অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির পথ হ’ল সমবায় আন্দোলন

লেখক
প্রভাত খাঁ

বর্তমানে অতি পুরাতন শব্দ সমবায়ের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাটা উঠে আসছে পত্রপত্রিকাতে৷ উপনিষদের সেই ‘সংগচ্ছধ্বং’–এর মধ্যেই নিহীত আছে সমবায়৷ কথা প্রসঙ্গে বলতেই হয়–এক সময়ে এদেশে ‘সোণার বাংলা’ কথাটা খুবই প্রচলিত ছিল৷ যখন সাত সমুদ্র তের নদীর পার হতে এদেশে ইংরেজ বণিকরা আসেনি, যখন সারা বাঙলায় প্রায় প্রতিটি গ্রামই স্বয়ং সম্পূর্ণ ছিল সব দিক থেকে৷ তখন গ্রামের জনসাধারণকে কোন কিছুর জন্যে বাইরের দিকে তাকাতে হত না বা নির্ভরশীল হতে হত না৷ বড় বড় পরিবারগুলি ছিল একান্নবর্ত্তী পরিবার৷ সেই পরিবারের যা যা প্রয়োজন তারা তা কুটির শিল্পের মাধ্যমেই পূরণ করে নিত৷ ক্ষেত খামারে যা ফসল উঠতো তার দ্বারা ও কুটির শিল্পের মধ্য দিয়ে পুষিয়ে নিত সব কিছু৷ গ্রামে তাই অভাব বোধ হত না৷ কুমোর হাড়ি, কলসী, কড়াই ইত্যাদি নির্মাণ করতো, কামার বঁটি, কাস্তে, কাটারি, কুঠার ইত্যাদি নির্মাণ করতো, নাপিত চুল দাড়ি কামাতো, মুচি জুতা তৈরী করতো, মোদক মিষ্টান্ন তৈরী করতো, কলু তেল তৈরী করতো ঘানিতে৷ তাঁতি তাঁত বুনতো, কাপড়, গামছা তৈরী করতো, কবিরাজ  গাছগাছড়া হতে ওষুধ তৈরী করতেন ও রোগে সেবা দিতেন, শিক্ষক শিক্ষা দান করতেন৷ আর ঢেঁকি ও চাকিতে ধান ভানা হতো ও গম ভাঙ্গানো হতো৷ কৃষি ভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প যা যা প্রয়োজন গ্রামগুলিতে গ্রামের নারীগণ তৈরী করে নিতেন৷ আর বিনিময়টাও ছিল অতি সাধারণভাবে বস্তু বিনিময়ে, সেটা চলতো (বার্টার) পদ্ধতিতে৷ এখনোও এই বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে চাল, আলু, ইত্যাদি দিয়ে মুদির দোকানে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকে৷ তাদের সরল সাধাসিধা জীবন চলে৷

ইংরেজ শাসনে গ্রামের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয় ধীরে ধীরে৷ শিল্প বিপ্লবের ফলে শহরের কলকারখানায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎপাদন হতে লাগল অল্প সময়ে৷  শিল্পে উৎপাদিত জিনিসের দাম কম হলো৷ তাছাড়া কুটির শিল্প প্রতিযোগিতায় তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলো না৷ গ্রামের মানুষ শহরে কলকারখানায় কিছু কিছু লোক কাজ পেল৷ কুটির শিল্পে উৎপাদিত সামগ্রীর দাম কলকারখানায় তৈরী জিনিসের মত সস্তা হ’ল না৷ তাই কুটির শিল্প মার খেল৷ গ্রামের মানুষ বেকার হয়ে পড়লো৷ তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বাজার পেল না৷ সোণার বাংলা শ্মশান হয়ে গেল৷ এই দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস সকলের জানা৷ পরিবারগুলো ছোট ছোট হয়ে পড়লো৷ বড় বড় ব্যবসাদার ও শিল্পপতিরাই ভাগ্যবিধাতা হয়ে বসলো৷ অর্থের নিয়ন্ত্রণটা তারাই করতে লাগলো৷ প্রাচীনকালের সোণার বাংলার সমাজতান্ত্রিক রূপটি হারিয়ে গেল ব্যষ্টি কেন্দ্রীক ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শোষণের আড়ালে৷ একান্নবর্তী পরিবারগুলির সেই যে সুন্দর ছবি তা হারিয়ে গেল৷ আমরা দেখেছি চাষীর ছেলে চাষ করেও লেখাপড়া শিখে ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক হয়েছেন৷ তাঁরা পিছনে পড়ে ছিলেন না৷ আজকের মত সেদিন পড়াশুনা করার সুযোগ সুবিধাটা তো ছিল না তাই এঁরা সংখ্যায় অল্প হতেন৷ সেদিনের লেখাপড়ায় ছিল অধ্যাত্মবাদ ও আন্তরিকতা৷ তবে সেদিন গ্রামে যে বিবাদ, বিসংবাদ, মারামারি অত্যাচার ছিল না তা নয়৷ জমিদার ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা জুলুম, অত্যাচার করতো৷ আজ পুরাতন গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা, একেবারে ভেঙ্গেচুরে গেছে৷ হূদ্যতা, আন্তরিকতা, সরলতা ভ্রাতৃত্ববোধ যেন সমাজ থেকে উঠে গেছে৷ আজ সেই বিদেশী শাসন নেই, জমিদার শ্রেণীর অত্যাচার নেই ঠিক কিন্তু জুলুম, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, বহুগুণ বেড়েছে৷ আজ জমিদারদের স্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা৷ গ্রামের পরিবেশ নোংরা রাজনৈতিক দলাদলিতে বর্তমানে ধ্বংস হয়ে গেছে৷ শহর– শহরতলির ও নগরের পরিবেশ প্রায় সর্বদাই অগ্ণিগর্ভ৷ দুর্নীতি, বেকার সমস্যায় নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবন মৃতপ্রায়৷ জীবনে নানা সমস্যায় মানুষ দিশেহারা৷ আজ জীবনে নিরাপত্তাহীনতাই সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ কি করে খাবো, কি করে সংসার চালাবো, মা,বোনদের রক্ষা করবো কি করে এটাই মানুষকে দিশেহারা করে দিয়েছে৷

এই যে কঠিন পরিস্থিতি এর হাত থেকে বাঁচতে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টায় সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সেই গ্রাম–শহরের নাগরিকদের মিলিত ভাবে সমবায় গড়ে তুলতে হবে৷ শুধু সরকারের ও দুষৃকতকারীদের অপচেষ্টার সমালোচনা করলে চলবে না৷ প্রতিরোধ গড়তেই হবে৷ বাঁচার পথ খুঁজতে হবেই৷ তাই বলি ব্লকে ব্লকে, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বেসরকারী ভাবে সেই অতীতের ছোট ছোট কুটির শিল্পগুলিকে বর্তমানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমবায় পদ্ধতিতে গড়ে তুলতে হবে৷ এই কাজে গ্রাম ও শহরের তরুণ–তরুণীদের উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে৷ মূলধন স্থানীয় ভাবে যোগাড় করে নিতে হবে৷ মালিকানায় তারাই থাকবে৷ মিলেমিশে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ৷ সমবেত প্রচেষ্টা অবশ্যই নোতুন দিগন্ত খুলে দেবে৷ প্রান্তিক চাষীরা যেমন এক হয়ে চাষ করে নিজেদের সমস্যা মেটাতে পারবে ঠিক তেমনই কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক কুটির শিল্প গড়ে সমবায়ের মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূর করে তারা নিজেরা স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে৷ মহাকাল এগিয়ে চলেছে, জীবনের সকল সমস্যাকে মোকাবিলা করে যারা এগোতে পারে তারাই বাঁচতে পারে৷ কারণ সংগ্রামই জীবন৷ আজ অতীতের বড় বড় কলকারখানাগুলো সামাজিক পরিবর্ত্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ আজ দেশী–বিদেশী বেনিয়াদের দ্বারা  দেশ শাসিত হচ্ছে না, আজ দেশের লোক দেশ শাসন করছে কিন্তু তাঁরা দীর্ঘ ৬৫ বছরে দেশের উন্নতি করাতো দূরের কথা দেশকে অস্থি চর্মসার করে ছেড়েছে আর লুটে পুটে খাচ্ছে৷ তারা অধিকাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত৷

তাই বিকেন্দ্রীকভাবে গ্রামে গ্রামে ব্লকে ব্লকে সমবায়ের মাধ্যমে কুটির শিল্প গড়ে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও সেই ভোগ্যপণ্য বিক্রয়ের পথে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে৷ মনে রাখতে হবে যে সমবায়কে ছল চাতুরীর দ্বারা ধনী ব্যবসাদাররা  ও তাদের সাকরেদরা ধ্বংস করে জনমানসে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে যে সমবায় আর্থিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ৷ কিন্তু প্রকৃত সত্য হ’ল এই যে, সমবায় ব্যবস্থাই একমাত্র পারে ধনতান্ত্রিক শোষণ ও রাষ্ট্রীয় (সরকারী) কমিউনিষ্ট (সাম্যবাদী) শোষণ থেকে সমগ্র মানব সমাজকে মুক্ত করতে৷ এই দুই ব্যবস্থাই দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বঞ্চনা ও শোষণের ভিত্তিতে৷ মনে রাখতে হবে–শোষণের ওপর সমৃদ্ধিটাই হলো তাদের মূল লক্ষ্য৷ মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব–প্রাউট সেই কারণে সার্বিক অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে বিশ্বের মানব সমাজকে বাঁচাতে ব্লকভিত্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার আহ্বান দিচ্ছে সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে৷

‘ধনতন্ত্র ভাতে মারে আঁতে মারে কমিউনিষ্ট

তাই তো মোরা প্রাউটিষ্ট৷’

* * * *

অন্ন চাই বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই

তাই তো মোরা প্রাউট চাই৷

প্রাউটের স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল (সমাজ) বলতে কী বোঝায়?

প্রাউটের মতে কোন বড় দেশে সমগ্র এলাকার সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ওই দেশকে প্রয়োজনে একাধিক সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলে ব্দপ্সন্তুন্প্স–ন্দ্বন্ত্ ব্ভুন্ব্ধবু বিভক্ত করা উচিত ও প্রতিটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ নিজ এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্যে পৃথক পৃথক ভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা বাঞ্ছনীয়৷ যে সমস্ত বিষয়গুলির ভিত্তিতে এই বিভাজন করা হবে তা হ’ল–

            ১)   একই ধরণের অর্থনৈতিক সম্পদ ও সমস্যা৷ তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার সম্ভাবনা হ্মপ্সব্ধন্দ্বুব্ধন্ত্র৷

            ২)   সম ভাষা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সামাজিক প্রথা প্রভৃতির ওপর গড়ে ওঠা একই সেণ্টিমেণ্টাল লিগ্যাসি৷

            ৩)   একই জাতিগত বৈশিষ্ট্য৷

            ৪)   একই ধরণের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি৷

এই নীতি অনুসারে ভারতবর্ষের সমগ্র এলাকার তথা সকল জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে একে মোটামুটি ৪৪টি সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চলে (প্রাউট দর্শনে এক সংক্ষেপে ‘সমাজ’ও বলা হয়) বিভক্ত করে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা উচিত৷ যেমন সমগ্র বাংলা তথা বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা উচিত একটি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ প্রাউটের পরিকল্পনা নীতি অনুসারে ভারতের অন্যান্য সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা সমাজগুলি হবে ঃ–উৎকল, কোশল, লেপ্চা, ভুটিয়া, বোড়ো, অসমিয়া, অঙ্গিকা, মিথিলা, মগ্হী, ভোজপুরী, নাগপুরিয়া, অবধি, ব্রজ, হরিয়ানবি, গাড়োয়ালী, কুমায়ুন, পঞ্জাবী, সিরমৌরী, পাহাড়ী, কিন্নৌরী, ডোগ্রী, কশ্মীরী, লাদাকী, মাড়োয়ারী, হদৌতি, মেওয়ারী, কচ্ছী, কাথিয়াড়, গুর্জর, বিদর্ভ, সহ্যাদ্রি, মালোয়া, বুন্দেলখণ্ড, বাঘেলী, ছত্রিশগড়ী, তেলেঙ্গানা, সরকার, রয়ালসীমা, তামিল, মালায়লম্, কান্নাড়া ও টুলু সমাজ ইত্যাদি৷

প্রাউট যে ভারতে ৪৪টি সমাজ রচনার কথা বলছে, তার মানে এই নয় যে ৪৪টি পৃথক রাজ্য গড়তে হবে৷ এখানে পৃথক পৃথক রাজ্য তৈরীর কথা বলা হচ্ছে না, মূলতঃ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে৷ একই রাজ্যের মধ্যে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকতে কোন বাধা নেই৷ তবে সেক্ষেত্রে প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে৷ তাদের ন্যায্য দাবী তথা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না৷ এই অঞ্চলের জন্যে পৃথক বাজেটও মেনে নিতে হবে৷