সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে এক বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়, ৭ই অক্টোবর ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ ইস্যু নিয়ে এক জরুরী বৈঠক হবে৷ ওই বৈঠকে পৌরোহিত্য করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী অমিত শাহ্৷ তাতে বিশেষ করে ডাক পেয়েছেন গোর্খাজনমুক্তি মোর্র্চর প্রধান বিমল গুরুং, যিনি বর্তমানে ফেরার ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত৷ এই বৈঠকের কথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়নি৷ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব, দার্জিলিং-এর জোলা শাসক ও জি.টি.এ-র প্রধান সচিবকে, জি.টি.এর অন্য কোনো পদাধিকারীদের ডাকা হয়নি৷ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বর্তমান সভাপতি বিনয় তামাংকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি৷ পরিষ্কার বোঝা যায়, এর পেছনে সমস্যার সমাধানের কোনো সদিচ্ছা নেই, আছে গভীর রাজনৈতিক অভিসন্ধি৷
রাজ্যসরকারের তরফে এই বৈঠকের তীব্র প্রতিবাদ করায় পরদিন (৫ই অক্টোবর) প্রথমে এই বৈঠক বাতিল বলে ঘোষণা করা হল৷ আবার সন্ধ্যায় ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ শব্দটির বদলে ‘গোর্র্খ টেরিটরিয়্যাল এ্যাড্ মিনিষ্ট্রেশন’ লিখে পুনরায় সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি জারী করা হ’ল ও বৈঠকের স্থান-কাল অপরিবর্তিত রাখা হ’ল৷
এইভাবে কেন্দ্রীয় সরকার পাহাড়ে আগুন নিয়ে খেলা করছে৷ না, খেলাই বলব না,আবার আগুন জ্বালাতে চাইছে৷ উদ্দেশ্যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ সেন্টিমেন্ট উস্কে দিয়ে পাহাড়বাসী নেপালীদের বোট Vote) লুন্ঠন৷
কেন্দ্র বারে বারে ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ সেন্টিমেন্টকে উস্কে দিয়ে দার্জিলিং-এর নেপালী তথা গোর্খাদের মন জয় করতে চাইছে৷ তারা সত্যকে বিকৃত করে বাঙলার বুকে আবার ছুরি চালাতে বদ্ধ পরিকর৷ এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, গোর্র্খরা দার্জিলিং-এর আদি বাসিন্দা নয়৷ এরা প্রায় ২০০ বছর আগে নেপাল থেকে জীবিকার সন্ধানে দার্জিলিং-এ এসে বসবাস করছে৷ ১৮৭২ সালে জনগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী সে সময় এদের সংখ্যা এত নগণ্য ছিল যে সেই রিপোর্টে রেকর্ডভুক্তই করা হয়নি৷ শুধু এইটুকুই উল্লেখ করা হয়েছে তারা বহিরাগত মাত্র৷ দার্জিলিংয়ের উচ্চতর পার্বত্য এলাকায় লেপ্চা ও ভুটিয়ারা বাস করত৷
বলা বাহুল্য, এই লেপ্চা ও ভুটিয়ারা আদি বাঙালী ‘কোচ’ জাতিভুক্ত৷ আর দার্জিলিং-এর সমতলে অন্যান্য বাঙালীদের বাস ছিল৷ ১৯৫০ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে এক চুক্তিতে বলা হয়, নেপালী বা গোর্র্খরা দার্জিলিং-এ জীবিকা অর্জন করতে পারবেন কিন্তু এখানকার নাগরিকত্ত্ব পাবেন না৷ তাই মোরারজী দেশাই যখন প্রধানমন্ত্রীরূপে দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলেন, তখন ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ আন্দোলনের প্রশ্ণে ববলেছিলেন, গোর্খারা নেপালে গিয়ে আন্দোলন করুক, ভারতে নয়৷ এখানে বলে রাখা ভাল, যারা নেপালী বলে পরিচয় দেয় ও দার্জিলিং অঞ্চলে বসবাস করে, তারা অর্থাৎ সমস্ত নেপালীরা আদৌ গোর্খা নয়৷ নেপালীদের যে পনেরটি গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে একটা ‘গোর্র্খ’৷ নেপালীদের অন্যান্য গোষ্ঠীরা হ’ল তামাং, গুরুং নেওয়ারী প্রভৃতি৷ তারা গোর্খা নয়, তাদের ভাষাও গোর্র্খলী নয়৷ গায়ের জোরে সবাইকে গোর্খা বলে প্রচার করা হচ্ছে৷
আর, ইতিহাস বলে, ‘গোর্খাল্যাণ্ড শব্দটাও কম্যুনিষ্ট পার্টির সৃষ্টি৷’ কম্যুনিষ্ট পার্টি ভারতে নিজেদের মাটি শক্ত করার জন্যে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ও বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল৷ সস্তা সেন্টিমেন্ট দিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে কব্জা করাই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ ১৯৪৭ সালে তারা সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলীম লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল৷ এই কম্যুনিষ্টরা সিকিম, নেপালের অংশবিশেষ ও উত্তরবঙ্গের দার্জিলিংসহ কয়েকটি জেলা নিয়ে ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ তৈরীর শ্লোগান তুলেছিল৷ এইভাবে তারা গোর্খাদের মধ্যে তাদের শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরী করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি৷ ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসে আবার সিপিএম সেই পুরোনো গোর্খাল্যাণ্ড সেন্টিমেন্টকে চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল৷ যা শেষে বুমেরাং হয়৷ যা পরবর্তীকালে দার্জিলিংয়ে চরম হিংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে৷ যার ফলে সেখানকার নিরীহ শান্তিপ্রিয় বাঙালী অধিবাসীরা দার্জিলিংয়ে নিজেদের ঘরবাড়ী ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হয়ে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি জেলায় বসবাস করছে৷ বহিরাগত গোর্খারা এইভাবে বাঙালীদের তাড়িয়ে বাঙলার অঙ্গচ্ছেদ করে গোর্খাল্যাণ্ড গড়বার দাবী তুলে৷ বহিরাগত গোর্খারা এই বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবী নিয়ে পাহাড়ে সরকারী অফিস ভাঙ্গচুর, অগ্ণিসংযোগ খুন জখম প্রভৃতি করে পাহাড়ে আগুণ জ্বালিয়েছিল৷
বহিরাগত গোর্খাদের অন্যায় দাবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সর্বত্র বাঙালীরা গর্জে উঠে৷ প্রশাসনও তৎপর হয়৷ শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই আন্দোলনকে আপাতত স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে৷ যদিও ফেরার বিমল গুরুং সহ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিশেষ করে কেন্দ্রের শাসকগোষ্ঠী বিজেপি’রসহায়তায় গোর্র্খল্যাণ্ড আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে---পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে পশ্চিমবাঙলার অঙ্গচ্ছেদ করে ‘গোর্র্খল্যাণ্ড’ তৈরী করতে চাইছে৷
বিজেপিও এরাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে দার্জিলিং-এর বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও উস্কাচ্ছে৷ কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব কি এটা বুঝছেনা যে, দার্জিলিং-এ আগুন জ্বললে তা যেমন বাঙলার সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক, তেমনি ভারতের নিরাপত্তার পক্ষেও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক!! ওদিকে চীন ওৎ পেতে আছে, নেপালের সঙ্গে ইতোমধ্যেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করে নেপালে গোপন ঘাঁটি গেড়েছে৷ গুরুং -এর সঙ্গে তলে তলে কম্যুনিষ্ট চীনের সংযোগও ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের অজানা নয়৷ এর পূর্বে বহু সংবাদও প্রকাশ পেয়েছিল৷ দার্জিলিং-এ গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলন তীব্র হলে বা দার্জিলিংকে পশ্চিম বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ওখানে চীন এসে জাঁকিয়ে বসবে৷ আর দার্জিলিংয়ে চীন ঢুকে যাওয়া মানে ভারতের প্রতিরক্ষার পক্ষে তা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক৷ এই দিক থেকেও ভারত সরকারের উচিত দার্জিলিং-এ কোনোমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যাতে মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠে৷ দার্জিলিং-এ যাতে পুরোপুরি শান্তি বজায় থাকে৷
কিন্তু বিজেপি নেতারা ক্ষমতা দখলের জন্যে যে সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ৷ মোদিজী চীনের বিরুদ্ধে প্রায়ই হুঙ্কার দিচ্ছেন ৷ তিনি কি চান তার দল এইভাবে মাতৃভূমির বুকে ছুরি মারুক৷
- Log in to post comments