বাঙালির দুর্দৈবের অন্যতম প্রধান কারণ

লেখক
ফরিদা নার্গিস

‘‘হিন্দু বাঙালী’’ ‘‘মুসলমান বাঙালি’’ এই করে ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বাঙালি একবার ভাগ হলো৷ বাঙলা দ্বিখণ্ডিত হলো ৷ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু মুসলমান ধর্মমতের দোহাই দিয়ে বাঙালি পাকাপাকি দুটি আলাদা রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে গেল৷ বাঙলার অনেকাংশ অসম, মণিপুর, মেঘালয়, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যা, নেপালের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো৷ পৃথিবীর  বৃহত্তর  বদ্বীপভূমির উন্নত মেধা ও মগজের বাঙলা ও বাঙালির সভ্যতা হীনবল, দুর্বল হয়ে গেল৷ বিভিন্ন রাজ্য ও রাষ্ট্রের অবগুণ্ঠনে বাঙলার যেসব ভুখণ্ড ঢুকিয়ে দেওয়া হলো সেখানকার বাঙলার বাঙালিরা ভিন্নরাজ্য বা রাষ্ট্রের অফিসিয়াল ভাষা ও সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে যেতে থাকলো৷ অবশিষ্ট ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘স্বাধীন বাংলাদেশে’-র ভাষা সংস্কৃতিতেও সাম্রাজ্যবাদী হিন্দিভাষা ও বিশুদ্ধ ইসলামিকীকরনের নামে বেমানান ভাবে আরবি ফার্সী ভাষার অবদমন শুরু হয়েছে৷

মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় যেভাবে আরবি ফার্সী ভাষা ঢুকেছে সেটা ছিল উভয় ভাষার ক্ষেত্রে দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কের ভিত্তিতে৷ সেখানে ধর্মমতের বিভাজন স্পষ্ট ছিল না৷ থাকলে মধ্যযুগের হিন্দু কবিদের রচনায় এত আরবি ফার্সী শব্দের ছড়াছড়ি থাকতো না৷ রামমোহন, গিরিশচন্দ্ররা আরবি ফার্সী শিখতেন না৷ মুহম্মদ শহিদদুল্লারা সংসৃকত ভাষায় সর্র্বেচ্চ ডিগ্রি নিতেন না৷ এসব জেনেও কিন্তু আমরা বাঙালিরা ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া বিভাজনের বিষপাত্রে আজও বিষ পান করে চলেছি৷

আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নেই, তবে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ও কর্র্পেরেট পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার চেয়ে বেশি মাত্রায় অদৃশ্য বিষ ঢেলে চলেছে৷ আমরা বাঙালিরা সেই বিষ পান করে আত্মঘাতী হচ্ছি৷ অসমে এন.আর.সি-র নামে আবারও হিন্দু বাঙালি মুসলমান বাঙালি...৷ সকলেরই তো নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয় একই৷ সকলেই বাস করেন যে ভৌম-অঞ্চলে সেটাও প্রকৃতিপ্রদত্ত ভৌম-বাঙলা৷ এই সত্য থেকে বিস্মৃত হয়ে বাঙালি যতদিন হিন্দু -মুসলমান করবে, যতদিন উদ্বাস্তু আর স্থায়ী-এই বিভাজন করবে ততদিন এমনই চলতে থাকবে৷ বাঙালিতে বাঙালিতে পার্থক্য কিছু নেই৷ একই মাঠে রাম, রহিম লাঙল চষে৷ একই ভাষায় কথা বলে, গান করে৷ জীবন জীবিকাতেও কোথাও কোনো পার্থক্য নেই পার্থক্য শুধু ধর্মমতের আচার আচরণ আর কিছু বিশ্বাসে৷

কিন্তু আজকের এই একুশ শতক ধর্মমতের বা রিলিজিওনের যুগ নয়, অন্ধ বিশ্বাসের যুগ নয় আজকের যুগ যুক্তি-বিজ্ঞানের যুগ৷ আজকের যুগ প্রকৃত মানবতার যুগ৷ আজকের যুগ মানব ধর্মের যুগ৷

বাঙালির বুদ্ধিজীবীর অভাব ছিল না, আজও নেই৷ কলমচিরও অভাব নেই৷ অনেকেই বাঙলা ও বাঙালির দুরাবস্থার কথা লিখেছেন৷ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলম শুধু ধরেননি, বাঙলা ও বাঙালির ভৌম ও ভাষাগত ঐক্যের জন্য আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন৷ তারপরেও বাঙালির হুঁস হয়নি৷ আজও বাঙালির মুক্তি নেই৷

সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় অসমের যে যে অঞ্চলের বাঙালিদের বিদেশি চিহ্ণিত করা হয়েছে সেই অঞ্চল প্রকৃতি গতভাবে কিন্তু ভৌম বাঙলারই অংশ৷ মায়ানমার থেকে যে বাঙালিদের উৎখাত করা হয়েছে , তা আরাকান বাঙলা৷ অখণ্ড বাংলারই অংশ ৷ এক সময় এই আরাকানের রাজভাষাও ছিল  বাংলা৷ সেই সময়ের বহু আগে থেকেই আরাকানে বাঙালির বসবাস৷ আর আজ সেই আরাকানের বাঙালিরা হয়ে গেল বিদেশি৷ কী অদ্ভূত বাঙালির ভাগ্য বিড়ম্বনা !

জানিনা এর থেকে বাঙলা ও বাঙালির মুক্তি কিভাবে আসবে? বাঙালি কবে প্রকৃত ভৌম বাঙলা ফিরে পাবে ? কবে পৃথিবীর বৃহত্তর বদ্বীপ সভ্যতার বাঙালি আপন হৃত গৌরব উদ্ধার করবে?

বাঙালি বুঝতে পারছে না, পৃথিবীর অপরাপর সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অদৃশ্যভাবে বাঙালির বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে৷ তাই আজ সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবেই তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে৷ অতীতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন বাঙলাকে একতাবদ্ধ করে বাঙালির নিজস্ব আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে৷ অদ্ভুত কথা হচ্ছে, ‘‘বাংলা ভাষা’’ আছে, ‘‘বাঙালি জাতি’’ আছে, অথচ বাঙালির নিজস্ব স্বীকৃত বাসভূমি নাই৷ এটাই বাঙালির সকল দুর্দৈবের কারণ৷ যা আছে তা খণ্ডিত ‘বাংলাদেশ, যা আছে তা খন্ডিত ‘পশ্চিমবঙ্গ’৷ যা আছে তা বিচ্ছিন্নভাবে বিমাতার কোলে৷ বিচ্ছিন্নবঙ্গের সকল বাঙালিকে প্রথমে পরিচিত হতে হবে’’ ‘আমরা বাঙালি’ এই পরিচয়ে৷ তারপর অতীতের সমস্ত বিচ্ছিন্ন বাঙলাকে নিয়ে ‘‘ বাঙালিস্তান’’ গড়ে তুলতে হবে৷ এর বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না৷ একথা আমার নয়, একুশ শতকের মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের৷