পরমসত্তা যখন প্রকৃতির ৰন্ধন থেকে মুক্ত, সেই অবস্থা হচ্ছে নির্গুণ আর ৰন্ধনযুক্ত পরমসত্তা সগুণ৷ সগুণেও আছে দু’টি বিভাগ–একটা তার রূপময় অস্তিত্ব আর অন্যটি অরূপ৷
মানুষের মধ্যে যে ৰুদ্ধি, ৰোধি, আমি–ৰোধ (I-feeling) ইত্যাদি আছে এরা সব অরূপ৷ সেই রকম সগুণ ৰ্রহ্মেরও ৰুদ্ধি, ৰোধি ও আমি–ৰোধ অরূপ৷ সেইজন্যে সেগুলির কোনটাই আমরা দেখতে পাই না৷
এখন রূপযুক্ত অস্তিত্ব৷ মানুষ নিজের চিত্তকে দেখতে পারে কিন্তু মনকে নয়৷ যে রকম হাতীর রূপ নিলে চিত্ত হাতী হয়ে যায় আর মন তা দেখে৷ তাই চিত্ত রূপযুক্ত বস্তু৷ সেই রকম পরমাত্মারও চিত্ত রূপযুক্ত৷ এই পরিদৃশ্যমান জগতে যাকে আমরা বিশ্ব বলি, সেটাই পরমাত্মার চিত্ত৷
যেখানে সীমার বন্ধন সেখানেই রূপের অস্তিত্ব৷ যেখানে সীমা নেই, অসীম, তা অরূপ৷ সেখানে গুণ থাকতেও পারে, নাও পারে৷ যেখানে গুণ আছে তাকে সগুণ, যেখানে গুণ নেই তাকে নির্গুণ বলি৷
তাহলে পরমাত্মিক চিত্ত যা এই মহাবিশ্ব (Universe) তা তাঁর চৈত্তিক সৃষ্টি৷ এ হচ্ছে রূপময় অস্তিত্ব, তাই তাতে সীমাও আছে৷ মানুষ সেই বিরাট চিত্তকে কল্পনা করতে পারে না কেননা পরমাত্মা মানুষের চিত্ত থেকে অনেক বৃহৎ৷ যদি তা না হত তবে কেবলমাত্র সগুণ বা অরূপ অথবা নির্গুণই থাকত৷ মনের শেষ দুই অংশ–অহং তত্ত্ব ও মহৎ তত্ত্ব–অরূপ ও সগুণ৷ এই যে অরূপ ও সগুণ তার বিষয় সীমিত চিত্ত৷ কিন্তু পরমাত্মার চিত্ত বিশাল ও বিশ্ব তার বিষয়৷ মানুষ যখন সাধনার দ্বারা চিত্তের বিষয়কে বিস্তারিত করতে করতে বিশ্বের সমান করে নেয় তখন পরমাত্মার অরূপ সগুণ আর মানুষের অরূপ সগুণ দুই–ই এক হয়ে যায়৷ অণুমন ভূমামনে পরিণত হয়ে যায় অর্থাৎ সাধকের মন সগুণ ব্রহ্মের মনের সমান হয়ে যায় ও আত্মা পরমাত্মাতে পর্যবসিত হয়৷ এইজন্যে একে (এক স্তরে) সগুণ সাধনা বলতে পারি৷ এই ধরনের সগুণ উপাসনা কোনো অবস্থাতেই সাকারের উপাসনা নয়৷
এই যে অরূপ গুণবান মানব মন, এর চৈত্তিক বিষয় যত বড় হবে, সেই অনুযায়ী তার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হবে৷ তাই সাধনা হচ্ছে মনের বিষয়কে বড় করতে থাকা৷
সমাজের মানুষ যদি একটা বিশেষ জেলা, প্রান্ত, দেশ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থেকে যায় তবে তাদের চিত্তের বিষয় ছোটই থেকে যাবে৷ তার দ্বারা ব্রহ্মসাধনা কখনই হবে না৷ এইজন্যে তাকে সমগ্র বিশ্বকে নিজের দেশ হিসেবে মেনে নিতে হবে৷ পরমাত্মার কাছে হিন্দু–মুসলমান–শিখ্ প্রভৃতি কোনো ভেদাভেদ নেই৷ সাধকের দেশ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর তার জাতি হচ্ছে সে জীব৷ ধার্মিক সাধনা ও সংঘটনের স্বার্থে বিশ্বকেই সে নিজের অবলম্বন বা বিষয় করে নেবে৷ যে বিশ্বৈকতাবাদের প্রচার করে কিন্তু মনে জেলাবাদ, জাতিভেদ, দেশবাদ ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেয় সে কপটাচারী৷ শেষপর্যন্ত তাকে বিড়াল, কুকুর হিসেবে জন্ম নিতে হবে৷ তাই সাধককে এটা বুঝতে হবে যে এই বিশ্ব ‘আমার’ নিজের আর ‘আমি’ সমগ্র বিশ্বের৷ যে তা মানবে না তাকে মানতে বাধ্য করতে হবে৷
সমাজ হচ্ছে মানুষের সামূহিক সংস্থা৷ এতে সর্বদা থাকে এক সামূহিক সংহতি৷ যতদিন মানুষ বিশ্বৈকতাবাদকে মেনে না নেবে ততদিন সমাজ তৈরী হতে পারে না৷ তথাকথিত আদর্শের ভিন্নতা অনুসারে পৃথক সমাজ তৈরী হতে থাকবে৷
বিশ্বশান্তির জন্যে একটি আদর্শ নিয়ে চলতে হবে৷ এতেই হবে ধর্মের প্রতিষ্ঠা, মতবাদের দ্বারা তা কখনই সম্ভব নয়৷ মজহব বা ধর্মীয় মতবাদের দ্বারা জীবের মুক্তি কখনই হতে পারে না৷ সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথাও এক ধরনের কপটাচার৷ এক আদর্শের জন্যে নির্গুণ ‘ব্রহ্ম’কেই মেনে চলতে হবে আর বিশ্ব থাকবে চৈত্তিক বিষয়৷ এটাই হচ্ছে এক আদর্শ৷ এই বিশ্বৈকতাবাদ ছাড়া বাকী যত পথ আছে সব মৃত্যুর মার্গ৷ মানুষ করবে জীবনের সাধনা, মৃত্যুর নয়৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস গাইতেন–
‘‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা করি৷’’
এই বিশ্ব এক রসসমুদ্র আর এটাই যখন মনের বিষয় হবে তখন মন হয়ে যাবে সগুণ ব্রহ্ম৷
জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে বিশ্বৈকতাবাদকে মানতেই হবে কিন্তু মনে রাখতে হবে শান্তি এক আপেক্ষিক সত্য৷ পাপী যখন সাধু বা সৎলোকের ভয়ে মাথা নীচু করে চলে তখন তাকে বলব সাত্ত্বিকী শান্তি, আর যখন পাপী চলে মাথা ডঁচু করে তখন বুঝতে হবে সমাজে চলছে তামসিক শান্তি৷ বিশ্বৈকতাবাদ যার ধ্যেয় সে অবশ্যই সাত্ত্বিক স্বভাবের মানুষ হবে৷ তাই সত্যিকারের শান্তি হচ্ছে সাত্ত্বিকী শান্তি৷ সেক্ষেত্রে শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, আর যতক্ষণ পর্যন্ত এই সংগ্রামে জয় হতে থাকবে ততক্ষণ সমাজে থাকবে সাত্ত্বিকী শান্তি৷ বিভেদমূলক শক্তিকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে৷ এটা হ’ল সংগ্রামী সাধকের সামাজিক রূপ৷ বৈয়ষ্টিক জীবনে তাকে মানসিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা নিজের চৈত্তিক বিকাশ করে যেতে হবে এইজন্যে তাদের সর্বদা এক হয়ে থাকতে হবে৷ সাধককে এইভাবে এক দৃঢ় সমাজ তৈরী করে নিতে হবে, না হলে ঠিকভাবে সংগ্রাম করা সম্ভব হবে না৷