সাধকের জীবনের কর্মধারা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’৷ মানুষ কাজ করবে, আর কাজ করার সময় মনে রাখবে যে, সে যা কিছু করছে আত্মমোক্ষের জন্যে৷ কিন্তু কোনো মানুষ যদি কেবলমাত্র আত্মমোক্ষের জন্যে সাধনা করে, অথচ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না–এ অবস্থায় তাকে কি আমরা স্বার্থপর বলব না? যদি সে জনসেবা না করে, যদি জনসাধারণের জন্যে তার মনে কোনো সহানুভূতি না থাকে, কেবলমাত্র আত্মমোক্ষের জন্যে সাধনা করে চলে, তার মধ্যে আত্মার প্রতি অনুরাগ থাকলেও তাকে আমরা স্বার্থপর বলব৷
‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’ –জীবন ধারণের উদ্দেশ্য কী? খাচ্ছ, পরছ, পৃথিবী থেকে সেবা গ্রহণ করছ, তাহলে পৃথিবীকেও তো কিছু দিতে হবে নাহলে তো মৃত্যুর সময় তোমার অনেক ঋণ থেকে যাবে৷ তখন এই ঋণ সুদ সহ পরিশোধ করার জন্যে আবার তোমাকে পৃথিবীতে আসতে হবে৷ জগৎ থেকে সেবা নিয়ে চলেছ, কিন্তু জগতকে কিছু দিলে না, এ তো চলবে না জগৎ থেকে যতখানি তুমি নিয়েছ, তার থেকে যদি বেশী দাও, তাহলে কী হবে? তুমি সুদ পাবে৷ সুদ তুমি নাও, আর না নাও, সেটা তোমার ওপর নির্ভর করবে৷ কিন্তু তোমার ঋণের ক্ষেত্রে তা হবে না৷ ঋণ তো পরিশোধ করতেই হবে৷ তাই একথা মনে রাখতে হবে, জগতে এসেছ, জগতের সেবা করার জন্যে৷ অবশ্য কেবল জগতের সেবা নয়, আত্মমোক্ষের সাধনা যে করে না, তার দ্বারা জগতের সেবা হবে না৷ সে স্বার্থপর হয়ে যাবে৷ আর আত্মমোক্ষের সাধনা যে করছে, অথচ জগতের সেবা করছে না, সে আত্মমোক্ষের সাধনাতেও উন্নতি করতে পারবে না৷ এ দু’টো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল৷ মানুষ বিচারশীল৷ আগেকার চিন্তাধারা ছিল, Man is rational animal.’’ অর্থাৎ মানুষ বিচারশীল জানোয়ার৷ কিন্তু আমাদের দর্শন অনুসারে মানুষকে আমি জানোয়ার বলতে পারি না৷ বিচারশীল জানোয়ার কেন বলব? জীবন থাকলেই তো আর জানোয়ার হয় না৷ ফারসীতে যার মধ্যে জান আছে, তাকে বলে ‘জানবর’ (জানোয়ার) ফারসীতে ‘বর’, ‘গর’–এ ধরণের কিছু প্রত্যয় আছে৷ যেমন, যার কাছ থেকে ‘সওদা’ করা হয় (কেনাকাটা করা হয়), তাকে বলে সওদাগর৷ যে হামলা করে ‘হামলাবর’৷ যে যাদু করে ‘যাদুগর’৷ ‘জান’ থাকলে তাকে ‘জানদার’ বলা যাবে, কিন্তু ‘জানদার’ হলেই সে ‘জানবর’ (জানোয়ার) হয় না৷ তাই ‘‘Man is rational animal’’–আমি এটা সমর্থন করি না৷ আমি বলি, ‘‘Human life is an ideological flow’’ –মানব জীবন এক আদর্শমুখী ধারাপ্রবাহ৷ জীবনে আদর্শ থাকতেই হবে৷ যেখানে জীবনের গতি আদর্শাভিমুখী, তাকে আমরা মানুষ বলব৷ যার জীবনে আদর্শ নেই, জীবনের গতি আদর্শাভিমুখী নয়, চেহারা মানুষের মত হলেও তাকে আমরা মানুষ বলব না৷ চেহারা থেকে মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় না৷ পশুর চেহারাও মানুষের মত হতে পারে৷ পশুর মধ্যে যতটা পশুত্ব রয়েছে, কিছু মানুষের মধ্যে তার চেয়ে বেশী পশুত্ব রয়েছে৷ পশু বিশ্বযুদ্ধ করে না৷ নির্দোষের ওপর অত্যাচার করে না৷ যেখানে আদর্শ (ideology)নেই, সে পশুর চেয়েও অধম৷ এই কারণে মানবজীবন এক আদর্শমুখী ধারাপ্রবাহ৷
প্রাচীনকালে বলা হত–
‘‘অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যোবিদ্যামুপাসতে৷
ততো ভূয় এব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতা৷৷’’
আমরাও ‘‘Subjective approach through objective adjustment’’ বলি–জীবনের গতি হবে পরমপুরুষের প্রতি, আত্মাভিমুখী গতি কিন্তু Objective adjustmentঅর্থাৎ বাহ্যিক জগতে যা কিছু রয়েছে–সবার সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করে যেতে হবে৷ আত্মাভিমুখী গতি–Subjective approach যেমন থাকতে হবে, তার সঙ্গে Objective adjustment অর্থাৎ বস্তুজগতে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হবে৷
যেখানে প্রকৃতিতে সাম্যাবস্থা রয়েছে–তাকে শুধু ‘প্রকৃতি’ বলা হয়৷ আর যেখানে সন্তুলন নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানে তাকে বলা হয় ‘মায়া’৷ এই মায়াতে যেখানে তমোগুণের প্রাধান্য রয়েছে, তাকে বলা হয় অবিদ্যা মায়া, আর যেখানে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য রয়েছে, তাকে বলা হয় বিদ্যামায়া৷ অবিদ্যা মায়া কী?–যেখানে জড়াভিমুখী গতি সেখানে অবিদ্যা মায়া৷ আর যেখানে আত্মাভিমুখী গতি, অন্তর্জগতের দিকে গতি সেখানে বিদ্যা মায়া৷ যারা কেবল নাম–যশ–টাকাপয়স, ঘর–দুয়ার, প্রতিষ্ঠা–এ সব নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাদের অবস্থা কেমন হয়? অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি (তারা অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করে)৷ আর যে কেবল তথাকথিত বিদ্যা মায়াকে নিয়ে থাকে, তার অবস্থা হয় আরও খারাপ৷ জগতে থাকছ, জগতের খাচ্ছ, পরছ, জগতের সেবা নিচ্ছ, আর কপটাচারীর মত বলছ, জগৎটা নেই, এ সবই মিথ্যা, বলছ, মিথ্যা জগৎকে ছাড় কিন্তু মিথ্যা জগতের অন্ন গ্রহণ করছ, জল গ্রহণ করছ, মিথ্যা জগতের বস্ত্র পরিধান করছ আর বলছ, জগৎটা মিথ্যা৷ কী ধরনের অবস্থা জানো? রাতের যে পেঁচা (উল্লু), যাকে সংস্কৃতে বলে উল্লুক, রাতের অন্ধকারে ওদেরই রাজত্ব চলে৷ আর যখন পূর্বদিকে অরুণোদয় হয় তার চোখ অন্ধ হয়ে যায়৷ সে সূর্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে না৷ তাই, এ জগতে থেকে জগৎকে মিথ্যা বলা হ’ল কপটাচরণ৷ তাই যারা কেবল সেই বিদ্যাকে নিয়ে থাকে, আর বলে কেবল সাধনা করব, আর কিছু করব না, তারা কপটাচারী৷ জগৎটা যদি নেই, তাহলে খাওয়া–দাওয়া হচ্ছে কী করে? মনে কর, কেউ সংসার ছেড়ে হিমালয়ের গুহাতে চলে গেল, সেখানেও তো খেতে হবে৷ হয়তো সে বসে আছে আর ভাবছে যে, সন্ধেবেলা যে গাছটার তলায় ছিলাম, ওতে সুন্দর ফল ফলেছে, ওই ফলগুলো তাড়াতাড়ি পেড়ে নিতে হবে, নাহলে অন্য কোনো সাধু এসে ফলগুলো পেড়ে নেবে৷ দেখ, কী ধরনের কপটাচরণ হচ্ছে৷ অথবা ভাবছ, আমি তো ঘর–দুয়ার ছেড়ে চলে এসেছি, আমার জমিতে প্রতিবেশীরা হয়তো তাদের গোরু–মোষ ছেড়ে দিয়েছে, আর তারা হয়তো সব ফসল খেয়ে নিচ্ছে৷ এই সব চিন্তা মনে আসছে৷ তাহলে তো কপটাচার হয়ে যাচ্ছে তাই মানুষের কর্তব্য কী?–এই দু’য়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা৷ এটাই করা উচিত৷ এটা কেবল সন্ন্যাসীর কর্তব্য নয়, প্রতিটি গৃহীরও এটাই কর্তব্য৷