বর্ণমালা......... কালীর গলায় মুণ্ডমালা অক্ষমালা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘অক্ষ’ শব্দটির অনেকগুলি অর্থ রয়েছে৷ ‘অ’ বর্ণমালার প্রথম অক্ষর ও ‘ক্ষ’ বর্ণমালার শেষ অক্ষর৷ এই ‘অ’  ও ‘ক্ষ’–এর মাঝখানে রয়েছে আরও ৪৮টি অক্ষর৷ অক্ষরের মোট সংখ্যা ৫০৷ তাই ‘অক্ষ’ বলতে বোঝায় ৫০টি বর্ণকে৷ বর্ণমালার পরিবর্তে তাই অক্ষমালাও ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷ অথর্ববেদীয় ভদ্রকালীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, কালান্তরের দেবী মহাকালী বা ভদ্রকালী এই ৫০টি অক্ষরকে ধারণ করে রাখেন৷ সেকালের মানুষের লিপিজ্ঞান ছিল না৷ কিন্তু বর্ণ বা অক্ষর জ্ঞান ছিল৷ মন্ত্রাদি গুরুপ্রমুখাৎ শিষ্য কর্ণের মাধ্যমে গ্রহণ করতেন৷ সংসৃক্তে কাণকে ‘শ্রুতি’ বলা হয়৷ এই কারণে কাণের মাধ্যমে শেখা বেদকে ‘শ্রুতি’ বলা হ’ত৷

হ্যাঁ, সেকালের মানুষ লিখতে জানত না৷ তাই তারা ৫০টি অক্ষরের পরিবর্তে মানুষের ৫০টি মুখ কল্পনা করে নিত৷ ভাবনা নেওয়া হ’ত, সৃষ্টির আদ্যাক্ষর ‘অ’ আছে ভদ্রকালীর হাতে, বাকীগুলো আছে গলার মালা হিসেবে যদিও মহাকাল নামে কোন অবিচ্ছিন্ন সত্তা নেই৷ তাই দার্শনিক বিচারে মহাকাল বা মহাকালী সত্তা যুক্তির সমর্থন পায় না৷ কাল প্রতি মুহূর্তে তৈরী হচ্ছে ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মননের পরিমাপে৷ তবু সেকালের মানুষ ভেবেছিল হয়তো বা প্রলয় হবে, হয়তো বা সবকিছু ধ্বংস হবে৷ সেকালের মানুষ বিজ্ঞানের উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে প্রলয়ের কল্পনা করেছিল, একদিন সব কিছু ধবংস হয়ে যাবে–এই ধরনের ভয় দেখানো হয়েছিল৷ প্রলয়কালে ভদ্রকালী বর্ণগুলিকে রক্ষা করবেন যদিও দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রলয়বাদের বিরুদ্ধে৷*(বিশ্বের কখনও তাপগত মৃত্যু–thermal death–হবে না, সত্তাবিশেষের তাপগত মৃত্যু অবশ্যই হতে পারে বা হবে কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কঠিন জড়ে রূপান্তরিত সত্তা অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও সমিতির–clash and cohesion– ফলে প্রচণ্ডবেগে ভেঙ্গে পড়বে ও তার পরিণামে বিরাট পরিমাণ শক্তি ছুটে বেরিয়ে আসবে–Immense heat energy will be released from the broken structures –যা বিশ্বের তাপগত মৃত্যু হতে দেবে না৷) যাই হোক সেকালের মানুষ যা ভাবত তাই বলছি৷ তারা ভাবত, ভদ্রকালী প্রলয়কালে ধবনি রক্ষা করবেন৷ অক্ষরজ্ঞান ছিল না৷ তাই অক্ষরের দ্যোতক হিসেবে মানুষের মুখকে ব্যবহার করত৷ তাই শেষ পর্যন্ত মানুষ অক্ষমালাকে মুণ্ডমালা বলে ধরে নিয়েছিল৷ ভদ্রকালীকে কল্যাণের প্রতীক বলে গ্রহণ করে শান্তি পেয়েছিল৷

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভাল, বেদ যাঁরা তৈরী করেছিলেন, তাঁরা বেদ লিখে যাননি৷ বেদের ঋক্ বা শ্লোক মুখে মুখে তৈরী করে তাঁরা শিষ্যদের শিখিয়ে গেছেন গানের সুরে গেয়ে গেয়ে৷ তাই সুর ছিল, ছন্দ ছিল, ব্যাকরণ ছিল, কল্প ছিল, নিরুক্ত ছিল, ছিল না লেখাপড়ার মধ্যে কোন কিছু৷ বেদ শিক্ষার যে ছ’টি অঙ্গ অর্থাৎ ছন্দ, কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ (এতে মতভেদ আছে), জ্যোতিষ ও আয়ুর্বেদ (এতেও মতভেদ আছে? অনেকের মতে আয়ুর্বেদ নয়, ধনুর্বেদ)–এই ছ’টি অঙ্গকে বলা হ’ত বেদাঙ্গ৷ এই বেদাঙ্গ ছিল অলিখিত কারণ মানুষের তখন লিপি–জ্ঞান ছিল না৷ লিপি–জ্ঞান না থাকায় সেকালের মানুষ বেদকে শ্রুতি (কাণে শুণে শেখা কাণের একটা নাম ‘শ্রুতি’) হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন৷ পরবর্তীকালে মানুষের যখন লিপি জ্ঞান হ’ল, তখনও বেদকে তাঁরা লিখতে চাইলেন না৷ তখন তাঁদের মাথায় পর্বতপ্রমাণ এমন একটা কুসংস্কার জমে গেছে যে বেদ বুঝি লিখতে নেই৷ তাঁরা তলিয়ে দেখলেন না যে পূর্বপুরুষদের লিপি–জ্ঞান ছিল না বলেই তাঁরা বেদ লেখেননি, থাকলে নিশ্চয়ই লিখতেন৷

উৎস

(‘‘বর্ণবিচিত্রা’’ থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)