পুরুষোত্তমের আকর্ষণী শক্তির কারণে আর জড়বস্তুর মধ্যে প্রবল সংঘর্েষর ফলস্বরূপ প্রতিসঞ্চর ধারায় মনের সৃষ্টি৷ প্রতিসঞ্চর ধারা পুরোটাই এই আকর্ষণী শক্তি-দ্বারা প্রভাবিত৷ সংঘর্ষ জড়বস্তুর মধ্যে খণ্ডীকরণের প্রবৃত্তি জাগায়৷ তাই ধীরে ধীরে বস্তুর একটা অংশ চূর্ণীভূত হয়ে যায় ও সেটাই মনের প্রথম বা প্রাথমিক অবস্থা৷ এই মন বস্তুতঃ চিত্ত ছাড়া কিছুই নয়৷ সেইজন্যে অবিকশিত প্রাণী ও উদ্ভিদের মনের অধিকাংশ ভাগই কেবল চিত্ত৷
চিত্তের অধিক্ষেত্রের মধ্যে দু’টো সূক্ষ্মতর অভিপ্রকাশ---মহৎ তত্ত্ব[''I" exist] ও অহং তত্ত্ব[''I" do, ego] নিদ্রিত অবস্থায় থাকে৷ মন-সৃষ্টির প্রারম্ভিক অবস্থায় অহং-বোধ থাকে না৷ এই অবস্থায় অন্ধ প্রাণাঃ[vital energy] বস্তুগত সংরচনাকে ঠিকভাবে ক্রিয়ান্বিত করতে পারে না৷ এই প্রাথমিক অবস্থায় মনের কাজ হ’ল সত্ত্বাগত সংরচনার সংরক্ষণ ও বংশ বিস্তার৷ এটা স্থূলতম কামময় কোষ ছাড়া আর কিছুই নয়৷
এই অবিকশিত মন প্রতিসঞ্চর ধারায় ক্রমশঃ এগিয়ে চলে, আর এটি ভূমাকেন্দ্রের কাছাকাছি যত আসে ততই তার অধিক্ষেত্র বিস্তারিত হতে থাকে৷ এই বিস্তারীকরণ আকস্মিক ভাবে ঘটে না৷ প্রতিসঞ্চর রূপ বিবর্তন ধারায় অনেকগুলি মধ্যবর্তী স্তর থাকে৷ প্রথমে থাকে কেবল মনের চিত্ত অংশটুকু৷ আগেই লা হয়েছে চিত্ত হচ্ছে মনের স্থূলতম অংশ৷ এই চিত্তযুক্ত মন পুরুষোত্তম অর্থাৎ ভূমাকেন্দ্রের প্রতি আকর্ষিত হয়৷ আর সেইসঙ্গে তার মধ্যে ভৌতিক ও মানসিক সংঘর্ষও হতে থাকে৷ এই প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ স্থূলমনকে সূক্ষ্মায়িত করে৷ অহংতত্ত্ব চিত্তের চেয়ে সূক্ষ্মতর৷ মনের বিবর্তনের পরবর্তী ধাপে চিত্তের কিছু অংশ অহংতত্ত্বে পরিণত হয়৷ তার অর্থ সেই মনে চিত্ত ও অহংতত্ত্ব এই দুয়েরই অস্তিত্ব আছে৷ কিন্তু সেই স্তরে চিত্তের অধিক্ষেত্র অহং তত্ত্বের অধিক্ষেত্রের চেয়ে অবশ্যই বড় থাকে৷ কিছু কিছু লতা উদ্ভিদে মনের এই দু’টো অংশ দেখতে পাই৷ মনে যেখানে কেবল চিত্তের অস্তিত্ব থাকে তা তার চারপাশের পদার্থের আকার নিতে পারে৷ কিন্তু অহং বোধ না থাকার কারণে তা বস্তুকে ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারে না৷ আর মহৎ তত্ত্ব না থাকার ফলে এই অস্তিত্বর্োধও থাকে না৷
যেখানে মনে চিত্ত ও অহংতত্ত্ব দুই-ই বর্তমান সেখানে তা চিত্তের সাহায্যে জড়ের ভাবনা নিতে পারে ও অহং তত্ত্বের মাধ্যমে জড়ের সঙ্গে সম্পর্কও রাখতে পারে৷ কিন্তু মহৎ তত্ত্বের অভাবে এর অস্তিত্ব সে অনুভব করতে পারে না৷
এই ধরণের লতা ও উদ্ভিদ যেখানে চিত্ত ও অহং তত্ত্ব দুই-ই বর্ত্তমান তাদের অবিকশিত জীব লে৷ কিন্তু তারা পূর্ববর্তী স্তরের চেয়ে অধিকতর বিকশিত৷ এই ধরণের জীবদেহকে যদি দ্বিখণ্ডিত করা হয় তা হলে তার দু’টো অংশ আবার দু’টো পৃথক জীবদেহে পরিণত হয়ে যাবে৷ এর কোন অংশই মৃত হবে না৷ কারণ সেই মনে পৃথক অস্তিত্বে কোন একক ভাব নেই৷ সেইজন্যে কোন কোন ফুলগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে পৃথক গাছ তৈরীর জন্যে সেই গাছটির কোন অংশ কেটে নেওয়া হয়৷ ঝতে হবে সেই সব উদ্ভিদের মধ্যে মহৎ তত্ত্বের অভাব আছে৷
আবার বিকশিত জীবদেহের মধ্যে চিত্ত, অহংতত্ত্ব ও মহৎতত্ত্ব তিনই আছে৷ নিরন্তর সংঘর্ষ ও ভূমাকেন্দ্রিক আকর্ষণের ফলে অহং তত্ত্বের কিছু অংশ মনের সূক্ষ্মতর অংশ মহৎ তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে মহৎ-এর অধিক্ষেত্র প্রথমে অহং তত্ত্ব অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর থাকে৷
ক্রমে ক্রমে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ বাড়তে থাকে আর মন আরো সূক্ষ্ম হতে থাকে৷ অহং-এর পরিভূ চিত্তের পরিভূর থেকে বৃহৎ হয়৷ সেই স্তরে চিত্ত অহংতত্ত্বের মধ্যেই থেকে যায়৷
ভূমা কেন্দ্রের্িন্দুর হত্বর আকর্ষণ মহৎ তত্ত্বের পরিধিকে বাড়িয়ে দেয় ও তা অহংতত্ত্বকে নিজের অঙ্গীভূত করে নেয়৷ সেই মন অবশ্যই সমস্ত অবিকশিত তথা নিন্মতর মনের চেয়ে হত্তর৷ যে জীবদেহে এই ধরণের মন থাকে সে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে যায়৷ সেই মনযুক্ত সত্তাকেই মানুষ লা হয়৷ চিত্ত, অহংতত্ত্ব ও মহৎতত্ত্ব যুক্ত বিকশিত জীব আর মহৎতত্ত্ব, অহংতত্ত্ব ও চিত্ত যুক্ত মানুষের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল এই যে, বিকশিত জীবের ক্ষেত্রে চিত্তের অধিক্ষেত্র অন্য দু’য়ের অপেক্ষা হত্তর হবার ফলে তারা কেবল স্থূলবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়, আর মানুষ বুদ্ধি ও বোধির দ্বারা চালিত হয়৷ কারণ মানুষের ক্ষেত্রে মহৎ ও অহং-এর অধিক্ষেত্র চিত্ত অপেক্ষা বৃহত্তর৷