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে, কেউ বা কয়েক ফুট দূরে, কেউ বা কয়েক মাইল দূরে৷ তবে কেন্দ্রবিন্দুর চারদিকে ঘুরে চলেছে সবাই, তাদের ব্যাসার্ধের দূরত্বটা কারো ক্ষেত্রে কম, কারো ক্ষেত্রে বেশী৷ পরম পিতার চারদিকে কেউ বা ঘুরে চলেছে একভাবে, কেউ বা অন্য ভাবে, কেউ বা আরও অন্য ভাবে কিন্তু ঘুরে চলেছে সবাই’ওই আপন আপন সংস্কারের দরুণ নিজের নিজের ব্যাসার্ধগত দূরত্ব বজায় রেখে৷ ঘুরতে সবাইকে হবেই৷ আর ঘুরে চলবে যেমন ইলেক্ট্রনগুলো তাদের নিজস্ব নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতেই থাকে৷
‘সর্বাজীবে সর্বসংস্থে’৷ তাহলে দেখছি সবাই, সকল জীবিত সত্তাই নিজের নিজের ভৌতিক ও মানসিক আভোগ নিয়ে, শারীরিক সংরচনা নিয়ে আপন আপন ভাবে ঘুরে চলেছে৷
মানুষ যখন স্থূল থেকে স্থূলতর লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে তখন ভূমাকেন্দ্র থেকে তার দূরত্বটা অর্থাৎ ব্যাসার্ধের দূরত্বটা বেড়ে যায়৷ অর্থাৎ সে কেন্দ্রবিন্দু থেকে আগের তুলনায় বেশী দূরে সরে যায়৷ এর কারণ তার চিন্তা ও কর্মের স্থূলতা৷ মন যখন ক্রমশঃ স্থূল থেকে স্থূলতর চিন্তা ও কর্ম করতে থাকে তখন তার ব্যাসার্ধের দূরত্ব বেড়ে যায়৷ আবার উল্টো দিকে মানুষের চিন্তা ও কর্ম যখন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর পথে এগিয়ে চলে তার ব্যাসার্ধের দূরত্বও কমতে থাকে৷ আর কমতে কমতে একদিন এমন একটা সময় আসে, এমন এক শুভ মুহৃর্ত্ত আসে যখন সেই ঘূর্ণমান সত্তাটা তার পৃথক অস্তিত্ব হারিয়ে ভূমা কেন্দ্রের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ এই অবস্থাটাকে বলা হয় মোক্ষ৷
‘তস্মিন হংসো ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রে’৷ এখানে ‘হংসো’-মানে মানুষ, জীবিত সত্তা৷ জীবের বীজমন্ত্র হ’ল ‘হংসো’৷
প্রতিটি সত্তার একটি করে বীজমন্ত্র থাকে৷ যেমন এই বিশাল বিশ্বসৃষ্টির বীজমন্ত্র হ’ল ‘অ’ধ্বনিটি৷ জ্ঞান বা বিদ্যার বীজমন্ত্র হ’ল ‘ঐ’ আর এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বজগতের বীজমন্ত্র হ’ল ‘ক’, নভোমণ্ডল বা আকাশের বীজমন্ত্র হ’ল ‘খ’, এনার্জি বা রজোগুণী শক্তির বীজমন্ত্র হ’ল ‘র’, তেমনি ‘হংসো’ জীবের বীজমন্ত্র৷
’তস্মিন্ হংসো ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্র’৷ এই হংস বা জীব ভ=চক্রে বা ভূমামানসে আপন ধারায় ঘুরে চলেছে৷ সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম চক্র হ’ল অণুচক্র বা আণবিক চক্র৷ আণবিক চক্রের চেয়ে বড় হ’ল ব্যোমচক্র৷ আণবিক চক্রে থাকে একটি ছোট্ট কেন্দ্রবিন্দু আর সেই কেন্দ্রবিন্দুর চারদিকে ঘুরে চলে বহুসংখ্যক ইলেক্ট্রন৷ ব্যোম চক্রের কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের এই পৃথিবী গ্রহ আর তার চারদিকে ঘুরে চলেছে চন্দ্র উপগ্রহ৷ তেমনি ব্রহ্মচক্রের কেন্দ্রবিন্দু হলেন পুরুষোত্তম আর জড়-চেতন নির্বিশেষে সব সত্তাই তার চারপাশে ঘুরে চলেছে৷
‘পৃথগাত্মানং প্রেরিতারঞ্চ মত্বা’৷ সকল সত্তাই পুরুষোত্তমের চারদিকে ঘুরে চলবে ততদিনই যতদিন তারা ভাববে যে তারা ও তাদের কেন্দ্রবিন্দু (সৃষ্টি ও স্রষ্টা) একে অন্যের থেকে পৃথক৷ যেদিন তারা অনুভব করবে যে, ‘আমি আমার পরম পিতার এক অভিন্ন অংশ, আমাকে তাঁর সঙ্গে মিলেমিশে এক হতে হবে’, সেদিনই তারা এই অতল অপার দিব্য অমৃত স্রোতে পুরুষোত্তমের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাবে৷
সে অবস্থায় হয় কী? ‘জুষ্টস্ততস্তেনামৃতত্’৷ সৃষ্ট জীবেরা অমৃতত্ব লাভ করে৷ তোমরা জান, অমৃতত্ব লাভ ব্যাপারটা জীবের সীমিত সামর্থ্যের ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ এ জন্যে পরমপুরুষের কৃপা হ’ল একটা অত্যাবশ্যক প্রাক্শর্ত আর এই যে পরমপুরুষের কৃপা এটা সর্বদাই সকলের ওপরেই সমান ভাবে বর্ষিত হয়ে চলেছে, এতে কোন অধিকার-অনধিকারের ভেদরেখা নেই৷ অতএব অমৃতত্ব লাভের অধিকার মানুষ মাত্রেরই জন্মসিদ্ধ অধিকার৷ যারা মানুষকে সেই জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায় তারা মানব জাতির শত্রু, মানব রূপী দানব৷ আমি চাই, তোমরা এই সব নররূপী দানবদের মুখোস খুলে দাও ও সর্বপ্রকার শোষণরহিত একটা বলিষ্ঠ সমাজ গড়ে তোল৷ লক্ষ্য রেখো, যাতে মানুষকে, জীবজন্তুকে শোষণ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ না থাকে৷
(পটনা, ৬ই অক্টোবর, ১৯৭৮)