বাঙালীস্তান বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার সোপান

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

অতি সম্প্রতি আমাদের রাজ্যে দৈনিক খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় এ রাজ্যেরই এক কম্যুনিষ্ট তথা মার্কসবাদী নেতার হুংকার প্রকাশের নমুনা দেখে তাজ্জব বনে গেলুম, মূলতঃ এই কারণেই যে, এ ধরণের  ব্যষ্টিরাই আমাদের শতগুণ দুর্র্ভগ্যের কারণে আমাদের বিধায়ক, মন্ত্রণাদাতা (মন্ত্রী বা মহামাত্য অর্থে) তথা শাসক সেজে ছড়ি ঘোরাবার সুযোগ পেয়ে যান--- প্রধানতঃ পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, আর তারই সহায়ক অন্যান্য ঔপকরণনাদির সুযোগ পেয়ে৷ যারা, মানব-ইতিহাসের ধারণা রাখেন না ভূগোলেরও যথার্থ পরিচয়  পেয়েছেন কোনদিন বলে মেনে নেওয়া যায় না নৃতাত্ত্বিক আইডিয়া খুবই সীমিত বলে মানব-মনস্তত্ব ও যুগোপযোগী চিন্তাধারাও পোষণ করতে নারাজ---এই ধরণের লোকেদেরই বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন ‘মানি পাওয়ার আর মাস্‌ল-পাওয়ারে কী না হয়, এরূপ ভাবা ধারাই মাথা চাড়া দিয়ে রয়েছে বৈশ্যযুগের (বরং বলা উচিত ধনতান্ত্রিক মাফিয়া যুগের) গণতন্ত্রের পরিকাঠামোতে, সুবিধাবাদী সেজে ধরাকে সরা জ্ঞান করার বিশেষ মওকা পেয়ে যান৷ ভাবতে বসলে মনে খুবই বেদনা জাগে৷ বর্তমানের এই যুগ সন্ধিক্ষণে শুধু যে ধর্মেরই গ্লানি দেখা দিয়েছে তা নয়, একইসাথে নৈতিক-চেতনা ও মানবিক বিচারবোধ, সুবুদ্ধির আর জ্ঞানদীপ্ত মূল্যবোধেরও দিনকে দিন ভরাডুবি ঘটে চলেছে৷ পুঁজিবাদ,জড়ভিত্তিক ভোগবাদ আর লোভবৃত্তি-কর্মবৃত্তি সম্পন্ন আত্মসুখতত্ত্বের মোহগ্রস্ত কতিপয় মিলিয়নীয়ার, বিলিয়নীয়ার ও ট্রিলিয়নীয়ার প্রমুখ অর্থনৈতিক ডাইনোসরদের প্রকোপে ভীত-সন্ত্রস্ত এ পৃথিবীটা শুধু যে আজ ধরিত্রীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষেরাই বিপন্ন তা তো নয় মানবতা বিরোধী ওইসব আসুরিক ও দানবীয় চরিত্রের অশুভ-চরিত্রের (হিউম্যান্‌স ইন্‌ ডেমোনিক ফর্মস্‌) একচেটিয়া দৌরাত্ম্যে পৃথিবীর বুকে উদ্ভিদ-জগৎ, সমগ্র প্রাণীজগৎ, এমনকি বস্তুজগৎ--- এক কথায় সামূহিক সৃষ্ট-জগৎই আজ ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রোদনরত৷ শান্তস্নিগ্দ বসুন্ধরা আজ ধবংসযজ্ঞের বিস্তীর্ণ মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত--- মানবসভ্যতা ক্রম বিপর্যয়ের পথে এগিয়ে চলেছে৷

পৃথিবীবাসীরা যখন অস্তিত্বরক্ষা নিয়ে সংকটাপন্ন, তখনও আত্মসুখ পরায়ণ ভোগ বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে, জাগতিক লোলুপতায় উন্মত্ত সাম্রাজ্যবাদ প্রসায় নেশাগ্রস্তরা তাদের অস্ত্রগারে মারণাস্ত্রে অনবরত শান দিতে ব্যস্ত রয়েছে৷ ধরা-সৃষ্টে প্রায় ৮০ শতাংশ-৯৫শতাংশ মানুষই যখন ক্ষুধায়--- অপুষ্টিতে তিলে তিলে মরণের দিকে এগিয়ে চলেছে তখনও ‘রোমের নীরোরা’ অর্থাৎ ক্যাপিটালিষ্ট দুনিয়ার পুঁজিমালিক নরপিশাচরা ও তাদের অনুচর সহচরেরা প্রধানতঃ দুঃস্থ অসহায় পঙ্গু-রোগাক্রান্ত দৈন্যপীড়িত মানুষদেরই তাদের নানারকম ব্যবসার পণ্য বানিয়ে মুনাফা লোটার কারসাজি করে চলেছে৷ এ যুগটাই যেন---‘বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা’ পরিবর্তে, ‘বুদ্ধি যার বল তার’---এরও পরিবর্তে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিত্ত যার দুনিয়া তার’৷ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব বা মানবিক-চেতনার পুরোদস্তুর অবক্ষয়ের চরম সীমায় আমরা পৌঁছে গেছি৷ কিন্তু, ধনপাত কুবেররা কেন যে ভুলে গেছে জানি না যে---‘‘মানবের তরে এ পৃথিবী দানবের তরে নয়৷’’

সুবিধাবাদী সাম্রাজ্যবাদী, ভোগলোলুপ-স্বার্থান্ধরা গোটা পৃথিবীটাকে মূলতঃই তিনভাগে বিভাজন করে রেখেছে, যথাঃ--- (১) বিত্তবান  ও প্রতাপশালী রাষ্ট্রসমূহ যারা পৃথিবীর ‘বিগ্‌-পাওয়ার্স’ বলেই খ্যাত আর তাদেরই কতিপয় তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলো যারা কমনওয়েলথ তথা ‘৮-জি’, ‘১২-জি’, ‘২০-জি’, ইত্যাদি নামে  পরিচিত৷ (২) অনুন্নত বা পশ্চাৎপদ দরিদ্র দুনিয়া যেখানকার মানুষেরা আকারে-অবয়বে মানুষ হয়েও মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ লাভে বঞ্চিত পুঁজিপতি-দুনিয়ারই শোষণে ও দৌরাত্ম্যে৷ (৩) আবার এ দু’য়েরই মাঝামাঝিস্তরে পৃথিবীর আরেক দুনিয়া রয়েছে, যার অন্তর্ভূক্ত দেশসমূহকে ‘‘তৃতীয় বিশ্ব’’ বলা হয়ে থাকে--- যে দেশগুলো ‘‘উন্নয়নশীল’’ বলেই খ্যাত৷ অর্থাৎ, একদিকে ‘ডেভেলপড্‌ দুনিয়া’ ও অপরদিকে ‘আনডেবেলপড্‌ দুনিয়া’ আর দু’য়ের মাঝখানে ‘ডেবেলপিং দুনিয়া’--- দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড মূলতঃ পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রসমূহের শোষণের ও ব্যবসায়ের উন্মুক্ত মৃগয়াক্ষেত্র৷ পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের প্রায় দু’-তৃতীয়াংশই উক্ত তৃতীয় বিশ্বের রয়েছে মানব---সম্পদেরও প্রায় দু’তৃতীয়াংশই বসবাসরত এই বিশ্বে৷ তাই, একে বরং বর্তমান পৃথিবীর ‘‘টু-থার্ড ওয়ার্ল্ড’’ বলেই কোন কোন মনীষিগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন৷

দ্বিতীয়তঃ জাতিভেদ, জাতবিচার, বর্ণবিদ্বেষ, (শাদা-কালোর তফাৎ), গোষ্ঠী-বিভাজন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতার ঈর্র্ষবিষ---ইত্যাদি নিয়েও মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটিয়ে রাখা--- মানুষে মানুষে জাতি-উপজাতি বা জনজাতি বলে সীমারেখা টানা কিংবা জীবিকাবৃত্তি বা পেশার উপর ভিত্তি করে বড়ো জাত আর ছোটোজাত বলে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলা ও এসবের পেছনে ইন্ধন যুগিয়ে যাওয়া--- এতসব সংকীর্ণতাবাজি ও হীনবৃত্তি সম্পন্ন নিশ্চয়তা কোন প্রকারেই সুস্থ মানবিকতাবোধের পরিচায়ক নয়৷ আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, রাজ্য-রাষ্ট্র বা দেশ-স্বদেশ-বিদেশ ইত্যাদি ভৌম ভাবপ্রবণতা (জিও-সেন্টিমেন্ট), সামাজিক-ভাবপ্রবণতা (সোসিও-সেন্টিমেন্ট) ইত্যাদিও প্রকৃত মানবিক-চেতনারই পরিপন্থীমাত্র৷ এসব ভেদ বিচারের ফলে মূলতঃ মানবিকতাই ক্ষুন্ন হয় মানবিক প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে মানুষ জাতির উন্নতির গতি শ্লথ হয়, স্তব্ধ হয়ে ওঠে৷ আজ যদিও পৃথিবীর বুকে মানবসভ্যতার বয়েস্টা প্রায় পণের হাজার বছরের মতই হতে চলল,  তথাপি কিন্তু জোর গলায় বলা যাচ্ছে না যে মানবতা আজও তার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবার পথে প্রত্যাশামত এগুতে পেরেছে৷ এরও কারণ কিন্তু মন প্রধান জীব মানুষেরই বুদ্ধির দুর্বলতা তথা বিকলতা হেতু ক্ষুদ্রস্বার্থ চিন্তা,ক্ষমতালোলুপতা৷ কারণ, জাতি, গোত্র, দেশ, রাষ্ট্র, নেশন ইত্যাদি নিয়ে মানুষ যতদিন বড়াই করা বজায় রাখবে মানুষে মানুষে লড়াই টা কিন্তু কিছুতেই থামতে পারবে না৷ ন্যাশনালিটি নিয়ে মারামারি হচ্ছে বলেই সংঘ কেবল নামেই অস্তিত্ব ধরে রেখেছে আর  কাজে ঠুঁটো জগন্নাথ৷ আর, নেশন নিয়েই বড়াই দেখাতে গেলেই  ইন্টার ন্যাশনালিজমও কথায় কাগজে ও ভাষণে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মাটির পৃথিবীতে প্রহসন বলেই বিকৃত হতে বাধ্য৷ সে কারণেই, বর্তমান যুগের মহান দার্শনিক, ঋষি ও প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে সব ধরণের ইজম্‌-কে বর্জন করে বর্তমানে যুক্তিবাদের যুগে একমাত্র ইয়ূনিবার্র্সলিজ্‌মকে সর্বস্বরূপে বরণ করে নিতে হবে৷ কেননা, ইয়ূনিবার্স বলতে এক, অদ্বিতীয় ও অবিভাজ্য সত্ত্বাকেই বোঝায় বলে এতে খণ্ডতার কোন প্রশ্রয় নেই৷ আবার, পৃথিবীর তথা বিশ্বের সকল মানুষই যেহেতু একই প্রজাতিভুক্ত সেজন্যে সব মানুষের জাত বা জাতি (অবশ্যই ‘নেশন’ অর্থে নয়) হবে একটাই--- হিউম্যান বিইং৷ এজন্যেই বলা হয়ে থাকে সব মানুষের একজাত৷ সব মানুষের ধর্ম (অর্থাৎ সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য বা ইনারমোষ্ট ক্যারাক্টেরিষ্টিক তথা স্ব-ভাব-নেচার রেলিজিয়ন নয়) হচ্ছে একটাই, যার নাম হিউম্যানিটি বা হিউম্যানিজ্‌ম---যার অপর নাম ইয়ূনিবার্র্সলিজ্‌ম৷ মানুষকে আজ বুঝতে হবে, জানতেও হবে---‘‘হরঃ (মানে শিব তথা পরমপিতা পরমব্রহ্ম) মে পিতা গৌরী (মানে পরমা প্রকৃতি) মাতা স্বদেশ ভুবনত্রয়ম্‌৷’’ অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় বিশ্ব পিতারই সন্তান জগতের সকল মানুষ নর ও নারী একই প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত আর জন্মসূত্রেই প্রতিটি মানুষই ত্রিভূবন তথা বিশ্বেরই বাসিন্দামাত্র৷ সুতরাং প্রতিটি মানুষই বিশ্বনাগরিক বা কসমোপলিটান৷ মানুষের স্বদেশ-বিদেশ বলে কিছুই নেই বা হতেও পারে না৷ তাই নাগরিকত্ব (সিটিজেনশিপ), পাসপোর্ট-ভিসা, ডি-বোটার ইত্যাদি হচ্ছে পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণীর দুর্বুদ্ধি সঞ্জাত মার-প্যাচ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখে  তাদের অবদমিত করে রাখা ও অবাধে শোষণ চালিয়ে যাওয়া৷ তবে এসবের উর্ধে-মানুষকে এযুগে উঠতেই হবে৷ সংকীর্ণতার সব বেড়াজাল ছিন্ন করেই তবে পৃথিবীতে কায়েম করতেই হবে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ তথা বিশ্বৈকতাবাদ --- গড়ে তুলতে হবে বিশ্ব সরকার, বিশ্বনাগরিকত্ব, বিশ্ব সংবিধান, বিশ্ব-বিচারসংহিতা বা বিশ্বআইন, বিশ্বভাষা, ইত্যাদি৷ একমাত্র তাতেই সম্ভব হবে মানবজাতির সার্থক পরিচয়-নিপুনতার প্রকাশ৷ মানুষের এগিয়ে চলার দৃষ্টিভঙ্গী হওয়া উচিত---‘‘উদার চরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম্‌’’৷ আমরা বিশ্বকবির লেখনী-প্রসূত কথাও অনুসরণ করতে পারিঃ--- ‘‘দেশে দেশে মোর ঠাঁই আছে আমি সেই ঠাঁই লব বুঝিয়া৷’’

তবে, প্রশ্ণ এসে গেল কীভাবে এই কঠিন কাজ সম্ভব হয়ে উঠবে৷ এ প্রশ্ণের যথাযথ মীমাংসা আমরা খুঁজে পাচ্ছি দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত যুগোপযোগী সামাজিক---অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও প্রয়োগভৌমিক দর্শন--- প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব তথা এর সংক্ষিপ্ত নাম প্রাউট দর্শনে৷ উক্ত প্রাউট-দর্শনে বিশদভাবেই বলা হয়েছে--- বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির কথা৷ বিশেষভাবে উল্লেখিত যে, পুঁজিবাদের শোষণ আর সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্যে বিরাট ভূমিকা পালন করবে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা৷ তাই প্রাউট-এর নব্যমানবতাবাদের পরিকাঠামোকে ঘিরে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতেই সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে খোল-নলচে সহ পালটিয়ে নোতুন ছাঁচে ফেলে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নোতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই হবে৷ বস্তুতঃ বর্তমানের পুঁজিবাদী ও জড়বাদী সমাজ ব্যবস্থার বদলে প্রাউটভিত্তিক ওই নোতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার যে কর্মায়ণ প্রক্রিয়া প্রাউট দর্শণে তাকেই বলা হয়েছে--- সমাজ আন্দোলন৷ স্পষ্টতঃই উক্ত সমাজ-আন্দোলন হচ্ছে প্রকৃত বিচারেই এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ৷

প্রাউটিষ্ট সমাজ-আন্দোলনের গোড়ার কথাই হচ্ছে---কোন রাজনৈতিক তথা পলিটিক্যাল দৃষ্টিকোন থেকে নয় কোন জাতপাত, ভাষাগোষ্ঠীগত, বর্ণ বা ধর্মমত বা রিলিজিয়ন ভিত্তিকও নয় যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসারে পৃথিবীর বুকে মোট ২৬৮টি স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল (?) গড়ে তোলা হবে৷ প্রতিটি জোনেই একটি আঞ্চলিক তথা অর্থনৈতিক সরকার গঠিত হবে, যার উপর ন্যস্ত থাকবে এলাকাভিত্তিক, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যনীতি সমূহ অর্থাৎ সম্পূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা৷ আর সবগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চলকে নিয়ে কেন্দ্রস্থলে থাকবে রাজনৈতিক তথা পলিটিক্যাল ও প্রশাসনিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ব-সরকার বা ওয়ার্ল্ড-গভর্ণমেন্ট৷ এভাবেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কোন অবস্থাতেই একহাতে বা একসূত্রে কায়েম হতে দেওয়া হবে না৷  উল্লেখ থাকে যে, অভিজ্ঞতা-নির্ভর যুক্তি হচ্ছে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা এক হাতে পরিকল্পিত ও পরিচালিত হবার সুযোগ রয়েছে বলে পুঁজিবাদী ও প্রবহমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি অতিগভীরে শিকড় মেলার ও শোষণ চালাবার অবাধ সুযোগ থেকে যায়৷ অবশ্য এ নিয়ে বিস্তৃত না, শুধু এটুকুই বলব যে প্রাউট প্রণেতা চেয়েছেন অর্থনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে জনগণেরই হাতে৷ কারণ,অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র পুঁজিবাদীদেরই ক্রীড়ানক হয়ে বোট বাজির মাধ্যমে শোষণের হাতিয়ার-স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়৷ আমাদের ভারত, পৃথিবীর বৃহত্তম দেশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ আশাকরি, আমাদের ডান-বাম-রাম-মধ্যম সবপন্থী ভাই-বোনেরাই কিছুটা হলেও মূল ব্যাপার খানা উপলদ্ধি করতে পারছেন৷ এখন, উক্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক  অঞ্চল গড়ার যে প্রাউটিষ্ট সমাজ আন্দোলন যে সব যুক্তির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, এ সম্পর্কে স্বয়ং প্রাউট প্রবক্তার মুখ থেকেই শোণা যাকঃ--- ‘‘প্রাউট বর্তমান পৃথিবীর সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুসারে সর্বত্র ‘‘স্বয়ং-সম্পূর্ণ  সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল’’ গড়ে তোলার নীতিতে বিশ্বাসী৷ এই সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি আপন আপন এলাকায় জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণকে ত্বরাম্বিত করবে ও এক সাধারণ ভাবাদর্শের (আইডোলজির) ভিত্তিতে সর্ব-মানবকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে৷ এই সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি যতই শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে ততই ধীরে ধীরে এগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলে যাবে৷ বিশ্বরাষ্ট্র তৈরী হবার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর সকল মানুষেরও সকল নেশনের স্বার্থ রক্ষিত হবে, সবাই যথার্থ স্বীকৃতি পাবে৷

এইভাবে প্রতিটি প্রাউট সর্বমানবের সার্বিক কল্যাণকে সুনিশ্চিত করবে৷ (সূত্রঃ---কণিকায় প্রাউট ১৩শখণ্ড-পৃ২৭-২৮)

সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি কীসের ভিত্তিতে তৈরী হবে,সে প্রসঙ্গে শ্রী সরকার বলেছেন--- ‘‘প্রাউট এক নূতন অনন্য বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির পরিকল্পনা দিয়েছে৷ প্রাউট সারা বিশ্বে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠী-অঞ্চল গড়ে তুলবার সুপারিশ করেছে৷ এই জাতীয় ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠী’ গড়ে উঠবে---(১) একই অর্থনৈতিক সমস্যা (২) একই ধরনের সম্পদ ও সম্ভাবনা (৩) জাতিগত সাদৃশ্য (৪) সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (৫) একই সাধারণ (কমন) সামাজিক-সাংসৃকতিক বন্ধন যেমন--- ভাষা, সাংসৃকতিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংবেদনিক উত্তরাধিকার (সেন্টিমেন্টাল লিগ্যাসি)--- এসবের উপর ভিত্তি করে৷’’

(সূত্রঃ--- কঃপ্রাঃ ১৩শ খণ্ড--- পৃঃ১৪)৷

এবারে এসে যাচ্ছি ‘বাঙালীস্তান’ গড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে৷ তবে, এরও আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন মনে করছি যে, বর্তমান পৃথিবীকে প্রাউট রচয়িতা--- দিল্লী, হংকং, ম্যানিলা, জর্জ টাউন, কাহিরা ইত্যাদি মোট ৯টি সেক্টরে বিভাজিত করেছেন৷ আমাদের এই দিল্লী-সেক্টরে প্রাউট-এর সামাজিক-অথনৈতিক অঞ্চল (ইয়ূনিট তথা এস. এস. এস. ই. জেড) রয়েছে মোট ৪৪টি৷

আবার, প্রতিটি অঞ্চলকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাঁরা আন্দোলনে রত রয়েছেন, সে-সব কর্মীদের তিনি নামকরণও করেছেন, যেমন---আমরা বাঙালী, অসি পঞ্চাবী ভোজপুরী সমাজ, কন্নড় সমাজ, তামিল সমাজ, ডোগ্রী সমাজ, ছত্তিশগড়ী সমাজ, বিদর্ভ সমাজ ইত্যাদি৷ ‘‘আমরা বাঙালী’’ যে ‘‘সামাজিক অর্থনৈতিক স্বয়ং সম্পূর্ণ অঞ্চল’’ গড়ার লক্ষ্যে আন্দোলন চালাচ্ছে, তাঁদের কাঙ্খিত অঞ্চলের নাম---‘‘বাঙালীস্তান৷’’ বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য যে, ‘আমরা বাঙালী’-র আন্দোলন প্রকৃত বিচারে এক সামাজিক-অর্থনৈতিক আন্দোলন আর ‘‘বাঙালীস্থান’’ মূলতঃই প্রাউটভিত্তিক এক সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চলরূপেই গড়ে উঠবে৷ এর পেছেনে বর্তমান গণতান্ত্রিক ভারতে বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে গণতান্ত্রিক প্রথার মান্যতা দিতেই ‘আমরা বাঙালী’ রাজনৈতিকভাবে লড়ছে ও লড়বে৷ এছাড়া, অন্যান্য ইজ্‌ম-ভিত্তিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী এর পেছনে নেই, যেহেতু এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সংশ্লেষণের (সিন্থেসিস) পথ ধরে বিশ্বরাষ্ট্র ঘটন করা ও বিশ্বৈকতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা৷ কোনও বিশ্লেষনীয় বা অ্যানালাইটিক্যাল পথ আমরা বাঙালীর নয়, কারণ প্রাউট আমরা বাঙালীর পাথেয় আর প্রাউট চায় বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠার জন্যে সবার জন্যে এক কমোন্‌ আইডোলজির প্রয়োগ৷

অপরপক্ষে ত্রিপুরায় তিপ্রাল্যাণ্ড গড়ার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে৷ সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে গড়ে উঠেছে--- এটুকু সত্য সকলেই জানেন৷ এমতাবস্থায় জনৈক মানবতাবাদী নেতা তিপ্রাল্যাণ্ড-এর দাবী ও লক্ষ্য নিয়ে উপমা টানতে গিয়ে ‘বাঙালীস্তান’ নিয়ে যে কটাক্ষপাত করেছেন, এ নিয়ে আমার স্পষ্ট অভিমত, প্রাউটের চিন্তাধারা সম্পর্কে অজ্ঞতাবশতঃই সম্ভবত তিনি তা করেছেন৷ তাই বলছি, সম্যক না জেনে বেফাঁস মন্তব্য করাটা কি বিচক্ষণদের কখনও শোভা পায়?