আমি অবশ্যই বর্তমান কালকে অস্বীকার বা অবহেলা করতে পারি না। এর অর্থ আমাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমি কোথায় আছি আর ঠিক বর্তমানে আমাকে কী করতে হবে। কিন্তু বর্তমান কাকে বলব? আমরা জানি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতকে নিয়ে কাল তিনটি। এই তিন ধরনের কাল আসলে কী বস্তুতঃ বর্তমান কাল বলে ঠিক কোন কিছু নেই। আমি যখন কিছু বলি, তুমি ততক্ষণাৎ তা শুণতে পাও না। কিছুটা বিরতির পরে তুমি সেটা শুণতে পাও। তাহলে সেই বিরতিটা কী শব্দ বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে কাণে পৌঁছতে যে সময় লাগে সেটাই বিরতি। আর যখন তা তুমি শোণ সেটা আমার কাছে কিন্তু অতীত, আর তোমার কাছে তা ভবিষ্যৎ কেননা অল্পক্ষণ পরে তুমি তা শুণতে পাচ্ছ
তাহলে কী করা উচিত দেখ খুব স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয়কেও খুব দীর্ঘ আর খুব হ্রস্ব কোনো তরঙ্গকে গ্রহণ ও আত্মস্থ করতে গেলে কিছুটা সময় লাগে। তাই অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে যে অল্প পার্থক্য আমরা খুঁজে পাই সেটাকেই আমরা বলি বর্তমান। এখানে আমার বলা আর তোমার শোণার মধ্যে যে অল্পক্ষণের বিরতি, মানুষের ইন্দ্রিয় বলা আর শোণার এই দুইয়ের মধ্যে যে দূরত্ব তার পার্থক্য করতে পারে না। আমরা বলি বটে এটা বর্তমান কাল কিন্তু আসলে বর্তমান কাল বলে কিছু হতে পারে না। কিন্তু ভগবান সদাশিব বলেছেন ‘বর্ত্তমানেষু বর্ত্ততে’ অর্থাৎ তুমি বর্তমান কালকে নিয়ে থাকবে। এই কথাটার প্রকৃত তাৎপর্য হ’ল মানসিক দিক থেকে তুমি সর্বদা বর্তমান কালের মধ্যেই থাকবে। এর অর্থ তুমি কখনই বর্তমান কালকে অস্বীকার বা অবহেলা করবে না
এই কথাটার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কী মানবীয় অস্তিত্ব শারীরিক, মানসিক আর আধ্যাত্মিক। এই তিনের মধ্যে শারীরিক বা জাগতিক অস্তিত্ব খুবই স্থূল মানসিক অপেক্ষাকৃত কম স্থূল, তুমি বলতে পার সূক্ষ্মতর আর আধ্যাত্মিক স্তর সূক্ষ্মতম। তাই বর্তমান কালের অস্তিত্ব মানসিক থেকে জাগতিক স্তরে বেশী প্রধান, আর আধ্যাত্মিকের চেয়ে মানসিক ক্ষেত্রে বেশী স্পষ্ট। বাস্তবে আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আর তাই যিনি আধ্যাত্মিক স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত, তিনি বর্তমান–অতীত–ভবিষ্যতের মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পান না তিনি হয়ে যান সর্বজ্ঞ। কিন্তু মানসিক স্তরে পার্থক্য আছে, আর জাগতিক স্তরে এই পার্থক্য সবচেয়ে বেশী প্রধান
এখানে ভগবান সদাশিব বলছেন যে স্থূল জাগতিকতার ক্ষেত্রে তোমাকে জাগতিক জীবনকে অবশ্যই যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হবে। আমি এটাকেই বলি বৈষয়িক জীবনে সামঞ্জস্য স্থাপন অর্থাৎ জাগতিক স্তরে তুমি যাই কর বা করবে তার মধ্যে উপযুক্ত সামঞ্জস্য বজায় থাকতে হবে। এইক্ষেত্রে তোমাকে উপযুক্ত ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এই সামঞ্জস্য আর ভারসাম্য তোমার মানসিক ক্ষেত্রেও থাকতে হবে। আমি আগেই বলেছি মানসিক স্তরে অস্তিত্বটা হচ্ছে কম স্থূল আর বেশী সূক্ষ্ম, আর যেহেতু তা সূক্ষ্মতর তাই এখানে সময়গত দূরত্ব অপ্রধান। জাগতিক স্তরে এই সামঞ্জস্য স্থাপন বেশী সময়সাপেক্ষ কেননা মানুষের মানসিক দেহ স্থূল দেহের থেকে বেশী সূক্ষ্ম। আমাদের আধ্যাত্মিক প্রগতি শুরু হয় এই মানসিক জগত বা স্তর থেকে– মানসিক স্তর থেকে শুরু হয়ে আধ্যাত্মিকতার অন্তিম বিন্দুতে শেষ হয়। তাই এখানে সময়গত দূরত্বের কোনো গুরুত্বই নেই। গতি যেহেতু পরমসত্তার পানে তাই সেখানে কালিক তত্ত্বের কোনো গুরুত্ব থাকে না।তাই মানুষের গতি হবে মানসিক থেকে পরমাত্মার দিকে যেখানে সময়ের কোনো গুরুত্ব নেই কিন্তু জাগতিক স্তরে একজনকে অনেক রকমের জাগতিক কাজ ও কর্তব্য পালন করতে হয়। মানুষকে খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষা, বস্ত্র ও অন্যান্য কত কিছু সংগ্রহ করার দায়িত্ব নিতে হয়। আর স্থূল জাগতিক স্তরে এইসব কাজকর্মের ক্ষেত্রে স্থান–কাল–পাত্রের মূল্য অবশ্যই আছে এখানে, তা না হলে মানুষ ঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। যদি মানুষ তার মনের যথোপোযুক্ত উপযোগ করতে চায় তবে তাকে জাগতিক কর্ম, মানসাধ্যাত্মিক গতি আর মানসাধ্যাত্মিক প্রগতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য, একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলতেই হবে। এইজন্যেই আমি বলি যে মানুষের জীবনে বৈষয়িক সামঞ্জস্য স্থাপনের সঙ্গে পরাগতির সন্তুলন থাকতে হবে। যদি কেবলমাত্র পরমাত্মিক গতিই থেকে গেল তাহলে কিন্তু ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাতে সমগ্র মানবসমাজ অধঃপতিত হয়ে যাবে। আবার যদি কেবল জাগতিক কাজকর্মই থাকল আর আধ্যাত্মিক প্রগতি হ’ল না, তাহলে মানবীয় অস্তিত্ব পশু অথবা উদ্ভিদের স্তরে পর্যবসিত হবে, যা কখনই কাম্য নয়। তাই আধ্যাত্মিক সাধককে এই সামঞ্জস্য আর সন্তুলনের কথা সর্বদা মনে রেখে চলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই