রাত্রি যতই গভীর হয় প্রভাত ততই এগিয়ে আসে৷ তামসী বিভাবরীর ভ্রূভঙ্গী ও প্রহেলিকা ভেদ করেই তবে ঊষার আগমনে বিভা ছড়িয়ে পড়ে ও পূবের আকাশে অরুনিমায় উদভাসিত হয়ে ওঠে৷ এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম--- জাগতিক পদ্ধতি৷ তাইতো কবিও গেয়েছেন, ‘‘মেঘ দেখে কেউ করিস্নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে৷’’ দুর্র্যেগের ঘনঘটা যতই হৃদয়-বিদারী হোক, জাগতিক সুখ যেমন চিরস্থায়ীত্ব পেতে পারে না৷ তদ্রূপ দুর্র্যেগ দুর্দৈবও চিরস্থায়িত্ব লাভে অপারগ৷ সুতরাং ভয়ের কিছুই হতে পারে না আশংকারও যৌক্তিকতা রয়েছে বলে ভাবতে পারি না৷ তবে হ্যাঁ, চোখের সামনে থেকে, বুকের কাছ থেকে ছুঁ মেরে অতর্কিতে বাজপাখী শকুনেরা,শ্বাপদ-হাঙ্গরেরা,এমনকি দ্বিপদ রাক্ষস-পিশাচ-দানবেরা কোন মানুষকে তুলে নিয়ে যায় ও পরে তার কোন হদিশ মেলে না, এমনতর ঘটনা মানুষের সমাজে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, মহান দেশের ততোধিক মহান (যদিই তাদের ঘোসণা আর প্রচারণা প্রতারণার নামান্তর না হয়ে থাকে) নেতৃত্বের সুমহান প্রশাসনের আওতায় থেকেও অপহৃতদের চুলমাত্র সন্ধান মেলে না৷ তখন কি মানুষের মনে স্থিরতা বিরাজ করতে পারে? পারে কি মানুষের মন তার ধৈর্য সামলে রাখতে? বিশ্বাস, ভক্তি-শ্রদ্ধা অটুট রাখা কি সম্ভব রাষ্ট্রের তথা রাজ্যের নেতা-নেত্রীদের গালভরা ভাষণ আর অর্গলমুক্ত মুখ- হা করা প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা রাখা? তাই সহৃদয় সম্মানিত পাঠকবর্গের সকাশে বিনীত অনুরোধ রইল, ত্রিপুরা রাজ্যের অতীত ও বর্তমানের ঘটনা-পরম্পরার নিরিখে আমার উপরিবর্ণিত কথাগুলো আপনাদের বিবেক-চেতনার সঙ্গে মানবতার স্বার্থে অন্ততঃ একবার মিলিয়ে দেখবেন৷
তবে, প্রশ্ণ উঠতেই পারে, কেন নিবন্ধকারের এই অনুরোধ রাখা ও তদনুরূপ প্রত্যাশা করা? মূলতঃ এই যথাযথ প্রশ্ণটির মীমাংসাকল্পেই এই নিবন্ধটি রচনার অনুপ্রেরণা পেয়েছি৷
রাজ্যবাসীমাত্রেই জানেন, বিগত কয়েক দশক ধরে পাশ্ববর্তী রাজ্য মিজোরাম থেকে ত্রিশ/বত্রিশ হাজারের মত ‘রিয়াং’নামীয় জনগোষ্ঠীর লোকেরা ত্রিপুরায় এসে ‘‘শরণার্থী ’’পরিচয় বসবাস করছেন৷ উত্তর ত্রিপুরা জেলার কাঞ্চনপুর মহকুমার দশদা ব্লকের অন্তর্গত বিভিন্নস্থানে তাদের আবাসস্থল শরণার্থী ক্যাম্পগুলো রয়েছে৷ রাজ্য সরকার তাদের জন্যে দিল-দরিয়া আর কেন্দ্রীয় সরকার উদার হস্ত বলেই এতকাল যাবৎ তাদের ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব সামলে চলেছেন৷ সেজন্যেই উক্ত উভয় সরকারেরই নেতৃবর্গ, আমলাকুল শুভানুধ্যায়ী সকলেই প্রশ্ণাতীতভাবে ধন্যবাদই বললেই চলে না ---তারা কুর্ণিশ পাবারই যোগ্যও বটে! কেননা শাস্ত্র বলেছেন ---‘‘উদার চরিতানাম্ তু বসুধৈব কুটুম্বকম্৷’’ সুতরাং উদার হৃদয়বত্তার কোন তুলনা চলে না৷ বস্তুতঃ এই নিবন্ধকারও একজন ‘মানুষ’ হিসেবে রিয়াং---শরণার্থীদের নিয়ে বিন্দুমাত্র অনিচ্ছা, অসন্তোষ, বিদ্বেষ, ঈর্ষা কাতরতা হিংসা শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা ইত্যাদির---কোনটারই প্রশ্রয় দেন না মনে কোনরূপ পক্ষপাতিত্বও স্থান দেন না৷ তথাপি কিছু প্রশ্ণের অবতারণা এখানে করা হয়েছে অতীব যথাযথ কারণেই৷ প্রশ্ণগুলো ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দিলুম মাত্র ঃ--- (১) মিজোরাম ও ত্রিপুরা দু’টো পৃথক পৃথক রাজ্য হলেও একই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত৷ তাই মিজোরাম উৎখাত হওয়া ত্রিপুরায় আশ্রিত রিয়াংদের ‘শরনার্থী’ আর ‘রাজ্যন্তরী’--- কোন্টা বলা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত সেটি নিয়ে বিদগ্দজনেরা ভেবে দেখবেন না কেন? (২) কোন বিশেষ যুক্তিগত কারণেই যদি উক্ত রিয়াং আশ্রিতরা মিজোরাম থেকে উৎখাত হয়ে গিয়ে থাকেন, তবে সেই যুক্তিগত কারণ কী ছিল, সেটা ত্রিপুরা রাজ্য-সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার রিয়াংদের ত্রিপুরায় পুনর্বাসন দেবার কথা ভাবার পূর্বে খুঁজে নেবার প্রয়োজন বোধ করেন নি কেন? মিজোরাম রাজ্য-সরকারের স্পষ্ট জবাবটুকু কি ভারতবাসী হিসেবে ত্রিপুরাবাসীদের সহ ভারতবাসীদেরও জানার প্রয়োজন মনে করছেন না তারা৷ তাই যদি হয়, ভারত একদেশ এক প্রাণ এক সংবিধান সেকি শুধুই ঘুম-পাড়ানী গান, না ভদ্রজনোচিত ঘোষণা ও রাষ্ট্রীয় ফরমান?
(৩) যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বয়ং ইন্দিরাজীই আমাদের সংবিধানে ‘‘সেকুলার’’ শব্দটির সংযোজন কারিনী ছিলেন৷ রাজীব গান্ধীর আমলেই সম্ভবতঃ লোকসভার নির্বাচন প্রার্থীদের হলফনামা জমা দেবারও রীতি চালু হয়েছিল যে তারা সেক্যুলরিজমে বিশ্বাসী৷ তাই যদি হয়, তবে কী সে কি শুধুই লোকসভার-নির্বাচন প্রার্থীদের জন্য হবার কথা, না রাষ্ট্রীয় আইনরূপে প্রযোজ্য হবার কথা? যদি রাষ্ট্রীয় আইনরূপে গ্রাহ্য হবারই হয়, তাহলে মিজোরাম সরকার তা অমান্য করেছেন বা করছেন কোন বৈধ নিয়মে বা আইনে?
- Log in to post comments